- দেবদূত ঘোষঠাকুর
কর্মসূত্রে এখন আমাকে রোজ কলকাতা থেকে হরিণঘাটা যেতে হয়। আমডাঙ্গা পেরিয়ে আওয়াল সিদ্ধির আগে সাধনপুরে রাস্তার বাম দিকে একটি বড় হাইস্কুল। ভোটের সময় সেখানে ভোটগণনা হয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় দেখেছি ওই স্কুলের আশপাশ কড়া নিরাপত্তায় মোড়া। স্কুলের ধারেকাছে পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ পৌঁছাতে পারেন না। স্কুলটি বন্দুকধারী পুলিশের ঘেরাটোপে।
এবার গত কয়েকদিন ধরে দেখলাম ওই স্কুলের বাইরে বন্দুকধারী পুলিশ। গোটা এলাকা শুনসান। প্রথম দিন অবাক হয়েছিলাম। কারণটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। দ্বিতীয় দিনেও একই দৃশ্য দেখে একটু অবাক হলাম। পরে শুনলাম, ওখানে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়েছে বলে এমন নিরাপত্তার বহর। আমরা যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম, সেখানে বন্দুকধারী ছিল না কেউ। কিন্তু বছর দশ-বারো দেখছি পরীক্ষাকেন্দ্রও পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। জাল ভোটারের মতো জাল পরীক্ষার্থী নয়। পুলিশের চিন্তা পরীক্ষায় আসাধু উপায় রোখা যাবে কি না তা নিয়ে।
আমাদের রাজ্যে পরীক্ষা ব্যবস্থায় টোকাটুকি বা নকল করাটা নতুন কোনও রোগ নয়। আমরা তখন কলেজে পড়ি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরীক্ষার সময় বই খুলে টোকাটুকির নানা গল্প শুনতাম। ওই সময় রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের অনেকের নামই ওই গণটোকাটুকির সঙ্গে জড়িয়েছিল। পরবর্তী জমানায় পরীক্ষার এই চৌর্যবৃত্তি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও, জমানার শেষ দিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে, প্রশ্নপত্রের প্রতিলিপি পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার নতুন খেলা শুরু হয়।
দেখেছি, পরীক্ষার সময়ে ফোটোকপি করার দোকান বন্ধ করে দেওয়া শুধু নয়, নজরদারি বাড়ানো হতে থাকে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলিতে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে আমরা মালদা, মুর্শিদাবাদের সংবাদদাতা ও চিত্র সাংবাদিকদের সতর্ক করে দিতাম। পরীক্ষার হল থেকে প্রশ্নপত্র বের করে এনে, তার উত্তর লিখিয়ে প্রতিলিপি পরীক্ষা হলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ওই জেলাগুলিতে নির্দিষ্ট গ্যাং থাকত। পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে ওই গ্যাংয়ের সদস্যরা পৌঁছে যেত পরীক্ষাকেন্দ্রের কার্নিশে। জানালার কাছে। কাঁদানে গ্যাসের শেল পাঠিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ওইসব অসৎ উপায় যারা পরিচালনা করত, তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে আমি শুনিনি। আর যদি হয়েও থাকে তাহলে সেটা আমার অজ্ঞতা।
কোনও বিষয়ে চৌর্যবৃত্তি যারা করে, তারা সামাজিক ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে সিদ্ধহস্ত। পরীক্ষায় অসৎ পন্থা অবলম্বন যারা করে তাদেরও জলের অভাব হয়নি। বিশেষ করে কোভিড পরবর্তী যুগে মোবাইল নির্ভরতার সুযোগ নিতে সময় নষ্ট করেনি ওই পরীক্ষা-দুর্বৃত্তরা। আর সহজে কাজ উদ্ধার করার প্রক্রিয়ায় তারা সঙ্গে পেয়ে গিয়েছে একদল ছাত্রছাত্রী, এমনকি তাদের অভিভাবকদেরও।
গত দশকে পড়ানোর সঙ্গে পাকাপাকিভাবে জড়িয়ে পড়ার সময়েও দেখেছি ছেলেমেয়েরা ক্লাস ঠিকমতো করছে কি না তার নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন অভিভাবকরা। একেবারে ফোন করতেন শিক্ষকদের। এক বাবাকে দেখেছি সারপ্রাইজ ভিজিট দিতে। কলকাতা শহরের এক নামকরা কলেজের কথা। পরীক্ষার আগে অভিভাবক কলেজে এসে পরীক্ষার রুটিন লিখে নিয়ে যাচ্ছেন এমনও দেখেছি।
কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকায় দেখেছি ছেলেমেয়েরা শিয়ালদা থেকে ট্রেনে কলেজে যাওয়ার জন্য উঠছে বটে, কিন্তু কলেজেই পৌঁছাচ্ছে না। ঠিক সময়ে আবার বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। অভিভাবকরা কিছুই জানেন না। আমি ট্রেনে ওই ছাত্রছাত্রীদের দেখেছিলাম। কিন্তু কলেজে দেখিনি। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওরা কেউই ক্লাস করেনি। মাঝেমধ্যেই করে না।
আমাদের সময়ে আমাদের অভিভাবকরা প্রায় প্রতিদিনই জানতে চাইতেন কলেজে আজ কী হল। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ে আমার তো একবার গার্ডিয়ান’স কল হয়েছিল। অনেক জায়গাতে ছাত্রছাত্রীদের হাজিরার সঙ্গে পরীক্ষা দিতে পারা আর না পারার সম্পর্ক নেই। যেখানে আছে, সেখানে আবার জরিমানা দিলে একদিনও ক্লাস না করলেও জরিমানা দিয়ে পরীক্ষায় বসা যায়। অভিভাবকরা জরিমানা দিয়ে দেন অবলীলায়। সেই টাকাটা অনেকের গায়েই লাগে না। ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে একটি মামলায় এক বিচারককে বলতে শুনেছিলাম, ‘জরিমানা যে একটা শাস্তি তা এখন বোঝাই যায় না। লোকে হাসতে হাসতে জরিমানা দিয়ে দেয়। শাস্তি গায়েই মাখে না।’ এখনকার অভিভাবকরা অনেকে যে নিজেদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটুকুও চিন্তিত নন তা ধরা পড়েছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময়েই। উত্তরবঙ্গের একাধিক স্কুলে পরীক্ষার্থী না আসায় শেষপর্যন্ত তাকে খুঁজতে বাড়িতে লোক পাঠানো হয়। দেখা যায় ওই দিন ওই পরীক্ষার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল ছেলেটি। আর অভিভাবকরাও জানেন না কোন পরীক্ষা কবে। শহরাঞ্চলে অবশ্য অভিভাবকরা অন্তত উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। এমন এমন কিছু মা-কে জানি যাঁরা নার্সারি থেকে স্কুল জীবন শেষ হওয়া পর্যন্ত রোজ ছেলে বা মেয়েকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন এবং স্কুল ফেরত কোচিং ক্লাস ঘুরে রাতে ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সেটা যেমন একটা চিত্র, তেমনই আরেকটি চিত্র উত্তরবঙ্গের ওই পরীক্ষা দিতে আসতে ভুলে যাওয়া পড়ুয়া ও তার অভিভাবক। একটি অতিরিক্ত সজাগ থাকা। অন্যটি চরম উদাসীনতা। দুটোই উদ্বেগের।
যেখান থেকে লেখাটা শুরু করেছিলাম সেখান থেকে এক পাক ঘুরে আসি। কোভিডকালে পড়াশোনার ধরনধারণের যে পরিবর্তন হয়েছে, তার সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে পড়াশোনার উপরে। আর এই পরিবর্তনটা বেশি করে চোখে পড়েছে পরীক্ষার সময়ে। মোবাইলের মাধ্যমে টোকাটুকি যে হবেই তা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অতিরিক্ত মোবাইল নির্ভরতা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছিল পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থাগুলি। এই ‘অপরাধ’ রুখতে সিসিটিভির নজরদারির পাশাপাশি পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে মোতায়েন করা হয়েছিল সশস্ত্র পুলিশ। কিন্তু সেই শ্যেন নজর কীভাবে এড়ানো যায় সেই প্রযুক্তি যে কেউ উদ্ভাবন করে ফেলবে, আর পরীক্ষার্থীর হাতে সেই মোবাইল পৌঁছে দেবে, তার আঁচ কেউ পাননি।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পর্ব মিটতে যে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে তা অতি উদ্বেগের। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ জানিয়েছে, পরীক্ষা হলে মোবাইল ফোন নিয়ে ঢোকায় ৪১ জন পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৫ জন ছাত্রী, ১৬ জন ছাত্র। এর পিছনে নকল-চক্র কাজ করছে এবং স্কুলগুলিতে নজরদারির কাজে যুক্ত শিক্ষাকর্মীদের কারও কারও মদত রয়েছে বলে ধারণা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের। ছাত্রীদের তল্লাশি কম বলে তাদেরই মাধ্যমে বেশি নকল হয়েছে বলে মনে করছেন এক সংসদকর্তা।
পরীক্ষার হলে মোবাইল কেন নিয়ে গিয়েছিল ছাত্রছাত্রীরা? অঙ্ক পরীক্ষার দিনে দুজন ছাত্রীকে স্মার্টফোন সহ ধরা হয়েছিল পরীক্ষা চলাকালীন। অঙ্ক কষতে ওই ছাত্রীরা মোবাইল ব্যবহার করছিল। বাকি ৩৯টি ক্ষেত্রে মোবাইল নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে তা মোবাইল সহ বাইরে পাচার করা। সব দেখেশুনে এক শিক্ষাবিদের মন্তব্য, ‘জেল আর পরীক্ষাকেন্দ্রে মোবাইল পাচারের গল্পটা দেখা যাচ্ছে একই। জেলের বা পরীক্ষাকেন্দ্রের নজরদারির কাজে থাকা কারও মাধ্যমেই মোবাইলের এই যাওয়া আসা।’ জেলের ক্ষেত্রে বন্দিরা উপকৃত হয়। পরীক্ষাকেন্দ্রের ক্ষেত্রে উপকৃত হয় নকলচক্র। পরীক্ষার্থীরা এ ক্ষেত্রে বলির পাঁঠা। আর শাস্তি পাচ্ছে কেবল তারাই। আর এই ধরনের ঘটনাগুলি বেশি ঘটেছে পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদা, দুই দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে।
পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থাগুলি কিন্তু এর দায় অস্বীকার করতে পারে না। তা সে এ রাজ্যের বা কেন্দ্রীয় সরকারেরই বা হোক না কেন। পাঠ্যসূচি তৈরি থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফল প্রকাশ সব ক্ষেত্রেই তাদের গয়ংগচ্ছ মনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। শিক্ষার গ্রাফ নামছে নীচের দিকে।
(লেখক সাংবাদিক)