Wednesday, May 22, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়এ তো খেলা ভাঙার খেলা!

এ তো খেলা ভাঙার খেলা!

  • দেবদূত ঘোষঠাকুর

এখন ভরা চৈত্র মাস। কালবৈশাখীর মাস। এ সময় কেমন থাকে দক্ষিণবঙ্গের আবহাওয়া?

মোহিতলাল মজুমদার তাঁর ‘কালবৈশাখী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মধ্যদিনের রক্ত নয়ন অন্ধ করিল কে, ধরণীর ’পরে বিরাট ছায়ার ছত্র ধরিল কে’।  কিন্তু ওই ‘ছত্রছায়া’ তৈরি হচ্ছে কোথায়? বাতাসে আর্দ্রতার জন্য তাপমাত্রাই বাড়তে পারছে না। কলকাতার আশপাশে এখন ভাদ্র মাসের প্যাচপেচে গরম। আবহাওয়া ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।

দক্ষিণবঙ্গে ভোটের আবহাওয়াও অবশ্য তেমন গরম হয়নি এখনও। আমাদের এ রাজ্যে ভোট ঘোষণার আগে থেকেই, ভোটের হাওয়া গরম হতে শুরু করে। এ বার সেখানেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সেটা কি কোনও পরিবর্তনের ইঙ্গিত? প্রচার কেন, এখনও প্রধান দলগুলির সবাই, সব কেন্দ্রের জন্য প্রার্থীই ঠিক করতে পারেনি। কিন্তু কলকাতার আশপাশের আসনগুলিতে যেসব প্রার্থীর নাম ঘোষণা হয়েছে, তাতেও কিন্তু ওলটপালটের ছাপ স্পষ্ট।

সিপিএমের প্রথম দফার প্রার্থীপদ ঘোষণা থেকেই চমকের শুরু। আজন্ম সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা, যাদবপুরের প্রাক্তন সাংসদ ও বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী এবার দমদম লোকসভা আসনের প্রার্থী। সুজন দমদমে কেন?

সুজনের যাদবপুরে এ বার সিপিএমের প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য। দমদমের অচেনা মাঠে কি স্বেচ্ছায় এসেছেন সুজন?  দমদমে তো তন্ময় ভট্টাচার্যের মতো নেতা ছিলেন। তাহলে সুজন কেন? প্রশ্নটা করে ফেললাম তাঁকেই। সুজনের জবাব, ‘আমরা রাজনীতির মানুষ। মাঠে নেমে কাজ করি। আমার এলাকা বলে কিছু নেই। দল যেখানে বলবে দাঁড়াতে হবে।’  ওই সিপিএম নেতার এক কাছের মানুষের মন্তব্য, ‘নামটা সুজন। তাই মাথা পেতে নিয়েছেন দলের নির্দেশ।’

শুধু সুজন কেন? দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র দেখুন। রায়গঞ্জ থেকে উড়িয়ে বিজেপি প্রার্থী করেছে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীকে। দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূলের আঁতুড়। সেখানে মালা রায়ের মুখে দেবশ্রীকে দল ছেড়ে দিল কি না, সেই প্রশ্ন কিন্তু ইতিমধ্যেই উঠেছে। এমনিতেই প্রার্থীর নাম ঘোষণা অনেকটা পরে হওয়ায়, প্রথমেই খানিকটা পিছন থেকে শুরু করেছেন দেবশ্রী। প্রচারে তাঁর থেকে অনেকটাই এগিয়ে সিপিএমের বলিয়ে কইয়ে প্রার্থী সায়রা হালিম। তবে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের প্রার্থীর পক্ষে জেতার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি‌।

এ বার একবার যাদবপুর কেন্দ্র ঘুরে আসা যাক। যাদবপুর থেকে অতীতে কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেস/তৃণমূলের কৃষ্ণা বসু ও সিপিএমের মালিনী ভট্টাচার্য ছাড়া, পরপর কয়েক বছর একই প্রার্থীকে দাঁড় করায়নি কোনও দলই। এবারও সব দলের নতুন প্রার্থী। প্রার্থীরা কম বয়সেরও। যাদবপুরের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রে চক্কর কাটার শারীরিক সক্ষমতা তিনজনেরই রয়েছে। যাদবপুর কেন্দ্রের জয়পরাজয়ের ভারসাম্য অনেকটাই বজায় রাখে ভাঙড়। একটা কথা চালু আছে, ‘ভাঙড় যার, যাদবপুর তার’। তিন বছর আগেকার বিধানসভা এবং গত বছরের পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফোর্স বা আইএসএফ তৃণমূলের কাছে গলার কাঁটার মতো। এ বারের ভোটে আইএসএফ, কংগ্রেস ও সিপিএমের মধ্যে জোট হওয়ায় ভোট কাটাকাটির খেলায় ভাঙড় তাঁদের ‘লিড’ দেবে কি না, তা নিয়ে অঙ্ক কষা শুরু করেছেন সায়নী আর সৃজনের ইলেকশন এজেন্টরা। বিজেপির অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় ভাঙড়কে অন্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে ছেড়ে দিয়ে, ঘর গোছাচ্ছেন বাকি ছয় বিধানসভা এলাকায়। ভাঙড়ের ‘তাজা নেতা’ আরাবুল ইসলাম জেলে। ক্যানিংয়ের সওকত মোল্লা ডায়মন্ড হারবারের ‘ডিউটি’ সামলে, ভাঙড়ে কতটা সময় দিতে পারবেন, সেটাও বড় প্রশ্ন। তার উপরে নৌশাদ সিদ্দিকী। তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা চাইছেন, নৌশাদ ডায়মন্ড হারবারে দাঁড়িয়ে পড়ুন। তা হলে ভাঙড়ের আইএসএফয়ের ‘লড়াকু’ বাহিনী চলে যাবে অভিষেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সামালাতে।

প্রার্থীপদ ঘোষণা হওয়ার আগে, তিনি নিজের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।’ নবীন-প্রবীণের লড়াইয়ে, টিকিট পাওয়া নিয়েই সংশয় ছিল তিন বারের সাংসদ সৌগত রায়ের নিজেরই। নবীন-প্রবীণ লড়াইয়ের ফায়দা তুলতে সিপিএমের হয়ে দমদমে দাঁড়িয়েছেন সুজন। তবে বিজেপির প্রার্থীর নাম ঘোষণা হতেই স্পষ্ট হয়ে গেল,  সৌগত রায় সম্ভবত এবারেও দিল্লি যাচ্ছেন। ব্যারাকপুরের শীলভদ্র দত্তও পরিযায়ী বিজেপি প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন সৌগতের বিরুদ্ধে। সুজন বাইরের, শীলভদ্র বাইরের, সৌগত তবুও নিশ্চিত হতে পারছেন না। ছুটে বেড়াচ্ছেন গোটা কেন্দ্রে।

তৃণমূলের নবীন-প্রবীনের দ্বন্দ্বে প্রার্থীপদ তাঁরও এবার অনিশ্চিত ছিল। মতুয়া ভোটে সওয়ার হয়ে বিজেপির নৌকা তরতর করে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত কাকলির পাশে দাঁড়িয়েছে বিজেপি। এমন একজনকে তারা দাঁড় করিয়েছে,  যাঁর বিরুদ্ধে জেলার বিজেপি নেতারাই মাদক পাচারে যুক্ত থাকার অভিযোগে এনে, প্রার্থীর সমর্থনে প্রচার করবেন না বলে প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন।

তবে জোর লড়াইয়ের ‘আশঙ্কায়’  উদ্বেগে রয়েছে ব্যারাকপুর। তৃণমূল-বিজেপি-তৃণমূল হয়ে বিজেপিতে ফিরে, ব্যারাকপুর জয়ের হুহুংকার দিয়েছেন অর্জুন সিংহ। তাঁর লড়াই আবার আরেক অর্জুনের সঙ্গেই। তিনি রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। সাংসদ অর্জুন গত দেড় বছর তৃণমূল নেতা হিসেবে মন্ত্রী পার্থ তথা অর্জুনের ডেরায় বসেছিলেন, ওই শিবিরের আটঘাট বুঝে নিতে। পার্থও জানতেন, লোকসভার টিকিট না পেলে ছোবল মারতে পিছপা হবেন না অর্জুন। তাই ভাটপাড়ার অর্জুনের চোখের আড়ালে ঘর অনেকটাই গুছিয়ে রাখছিলেন নৈহাটির পার্থ ভৌমিক। ২০১৯ সালে কেউ ভাবেনি বিজেপির প্রার্থী অর্জুন সিংহ হারিয়ে দেবেন তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদীকে। পাঁচ বছর আগে অসাধ্যসাধন করলেও, এবারও কি দিল্লি যাওয়া সুনিশ্চিত করতে পারবেন অর্জুন?

যাঁর হাতে আমার রিপোর্টার হয়ে ওঠার শিক্ষা, তিনি বলতেন, ‘অন্য রিপোর্টিং স্ট্রেট ব্যাটে খেলতে হয়। রাজনৈতিক রিপোর্টিং বেশ জটিল। ঘুরিয়ে ভাবতে হয়।’ তাই রাজনৈতিক রিপোর্টিং আমার ভালো লাগত না। তবে করতে হত। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এবার কলকাতার সব থেকে জমাটি লড়াই হবে উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে। সেখানে তৃণমূলের লড়াইটা তৃণমূলের সঙ্গেই! সুদীপ লোকসভায় তৃণমূলের নেতা। তাই তাঁকে প্রার্থী করতেই হত। কেন জানি মনে হচ্ছে সুদীপের বিরুদ্ধে ফেসবুকে রীতিমতো গর্জে উঠে, ওই বর্ষীয়ান নেতার গ্রেপ্তারের দাবি তুললেও মুখপাত্র কুণাল ঘোষের তৃণমূলে থেকে যাওয়া, উত্তর কলকাতার তৃণমূলের রাজনীতিতে  সুদীপের কট্টর বিরোধী (পড়ুন কুণালের সহযোদ্ধা) তাপসের বিজেপিতে চলে যাওয়া, এবং সুদীপের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার চিত্রনাট্যটা বোধহয় আগেই লেখা ছিল। লড়াইটা তাপস-কুণাল বনাম সুদীপ-কুণাল হওয়ার দিকেই যে এগোচ্ছে, সেই গন্ধটা কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে। সুদীপকে বানপ্রস্থে পাঠানোর পরিকল্পনার আঁচ পাচ্ছেন সুদীপ-ঘনিষ্ঠ অনেকেই। নির্বাচনে লড়াই করে হেরে ‘সম্মানজনক বিদায়’ আর কি!

তৃণমূলের অন্দরের খবর, এই রকম ‘সম্মানজনক বিদায়’ প্যাকেজ তৈরি হয়েছে আরও এক নেতার জন্য। তিনি হাওড়ার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে কুণালের ভূমিকায় মুখ্যমন্ত্রীর ছোট ভাই স্বপন (বাবুন) বন্দ্যোপাধ্যায়। কুণালের মতোই তিনিও তৃণমূল প্রার্থীকে তাঁর কেন অপছন্দ তা জানিয়ে দিয়েছেন। এমনকি নির্দল হয়ে দাঁড়ানোর হুমকিও দিয়ে রেখেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু বাবুন দলীয় পদ এবং অন্য সব পদে রয়ে গিয়েছেন। আর বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গেলেও, হাওড়ায় প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক ভোলা চক্রবর্তীর পুত্র বিজেপি প্রার্থী রথীন চক্রবর্তীর ভোটব্যাংক  বাড়াতে সক্রিয় হয়েছে তৃণমূলের একাংশ।

খেলা কিন্তু জমে উঠেছে। মনে পড়ে যাচ্ছে, গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের সেই বাণী, ‘সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Siliguri | ভরসন্ধ্যায় চুরি মধ্য শান্তিনগরে, জানালার গ্রিল খুলে টাকা ও সোনা-গয়না নিয়ে চম্পট...

0
শিলিগুড়িঃ মঙ্গলবার সন্ধ্যে রাতে দু:সাহসিক চুরির ঘটনা ঘটলো আশিঘর ফাঁড়ির মধ্যশান্তিনগর এলাকায়। পুলিশ সূত্রে খবর, এদিন রাত সাড়ে সাতটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছে। বাড়িতে...

Cyclone Remal Prediction | ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ এর পথের কাঁটা মৌসুমী বায়ু! কী বলছে হাওয়া...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে যে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়েছে তা নিয়ে জোর চর্চা চলছে। যে ঘূর্ণিঝড়ের কথা বলা হচ্ছে তার নাম দেওয়া হয়েছে...

IPL-2024 | ব্যাটে-বলে নাস্তানাবুদ হায়দরাবাদ, ৮ উইকেটে জিতে আইপিএলের ফাইনালে কেকেআর

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ আমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে হাইভোল্টেজ ম্যাচে সানরাইজার্স হায়দরাবাদকে হেলায় হারিয়ে দিল কলকাতা নাইট রাইডার্স। এদিন প্রথমে ব্যাট করে সবকয়টি উইকেট...

Ramkrishna Mission | মিশনে হামলায় সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা! বিতর্কে পুলিশ

0
শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: শিলিগুড়ি রামকৃষ্ণ মিশনে হামলার ঘটনায় এবার মিশনের সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধেই পালটা মামলা দায়ের করল পুলিশ। হামলায় মূল অভিযুক্ত প্রদীপ রায়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে...

BJP | নাড্ডার নির্দেশ, রামকৃষ্ণ মিশনে হামলা নিয়ে জোর আন্দোলনে বিজেপি

0
শিলিগুড়ি: শিলিগুড়ির (Siliguri) সেবক রোডের রামকৃষ্ণ মিশনে (Ramkrishna mission) হামলার ঘটনায় শীঘ্রই আন্দোলনে নামছে বিজেপি (BJP)। এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জে...

Most Popular