শিলিগুড়ি ও কালচিনি: কখনও বিধানসভা, কখনও পঞ্চায়েত, কখনও লোকসভা। নতুন নতুন ভোটের কথা আসে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের চা বলয়ের দুর্দশার ছবিটা একই থাকে। জলপাইগুড়ির রায়পুর চা বাগানের পর এবার আলিপুরদুয়ারের মধু চা বাগান। আবার সামনে এল অপুষ্টিতে ভুগে চা শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা। ঘটনাটি অবশ্য কয়েকদিন আগেকার। গত ২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয়েছে সেই বাগানের শ্রমিক ধনী ওরাওঁয়ের(৫৮)। প্রতিবেশী সহ স্থানীয়দের অভিযোগ, কেবল ধনী নয়, অপুষ্টিতে ভুগছিলেন তাঁর স্ত্রী আশারানি ওরাওঁ-ও। ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার আশারানির বয়স ৪৭ বছর। ওজন মাত্র ২৬ কেজি। একজন গড়পড়তা কিশোরীর সমান ওজনের আশারানির চিকিৎসার ব্যবস্থা অবশ্য করেছে প্রশাসন। তবে অপুষ্টিতে ভুগে ধনীর মৃত্যু হওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন সরকারি আধিকারিকরা।
মৃত শ্রমিকের স্ত্রীকে প্রশাসনের তরফে লতাবাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। কালচিনির ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক শ্রীকান্ত মণ্ডল জানিয়েছেন, ‘ওই মহিলার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। পাশাপাশি তাঁর রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে গিয়েছিল। তবে চিকিৎসার পর এখন তিনি অনেকটা সুস্থ রয়েছেন।’ বুধবার বিকেলে ঘটনা খতিয়ে দেখতে বাগানে আসেন আলিপুরদুয়ারের জেলা শাসক আর বিমলা। তিনি বলেন, ‘মৃত শ্রমিকের আধার কার্ড, র্যাশন কার্ড সব রয়েছে। তিনি র্যাশন তুলতেন কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ সেইসঙ্গে জেলা শাসকের দাবি, ওই বাগানেই থাকেন ধনীর ভাই। কিন্তু মৃতের পরিবারের কোনও সদস্য অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগ তোলেননি।
মৃত্যুর পর চা বাগান শ্রমিকদের সংগঠন, পশ্চিমবঙ্গ চা মজদুর সমিতির তরফে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করে ঘটনা খতিয়ে দেখা হয়। ধনীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী, ভাই, প্রতিবেশীদের সঙ্গে কমিটির সদস্যরা কথা বলার পর কিন্তু মৃত্যুর কারণ হিসেবে অপুষ্টিকেই দায়ী করেছেন।
বুধবার ওই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের সদস্য আইনজীবী পূর্বায়ন চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা ৪ ও ৫ তারিখ মধু চা বাগনে গিয়ে দেখি বাঁশ লাগানো ত্রিপল দিয়ে ঘেরা একটি ঘরে ধনী ওরাওঁয়ের স্ত্রী পড়ে রয়েছেন। তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থাও ঠিক ছিল না। আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, ধনী অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বাগানে কাজ করতে যেতে পারতেন না বলে মজুরিও মিলত না। শারীরিক অসুস্থতার কারণে অন্য কাজও করতে পারতেন না।’
সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অনুরাধা তলোয়ারের কথায়, ‘আগে বন্ধ বাগানে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যেত। কিন্তু মধু চা বাগান তো প্রায় দু’বছর আগে খুলে গিয়েছে। খোলা বাগানেও এই ধরনের মৃত্যু প্রমাণ করে দিচ্ছে, চা বাগানের শ্রমিকরা আসলে কতটা দুর্দশায় রয়েছেন।’ তাঁর অভিযোগের তির কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ছাড়াও বাগান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও।
অনুরাধাদের অভিযোগ, যে শ্রমিক মারা গিয়েছেন তিনি গত দু’বছর ধরে র্যাশন সামগ্রী পাচ্ছিলেন না। এছাড়া লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, তপশিলি উপজাতির ভাতার মতো সব সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন ধনী ও তাঁর স্ত্রী। মৃত শ্রমিকের প্রতিবেশী সাবিনা ওরাওঁয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ধনী মৃগীরোগে আক্রান্ত ছিলেন। সেজন্য তিনি বাগানের কাজ করতে পারতেন না। সাবিনা বলেন, ‘গত শুক্রবার দুপুরে কাজ থেকে ফিরে এসে দেখি ধনী মরে গিয়েছে।’ আরেক প্রতিবেশী সুশিলা খাড়িয়া বলেন, ‘আমরা ওদের খাবার দিতাম। তবে আমাদের ক্ষমতাও সীমিত। তাই আলাদা করে পুষ্টিকর খাবার সব সময় দিতে পারতাম না।’
এদিকে, ধনীর স্ত্রী আপাতত চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছেন। কালচিনির বিডিও জয়দীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘অসুস্থ ওই মহিলাকে যদি পরিবারের তরফে গ্রহণ না করা হয়, তাহলে প্রশাসনের তরফে তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করা হবে।’