- সন্দীপন নন্দী
কী নামে ডাকা যায় তারে? সুভাষকাকিমাদের গ্রাম? যে প্রান্তরে সাধ মেটে না, আশা ফুরায় যায়। রূপসি বাংলার সেই বিস্ময়গঞ্জের নাম সিঁদুরমুছি। দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডির কাছে। যেখানে জীবনবল্লভের নামে মাসে মাসে মিসিং ডায়ারি দেন বারোঘরের মেয়েরা। স্বামীশোকের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পৃথিবীর এক বিরল গ্রাম। যেখানে পা ফেলেই ভেতরটা পর্দাতোলা মঞ্চের মতো লাগে।
বডি না দেখে সিঁদুর মোছা যায় স্যর? থালা মেজে রাখি রোজ, যদি ফেরে। উত্তরদাতা আশালতা হেমব্রম। যার বৃথা আশা মরতে মরতেও মরেনি। জানা গেল এখানেই গভীর রাতে রোজ স্কুলের ছাদে ছুটে যান কুন্তী বর্মন। সিঁদুরমুছি গাঁয়ের এক বিব্রত পোড়াকপালি। বরের ফোনের টাওয়ার খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাওয়া সেই মেয়ে। আস্ত গ্রাম যাকে হ্যালোপাগলি নামে চেনে। এখন ফতেপুরে বাস থামলেই সিটে সিটে কাছের মানুষ খুঁজে বেড়ান সে মহিলা। বসনভূষণ মলিন হলেও সিঁথির সিঁদুরটুকু অমলিন। কে বলবে কুন্তী অ্যাবনর্মাল?
ভয়ে যে গ্রামে সারারাত এখন চৌকিটাই দরজার কাছে টেনে তালা করে ঘুমোয় মায়ের দল। প্রধান সে বার অভিযোগের কাগজটা ডাস্টবিনে ফেলে শুধু বলেছিলেন,
তবে তো প্রত্যেক ঘরে একজন করে বডিগার্ড দিতে হয় রে! ওই শেষ। চরকি ভুঁইমালি আর কোনওদিন নালিশ জানাতে যাননি। বরং বরের বালিশটা ঘেন্নায় নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সার্ভে করতে আসা আশাদিদিদের তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বেহুলা নই। লখিন্দরের জাতটা বড় চালাক ম্যাডাম। একবার প্রাণভিক্ষে পেলেই ফুড়ুৎ। সব ভুলে যায়, সব।’
তাই পুরুষরা এ গ্রামে জীবিতমৃত হয়ে আছেন সরকারি খাতায়।
ট্র্যাজেডি নাকি বিস্ময়? গ্রামে পুরুষদের ঘরছাড়ার মড়ক লাগে বছর বছর। এ যেন পুরুষের চিরপরিচিত এক ভাইরাল অসুখ। ঘরের বৌ ছেড়ে সব পরিযায়ী শ্রমিকের বেশে কেরল, রাজস্থান, মিজোরামে বসবাস করছেন নিশ্চিন্তে।
পুকুরপাড়, ধানখেতের পর ধু-ধু মাঠ, পাকা রাস্তা ছাড়িয়ে ইটভাটা। আশ্চর্য, কোথাও কোনও পুরুষমানুষ নেই গ্রামে। নারী পাচার খবর হয় কিন্তু এতগুলো পুরুষমানুষ রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে একটা আস্ত গ্রাম ফিমেল ভিলেজ হয়ে গেল, সে খবর রাখলেন ক’জন? সম্পর্কের দাম এমনিতেই বেশিরভাগ পুরুষ দেয় না। একঘেয়ে সাংসারিক দায়ভার, সন্তানপালন থেকে চিরমুক্তির আহ্বানে কাকপক্ষীকে না জানিয়েই আইনের ফাঁক গলে স্ত্রী প্রত্যাহারে ভোরের ট্রেনে নিরুদ্দেশ হয় দলে দলে। আর আপাত সরল ও বোকা মেয়েদের ফোনকেন্দ্রিক একমাত্র যোগাযোগকে গলা টিপে মারা তো সেই পুরুষের কাছে মশা মারার মতো সহজ। তাই বরাতজোরে ফোন লাগলেই ওপারে শোনা যায়, যা করার করে নে। এই তো পুরুষের নেপথ্যভাষণ।
ফলে একশো মেয়ের গণস্বাক্ষরের দশপাতা, জাতির জনকদের লজ্জা হয়ে থেকে যায় সিঁদুরমুছিতে। বরকে ঘরে ফেরান, এ কথার নীচে সই দেওয়া যায়? এ কোনও আবেদনের যোগ্য হতে পারে স্যর? বর পালিয়েছে, সর্বসমক্ষে উচ্চারণ করা যায়? সমবেত স্বরে কথাগুলো ঘুরঘুর করে। তবু ওঁরা মনে রাখেন স্বামীকে। ছায়ার মতো আছে না আছে জেনেও অনুভবে রেখে দেন। বাধ্য হয়ে সধবার সাজে বাঁচিয়ে রাখেন শাশুড়ির সন্তানসুখ। একটা মিরাকলের আশায় ঘরে ঘরে সিঁদুর পরে অপেক্ষা করেন সুভাষকাকিমারা। অনাচার বাড়ে। তবু সুভাষরা ঘরে ফেরেন না।
(লেখক প্রবন্ধকার। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)