Monday, April 29, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়বাংলার ক্রিকেটের রূপ খুঁজিতে যাই না আর

বাংলার ক্রিকেটের রূপ খুঁজিতে যাই না আর

বাংলার হয়ে খেলে ভিনরাজ্যের তিন ক্রিকেটার ভারতীয় দলে। অথচ বাংলার পারফরমেন্স সর্বত্র জঘন্য। ঋদ্ধিমানকে তাড়ানো হল। সৌরভের মিশন মুখ থুবড়ে পড়েছে।

  • প্রতীক

শিল্পপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের শালবনির প্রস্তাবিত ইস্পাত কারখানা সফল হবে কি না তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল কর্তা সৌরভের ভিশন ২০-২০ প্রোজেক্ট যে মুখ থুবড়ে পড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সিএবি প্রধান হয়েই ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেট অধিনায়কদের অন্যতম সৌরভ বাংলার ক্রিকেটকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতির ব্যাটারদের জন্য ভাঙ্গিপুরপ্পু ভেঙ্কটসাই লক্ষ্মণ, বোলারদের জন্য ওয়াকার ইউনিস, স্পিনারদের জন্য মুথাইয়া মুরলীধরন বাংলা দলের নেট আলো করে ছিলেন বেশ কিছুদিন। কিন্তু সেসবই ক্ষণিকের হাসিকান্না। তাতে বাংলার ক্রিকেট দলের বা রাজ্যের ক্রিকেটের কোনও দীর্ঘমেয়াদি লাভ হয়েছে বলে এই ২০২৪ সালের শেষ শীতে এসে তো দেখা যাচ্ছে না।

এই বাক্য এমন একটা সময়ে লিখতে হচ্ছে যখন ভারতীয় দলে একসঙ্গে দুজন বাংলা দলের বোলার রয়েছেন। রাঁচি টেস্টে আকাশ দীপের অভিষেকও মন্দ হয়নি। মহম্মদ সামি এই মুহূর্তে চোটের জন্য বিশ্রামে থাকলেও দীর্ঘকাল ধরে তিনি ভারতীয় বোলিংয়ের স্তম্ভ। ফিরে এলে অদূরভবিষ্যতে জসপ্রীত বুমরাহর বিশ্রামের ম্যাচে যদি বাংলার তিন পেসারকে একসঙ্গে খেলতে দেখা যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অভিমন্যু ঈশ্বরণ যে হারে রান করে চলেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং ভারত এ দলের হয়ে, তাতে অদূরভবিষ্যতে তাঁকেও ভারতীয় দলে খেলতে দেখা যেতেই পারে। তাহলে বাংলার ক্রিকেটের কোনও লাভ হয়নি বলছি কেন? কারণ একাধিক।

এগুলো ব্যক্তিগত সাফল্য মাত্র। সামি, মুকেশ কুমার আর আকাশকে রনজি ট্রফিতে বাংলার হয়ে একসঙ্গে খেলতে দেখা যাবে– এমন সম্ভাবনা কম। ভারতীয় দল এত বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে যে একবার জাতীয় দলে থিতু হয়ে গেলে রনজি ম্যাচ খেলার আর অবকাশ থাকে না। তার উপর সময়, সুযোগ থাকলেও ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার আগ্রহ এখন ক্রিকেটারদের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান। আইপিএলে নিয়মিত হয়ে যেতে পারলে তো কথাই নেই। বাংলার প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের ঈশান কিষান তো টেস্টও খেলতে চাইছেন না। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাঝপথ থেকে পলাতক ছবির অনুপকুমার হয়ে গেলেন। ঝাড়খণ্ড দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও তাঁকে খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে রাজ্য থেকে কোনও ক্রিকেটার জাতীয় দলে সুযোগ পেলে এখন বেল পাকলে কাকের কী বলাই সমীচীন। দেখা দরকার, রাজ্য দল সাফল্য পাচ্ছে কি? সে প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক।

শীত শেষ হওয়ার আগেই বাংলার রনজি দলের অভিযান শেষ হয়ে গিয়েছে এবারে। এলিট গ্রুপ বি-তে তৃতীয় স্থানে শেষ করেছে বাংলা। ফলে নক আউট পর্যায়ে পৌঁছানো হয়নি। গত মরশুমে ফাইনালে পৌঁছেও সৌরাষ্ট্রের কাছে শোচনীয় হার হয়েছিল। তার আগেরবার সেমিফাইনালে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধেও একই ঘটনা ঘটে। অতিমারির আগের শেষ রনজি ট্রফিতেও ফাইনালে সৌরাষ্ট্রের কাছেই ইনিংসে হার হয়েছিল বাংলার। অর্থাৎ ঘরোয়া ক্রিকেটে যে দলগুলো ধারাবাহিকভাবে সফল, তাদের সামনে পড়লেই ব্যবধান অনেকখানি হয়ে যাচ্ছে। মুম্বইয়ের মতো ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা দল দূর অস্ত, কর্ণাটক বা তামিলনাডুর স্তরেও পৌঁছায়নি বাংলা।

সাফল্যের লেখচিত্র ঊর্ধ্বগামী হওয়ার বদলে নিম্নগামী বললেও ভুল হয় না। পঞ্চাশ ওভারের প্রতিযোগিতা বিজয় হাজারে ট্রফিতেও সাম্প্রতিককালে বলার মতো সাফল্য নেই। কুড়ি ওভারের মুস্তাক আলি ট্রফি নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন, কারণ ওটা বস্তুত আইপিএলের প্রতিভা অন্বেষণ পরীক্ষা। সেখান থেকে আকাশ দীপ, শাহবাজ আহমেদদের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো খুঁজে নিচ্ছে।

বাংলার ক্রিকেটের আরেকটা দিকও আলোচনার যোগ্য। সামি, মুকেশ, আকাশরা নিজেদের রাজ্যে ক্রিকেট খেলার পরিবেশ না পেয়ে কলকাতায় এসে পরিশ্রম করে জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা অর্জন করছেন। অথচ সৌরভের পর ঋদ্ধিমান সাহা ছাড়া কোনও নিখাদ বঙ্গজ ক্রিকেটার কিন্তু ভারতীয় দলে নিয়মিত হয়ে উঠতে পারেননি। তাহলে নয়ের দশক থেকে সৌরভের দৃষ্টান্তে পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলো কী অবদান রাখল? না, বাংলা পক্ষ মার্কা বাঙালির প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ তুলছি না। বলছি ছেলের কিটব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাঙালি বাবা-মায়েরা ভিনরাজ্য থেকে আসা ছেলেগুলোকে দেখে শিখতে পারেন– সাফল্যের খিদে আসলে কী জিনিস এবং পরিশ্রম কাকে বলে।

পরিশ্রমী বাঙালিকে অবশ্য বাঙালিরাও যে প্রাপ্য সম্মান দেন তা নয়। নইলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে মনোজ তিওয়ারির চেয়ে অনেক বেশি সফল ঋদ্ধিমান সাহাকে বাংলা ছেড়ে ত্রিপুরায় চলে যেতে হত না। তাঁর অপরাধ কী ছিল? অনেক ভেবেও সৌরভ-ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিককে চটিয়ে ফেলা ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যাবে না। অথচ মনোজ গত মরশুমের শেষে আর খেলব না বলায় কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছিল। শেষমেশ সিএবি সচিব স্নেহাশিস গাঙ্গুলির অনুরোধে তিনি এ মরশুমেও খেলতে রাজি হয়ে যান। তরুণ ক্রিকেটারদের উঠে আসার সুযোগ দিতে হবে ইত্যাদি যুক্তি কারও মাথায় আসেনি। এবারে বিহারের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচ খেলে চূড়ান্ত অবসর ঘোষণা করার পর মনোজকে রীতিমতো সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য ঋদ্ধিমান এমন ব্যবহার আশা করতে পারেন না। তাঁর চোদ্দো পুরুষের কেউ কখনও সিএবি কর্তা ছিলেন না। তার উপর তিনি কলকাতার অভিজাত পরিবারের সন্তান নন। তিনি হলেন শিলিগুড়ির ছেলে, যেখান দিয়ে কলকাতার বাবু-বিবিরা দার্জিলিং, কালিম্পং, গ্যাংটক বেড়াতে যান। খেলতে খেলতেই রাজনীতিতে নেমে পড়ে কেওকেটা হতে পারলে অন্য কথা ছিল। অন্যথায় ঋদ্ধিমান বাংলার ক্রিকেটের কতটা সেবা করেছেন না করেছেন তার হিসাব করা বৃথা।

আরও একটা কথা ভেবে দেখার মতো। শাহরুখ খান ধুতি-পাঞ্জাবি পরে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মালা দিয়ে, ভুল বাংলায় থিম সং গেয়ে ইডেন উদ্যানে যে দলটার তাঁবু ফেলেছেন, সেই কলকাতা নাইট রাইডার্সকে দিয়ে বাংলার ক্রিকেটের কি উপকার হচ্ছে? ওটা কাল রাজকোট নাইট রাইডার্স বা অযোধ্যা নাইট রাইডার্স হয়ে গেলেই বা কী ক্ষতি হবে? সে দল আইপিএল জেতায় রাজ্যের রাজধানীতে এ রাজ্যের করদাতাদের টাকায় ঘটা করে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছিল। তাতে বাংলার ক্রিকেটের কী উপকার হয়েছে? আইপিএল যখন চালু হয়, তখন বলা হয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো যে এলাকায়, সেই এলাকার ক্রিকেটের উন্নতিকল্পে তারা কাজ করবে। সে কাজের কোনও হিসাব আছে? রাজ্য সরকারের এ রাজ্যের সমস্ত খেলায় যেরকম কড়া নজর, তাতে কলকাতা নাইট রাইডার্সের জবাবদিহি চাইতে পারে কিন্তু।

মনোজ নিজেই মন্ত্রীসভার সদস্য। সুতরাং চাইলে স্বয়ং এ কাজ করতে পারেন। কিন্তু বাংলার ক্রিকেটের যে আর গুরুত্ব নেই তা তো তিনি ভােলাই বুঝে ফেলেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দশ হাজারের বেশি রানের মালিক মনোজ বিদায়কালে বলেছেন, তরুণ খেলোয়াড়রা আইপিএল কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগে হতাশ হয়ে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে ফেলেছিলেন যে পরের মরশুম থেকে রনজি ট্রফি বন্ধই করে দেওয়া উচিত। তার জন্য বোর্ডকে জরিমানাও দিতে হয়েছে। কিন্তু কথাটা তো ভুল বলেননি। আগামীদিনে বাংলার ক্রিকেট বলে আদৌ কিছু থাকবে কি না কে জানে! সুতরাং আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিকে চটিয়ে কী লাভ? তাদের বিরুদ্ধে কিছু করে, লড়েই জেতার আশা নেই।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

severe water shortage in Maltipur

Water Crisis | গরমে শুকিয়ে কাঠ মহানন্দা, তীব্র জলসংকট মালতীপুরে

0
সামসী: মহানন্দা নদী একেবারে শুকিয়ে কাঠ। শুনতে কিছুটা অবাক মনে হলেও ঘটনাটি একেবারে সত্যি। মালতীপুর বিধানসভা এলাকার চন্দ্রপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পুরাতন খানপুর ঘাট...

Canada | খালসা দিবসে হাজির কানাডার প্রধানমন্ত্রী, ভাষণের মাঝেই ‘খলিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: খলিস্তানি জঙ্গিদের কানাডায় (Canada)আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জাস্টিন ট্রুডোর (Justin Trudeau) বিরুদ্ধে। এবার শিখদের মহোৎসবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতে উঠতেই...

SSC Recruitment Case | হাইকোর্টের রায়ের একটি অংশে স্থগিতাদেশ শীর্ষ আদালতের, তবে উঠল প্রশ্ন

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: এসএসসি দুর্নীতিতে (SSC Recruitment Case) সুপার নিউমেরারি পোস্ট তৈরি নিয়ে সিবিআই (CBI) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের (Calcutta High Court)...

New Zealand | অভিনব পদ্ধতিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিউজিল্যান্ডের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: অভিনব পদ্ধতিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করল নিউজিল্যান্ড। তবে কিউয়িদের তরফে নির্বাচকরা নন, সোমবার সাংবাদিক সম্মেলন করে ১৫ জনের স্কোয়াড...
aam panna recipe

বাইরে তীব্র গরম, ঘরেই বানিয়ে নিন ‘আম পান্না’

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ক্রমশ তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে বঙ্গে। উত্তরবঙ্গের তাপমাত্রা কিছুটা সহনীয় হলেও, দক্ষিবঙ্গের গরম অসহ্য। বাইরে বেরনোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন মানুষ...

Most Popular