- সুমন ভট্টাচার্য
আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা। ১৯৯৮ সালে যে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বলে একটি আলাদা দল গড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিলেন এবং কংগ্রেসকে চুরমার করে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাতটি লোকসভা আসন জিতেছিলেন, তার কিছুদিন পরে সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে আমার দেখা হয়েছিল।
অনিল স্বভাবত শান্ত এবং একটু ধীরে ধীরে কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। কারণ, অনিলদার বিশ্লেষণ ছিল, যেখানে মিডিয়ার প্রভাব সর্বাধিক ছিল, সেখানেই তৃণমূল সাফল্য পেয়েছে।
অনিল যে সময় আমায় এই বিশ্লেষণ শুনিয়েছিলেন, তখনও ইন্টারনেট, পোর্টাল বা ইউটিউব আসেনি। শুধুমাত্র খবরের কাগজ এবং কিছু দূরদর্শনভিত্তিক সংবাদের ওপর নির্ভর করেই তিনি এই বিশ্লেষণের কথা শুনিয়েছিলেন। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ যে রাজনীতির ভরকেন্দ্র এবং সেখানে যে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মমতা আত্মপ্রকাশ করে গেলেন, সেটা অনিলের বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
কাট টু ২০২১। যে নির্বাচনে মমতাকে হারাতে গেরুয়া শিবির শুধু কোমর বেঁধে নামেনি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে বিজেপির ‘চাণক্য’ অমিত শা রোজ পশ্চিমবঙ্গে ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জারি’ করতেন, সেই নির্বাচনের ঠিক আগে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে ন্যারেটিভ তৈরিতে অভ্যস্ত এবং গেরুয়া শিবিরের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত এক টেলিভিশন চ্যানেলের সান্ধ্য বিতর্কে আমাকে ডাকা হয়েছিল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যে, এবারও কি কলকাতায় বিজেপি খাতা খুলতে পারবে, না পারবে না?
অন্য সবাইয়ের মতামতকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম যে, কলকাতা শহর এখনও বিজেপির কাছে অধরা। সবাই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু ফল বেরোনোর পর আমার কথাই সত্যি হয়েছিল। শুধু কলকাতা নয়, কলকাতার আশপাশে বিজেপির যেসব হেভিওয়েটরা প্রার্থী হয়েছিলেন, যেমন তারকেশ্বরের মতো একটি বিখ্যাত বিধানসভা কেন্দ্রে স্বপন দাশগুপ্তর মতো সাংবাদিক বা রাসবিহারী কেন্দ্রে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুব্রত সাহা- তাঁরা সবাই পরাজিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ কলকাতা এবং গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ২০২১ সালেও তৃণমূলের পক্ষেই রায় দিয়েছিল।
কেন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এত শক্তিশালী? কেন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ফলাফলের পাল্লাই ২০২১-এ তৃণমূলের ক্ষমতায় ফেরাকে নিশ্চিত করে দিয়েছিল? বা আরেকটু পরিষ্কার করে বলতে গেলে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া এবং হুগলিতে ১৬টি আসনের মধ্যে ১৩টি জিতে তৃণমূল নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে এবং আধিপত্যকেও ধরে রাখতে পেরেছিল। আসলে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা, হাওড়া, হুগলির এই মননকে বুঝতে পারলে তৃণমূলের রাজনৈতিক সাফল্য বা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভরবিন্যাস কীভাবে ঝুঁকে থাকে তা বোঝা সম্ভব হবে। একথা তো অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই যে, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা মিলিয়ে বিধানসভার যে ৬৫টি আসন রয়েছে অর্থাৎ অবিভক্ত ২৪ পরগনায় যে ৬৫টি আসন ছিল, তা-ই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করে দেয়। লোকসভার নিরিখে দেখতে গেলে দুই ২৪ পরগনা মিলিয়ে যে ৯টি আসন তাই গুরুত্বপূর্ণ এবং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কলকাতার আশপাশের এই ১৬টি আসনের মধ্যে বিজেপি মাত্র ৩টি জিততে পেরেছিল। হুগলিতে ১টি, উত্তর ২৪ পরগনায় ২টি।
দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি আর যদি একটু তার বাইরে নদিয়ার কথা ধরেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে তৃণমূল কেন এখনও দক্ষিণবঙ্গে এত শক্তিশালী। একথা তো অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই যে, জনসংখ্যার নিরিখ, যাকে রাজনৈতিক পরিসংখ্যানে বলা যায় ‘নিউমেরিকাল অ্যাডভান্টেজ’ বা সংখ্যাতত্ত্বের সুবিধা, তাই দুই ২৪ পরগনাকে আলাদা রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়েছে। অনিল বিশ্বাস ১৯৯৮ সালেই যেটা ধরতে পেরেছিলেন যে, এই দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলিতে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তৃণমূল আত্মপ্রকাশ করে গিয়েছে, সেটা তৃণমূলের জন্মের ২৫ বছর কেটে যাওয়ার পরেও সত্যি এবং সেই কারণেই এখনও এইসব অঞ্চলে তৃণমূল দাপট দেখাতে পারে।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বা বিজেপির আরও কিছু কিছু তাত্ত্বিক নেতা যে কথা প্রচার করার চেষ্টা করেন যে, মমতা বা তৃণমূল কংগ্রেস মূলত সংখ্যালঘু অর্থাৎ মুসলিমদের ভোটে জেতেন, তা কিন্তু এই গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের ডেমোগ্রাফি বা জনসংখ্যাকে বিশ্লেষণ করলে ভুল প্রমাণিত হবে। অর্থাৎ যদি কেউ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন দেখেন, তাহলে হাওড়া, হুগলি এবং উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ যে অঞ্চলে তৃণমূল সাফল্য পেয়েছিল তা তো শুধুমাত্র মুসলিমদের সমর্থনে সম্ভব ছিল না। উত্তর ২৪ পরগনায় ৩৩টির মধ্যে ২৭টি আসনই তৃণমূল জিতেছিল এবং এমনও অনেক আসন জিতেছিল যেখানে মুসলিম ভোটের সংখ্যা নামমাত্র। ভাটপাড়া, জগদ্দল, খড়দহ কিংবা কামারহাটি জেতার জন্য মুসলিম ভোট শুধুমাত্র নির্ণায়ক হতে পারে না।
আমাদের বুঝতে হবে যে, শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালি, আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে হিন্দু বাঙালিও তৃণমূলকে সমর্থন করেছিল।
অর্থাৎ যদি বিধানসভার আসনগুলিকে লোকসভার ভোটে পরিবর্তিত করি, তাহলে এই ২০২৪-এর মহাগুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রশ্ন উঠবে যে, উত্তর এবং দক্ষিণ কলকাতা, হাওড়া, উলুবেড়িয়া, হুগলির তিনটি আসন- হুগলি, শ্রীরামপুর, আরামবাগ, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৯টি আসনে কারা এগিয়ে! একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এখানেই তৃণমূলের শক্তি সবচেয়ে বেশি। গতবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই ১৬টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩টি জিতেছিল। এবার অবশ্য গেরুয়া শিবির মনে করে তারা মথুরাপুর, দমদম এবং যাদবপুরেও শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তারা কি এইসব আসনে এবার বাজিমাত করতে পারবে, না আগের মতোই কলকাতা আর তার চারপাশে ‘মমতা ম্যাজিক’ কাজ করবে?
২০১৯-এর লোকসভার শেষ দফা নির্বাচনের ঠিক আগে, কলকাতা শহরে অমিত শা’র রোড শো-এর সময় কলেজ স্ট্রিটে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা পড়ে। সেই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর অনেক দূর যায়। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পরে যে ক’টি আসনে ভোট হয়েছিল, সেই ৯টিতেই তৃণমূল জিতেছিল। আরএসএসের এক শীর্ষনেতা আমাকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনা গোটা নির্বাচনের প্রেক্ষিতটাকেই বদলে দিয়েছিল। শিক্ষিত, শহুরে বাঙালি বিজেপিকে আবার ‘বাংলা বিরোধী’ বা ‘বাঙালি সংস্কৃতির পরিপন্থী’ বলে ভাবতে শুরু করেছিল।
দমদমের মতো কেন্দ্রে বিজেপির সুবক্তা শমীক ভট্টাচার্য তৃণমূলের প্রবীণ নেতা সৌগত রায়ের কাছে ৫৪ হাজার ভোটে হেরে যান। অন্য সব লোকসভা কেন্দ্রে যেখানে ‘বামেদের ভোট রামে’ গিয়ে তৃণমূলের ভরাডুবিকে নিশ্চিত করেছিল, সেখানে দমদম কেন্দ্রে বামেদের প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য যথেষ্ট ভোট কেটে নিয়ে শমীক ভট্টাচার্যের পরাজয়কে নিশ্চিত করেন। কেন এটা হয়েছিল? অনেকেরই ব্যাখ্যা, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা এবং তাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে যে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, তা বাঙালিকে আবার বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছিল।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফায় যদি বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা প্রভাব ফেলে থাকে এবং বিজেপির আইটি সেলের শত চেষ্টাও যদি বাঙালি মনকে ঘোরাতে না পেরে থাকে, তাহলে এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর প্রধানতম অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সঞ্জীব সান্যালের বাঙালিকে মৃণাল সেন তুলে খোঁচা এবং তাঁদের নেশা করার প্রবৃত্তি নিয়ে আক্রমণ কি মোড় ঘোরানো হতে পারে? তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ এবং প্রাক্তন আমলা জহর সরকার টুইট করে সেকথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি আবার বিজেপিকে ‘বাঙালি বিদ্বেষী’ বা বাঙালির মনন এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধ মতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি রাজনৈতিক দল বলে দেগে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু একথা অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই, সঞ্জীবের মন্তব্য আলিপুরদুয়ার বা কোচবিহারের নির্বাচনে যতটা না প্রভাব ফেলবে, তার থেকে অনেক বেশি তা নিয়ে কলকাতা, হাওড়া, হুগলির বিভিন্ন চায়ের দোকানে আলোচনা হবে এবং সেখানে হয়তো সঞ্জীবের পাশাপাশি বিচারপতি থেকে বিজেপির প্রার্থী হয়ে যাওয়া অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্রমাগত বিতর্কিত সব মন্তব্য বাঙালিকে বিজেপির সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলতে পারে।
উত্তরবঙ্গে তৃণমূলকে প্রায় মুছে দেওয়া বিজেপি তাহলে কি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে অর্থাৎ কলকাতা, হাওড়া, হুগলিতে আবার আটকে যেতে পারে? সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে দেখলে উত্তরবঙ্গে যদি আটটি আসন থাকে, তাহলে শুধুমাত্র কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলিতে ১৬টি আসন রয়েছে। এবার বিজেপি আশাবাদী এই ১৬টি আসনের মধ্যে অন্তত ৬টিতে তারা জিতবে। কিন্তু বিজেপির বাড়া ভাতে কি ছাই দিতে পারে ফের বাঙালি অস্মিতা বা বাঙালির নিজস্ব আত্মঅধিকারের বাসনা? অর্থাৎ বাঙালি হিসেবে আমরা যা যা নিয়ে গর্ববোধ করি, আমাদের খাদ্যাভ্যাস, আমাদের সংস্কৃতি চর্চা, আমাদের কবিতা, আমাদের গ্রুপ থিয়েটার কিংবা আমাদের মৃণাল সেন-সত্যজিৎ নিয়ে গেরুয়া শিবিরের খোঁচাই কি আবার তৃণমূলের হাতকে শক্ত বা ‘মমতা ম্যাজিক’কে সফল করে দিতে পারে? এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলকে অনেকটাই অ্যাডভান্টেজ দিতে পারে গেরুয়া শিবিরের এইসব আচমকা আক্রমণ। দুটি কারণে। বিচারপতি থেকে রাজনীতিক হওয়া অভিজিতের সমস্ত বিতর্কিত মন্তব্য এবং দিল্লিবাসী প্রবাসী বাঙালিদের আচমকাই এই বঙ্গের বাঙালিকে খোঁচা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা।
(লেখক সাংবাদিক)