- আশিস ঘোষ
চৈত্র মাসে ছোট-বড় সব দোকানেই লাগে চৈত্রের সেল। ঢালাও ছাড় দামে। আর ভোট এলেই বসে নেতাদের দলবদলের বাজার। কে যে কোথায় যাচ্ছে তা মাথায় রাখতে হিমসিম খেতে হয়। কেন যাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা অবশ্য পরিষ্কার। সবাই বলছে, অমৃতকালে বিরোধী দল ছেড়ে মোদির নেতৃত্বে তারা দেশকে জোরকদমে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
এবার আর কোনও রাখঢাক নয়। চক্ষুলজ্জার কোনও বালাই নেই। আদর্শের কোনও তাড়না নেই। ভোটের বাজারে খুল্লম খুল্লা নেমে পড়েছেন পদ্ম নেতারা। বিজেপির নেতারাই জানিয়েছেন, ভোটের আগে একটা যোগদান টিম তৈরি করা হয়েছে। তার এখানকার কনভেনার শুভেন্দু অধিকারী। তিনি ছাড়া চারজন সদস্য আছেন। যার কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তাঁদের একটাই লক্ষ্য, বাংলা থেকে লোকসভা ভোটে ৩৫টা আসনের যে টার্গেট দিয়েছেন অমিত শা তা পূরণ করা। বলাবাহুল্য, যিনি কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক তিনি এবং কনভেনার দুজনেই দলবদলু। একজন কংগ্রেস ছেড়ে পদ্ম শিবিরে এসেছেন ২০১৫ সালে। অন্যজন ২০২১ সালে তৃণমূল থেকে।
রীতিমতো লিস্ট হাতে ভোটের সওদা। যার যেমন বাজারদর তাকে তেমনই পুরস্কার। দুর্জনেরা অবশ্য বলে নগদ লাভের কথাও। সে যা হোক, এই কেনাকাটার প্রধান লক্ষ্য শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেস দল। সব রাজ্যে প্রথম টার্গেটই হল হাতের ছোট-বড় নেতারা। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কোনও জায়গা বাদ নেই। বেছে বেছে নেতাদের কেনাবেচা সবার চোখের সামনেই চলছে। ন্যায়নীতি আদর্শের কোনও বালাই নেই কোনও পক্ষেরই। যাঁরা কংগ্রেস থেকে নাচতে নাচতে বিজেপিতে যাচ্ছেন নৈতিকতার বালাই নেই তাঁদেরও। এই বিজেপির বিরুদ্ধে ভাষণ দিয়েই গত ভোটে জিতেছিলেন তাঁরা। রাজনীতি এখন একটা ব্যবসামাত্র, রুটিরুজির সংস্থান।
এই যেমন মহারাষ্ট্রে আদর্শ হাউজিং সোসাইটির কেলেঙ্কারি নিয়ে সেদিনও আকাশ বাতাস কাঁপাচ্ছিল বিজেপি। দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে। এখন সেই কেলেঙ্কারির নায়ক অশোক চ্যবন দল পালটে চলে এসেছেন বিজেপিতে। কোনও সন্দেহ নেই অজিত পাওয়ারের মতো তিনিও বিজেপির ওয়াশিং মেশিনে ধবধবে সাদা হয়ে বেরিয়ে আসবেন। কোথায় নীতি, কোথায় আদর্শ! যে কোনও মূল্যে গদি চাই। চারশো আসন চাই। তাই সবার আগে নড়বড়ে কংগ্রেসকে ভিতর থেকে ফোঁপরা করে দাও। মহারাষ্ট্রে লাইনে আছেন বাসবরাজ পাতিলও। তিনি কংগ্রেসের ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট।
কোনও রাজ্যে স্বস্তিতে নেই কংগ্রেস। অসমের কংগ্রেসের খোদ প্রাক্তন ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট রানা গোস্বামী দল বদলেছেন। দল ছেড়েছেন দুই এমএলএ শশীকান্ত দাস আর সিদ্দিক আহমেদ। দলত্যাগী আরেক নেতা বিপিন বোরাও। ওডিশায় বিজু জনতা দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পদ্ম খাতায় নাম তুলেছেন চিলিকার এমপি প্রশান্ত জগদেব। রাজস্থানের জাঁদরেল কংগ্রেস আদিবাসী নেতা মহেন্দ্রজিৎ মালবিয়া বিজেপিতে। তেলেঙ্গনায় চন্দ্রশেখর রাওয়ের দল বিআরএস ছেড়েছেন নগর কার্নুলের এমপি পথুগুড্ডি রামুলু। তাঁর সুপুত্র ভরত প্রসাদকে নিয়ে তিনি এখন পদ্ম শিবিরে। শোনা যাচ্ছে এবারের কমল ছাপ এমপি টিকিট তাঁর বাঁধা। সদ্য তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন আরেক বিআরএসের এমপি বিবি পাতিল।
উত্তরে ফারুক আবদুল্লার দল ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন মহম্মদ রফিক, সঞ্জীব খাজুরিয়া। দক্ষিণে তামিলনাডুর তিনবারের বিধায়ক বিজয়াধরণী বিজেপিতে গিয়েছেন কংগ্রেস থেকে। অবস্থা এমন, হিমাচলে রাজ্যসভায় নিশ্চিত জেতা আসন খুইয়েছে কংগ্রেস। সেখানে প্রকাশ্যে ক্রস ভোটিং করেছেন তাদের আধ ডজন এমএলএ। এরই পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশে দলকে প্রায় ঘোল খাইয়ে দিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ। তিনি বিজেপিতে যাচ্ছেন কি না সেই উদ্বেগে রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল হাইকমান্ডের। অবশেষে বাড়ির ছাদ থেকে গেরুয়া পতাকা নামিয়ে আপাতত দলকে নিশ্চিন্ত করেছেন ‘ইন্দিরার তৃতীয় পুত্র’ বলে পরিচিত কমল নাথ।
লোকসভা ভোটে ফের ট্র্যাপিজের খেলা এই বাংলাতেও। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন কালিয়াগঞ্জের এমএলএ সৌমেন রায়, কংগ্রেসের কৌস্তভ বাগচী। আরও কেউ কেউ যেতে পারেন বলে আগাম জানিয়েছেন শুভেন্দু। তাপস রায় যে তাপস রায়, তাঁর নামও বাজারে ঘুরছে। দিনের পর দিন মাটিতে লেগে থেকে সংগঠন মজবুত করে দিল্লি যাওয়ার কঠিন কষ্টসাধ্য রাস্তা এড়িয়ে শর্টকাট রাস্তাই বেছে নিয়েছে পদ্ম নেতৃত্ব। নানারকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূল ভাঙিয়ে নিয়েছিল বিজেপি। যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁদের বেশিরভাগই ফিরে এসেছেন পুরোনো দলে। এই দলবদলের বাজার প্রথমে খুলেছিল তৃণমূল। তাদেরই দেখানো পথে হাঁটছে পদ্ম শিবির। জোড়া ফুল থেকে একটা ফুলে।
কংগ্রেসের ঘর বেশ কিছুদিন ধরে খালি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে দল ছাড়া নেতাদের লিস্টটা বেশ বড়। যাঁরা কংগ্রেস ছেড়েছেন তাঁদের অনেকেই বেশ হেভিওয়েট। নামজাদা। কংগ্রেসের মুম্বইয়ের নেতা মিলিন্দ দেওড়া, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, কপিল সিবাল, গুলাম নবি আজাদ, হার্দিক প্যাটেল, একে অ্যান্টনির ছেলে অনিল, অশ্বিনী কুমার, আরপি এন সিং, অল্পেশ ঠাকোর, জিতিন প্রসাদ।
কর্ণাটক, হিমাচলে জয়ের পর রাজনীতিতে যে গতি পেয়েছিল তা ক্রমে হারিয়েছে কংগ্রেস। তখন ধ্যানজ্ঞান ছিল চার রাজ্যের ভোটে। তাই তারা মাসের পর মাস অবহেলা করেছে জোট তৈরি করার কাজ। এক তেলেঙ্গনা ছাড়া রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়ে হার হয়েছে তাদের। এই রাজ্যগুলো পকেটে পুরে বাকি শরিকদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর যে আশা তাদের ছিল তাতে জল ঢেলে দিয়েছে ভোটের ফল। তার নিট ফল হল জোট ছেড়ে নীতীশ কুমারের মোদির হাত ধরা। জোট ছেড়ে মমতার বেরিয়ে আসা। রাষ্ট্রীয় লোকদলের পালটি।
তবে এরই মধ্যে অখিলেশ আর কেজরিওয়ালের সঙ্গে বোঝাপড়া, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্রে জোট খানিকটা ভরসা জোগাচ্ছে হাতের সমর্থকদের। বসে নেই বিজেপিও। ভোটের দিন ঘোষণার ঢের আগে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে তারা কংগ্রেসের স্নায়ুর চাপ শুরুতেই বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথম রাউন্ডে বেশ কিছুটা পিছিয়ে থেকে দৌড় শুরু করতে হচ্ছে কংগ্রেস এবং এখনও অবশিষ্ট থাকা ইন্ডিয়া জোটকে।