- বিপ্লব দাশগুপ্ত
একটা সময়ে কলকাতাকে বলা হত ভারতীয় ফুটবলের ‘মক্কা’। কলকাতায় খেলতে না পারলে ফুটবল জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে মনে করতেন জাতীয় দলে খেলা সত্ত্বেও ভিনরাজ্যের ফুটবলাররা। সেই কারণে তাঁরা অনেকেই ছুটে এসেছেন এই ফুটবল শহরে। কিন্তু এখন সেই চিত্রটা বদলে গিয়েছে৷ বাংলার ফুটবলাররা এখন গোয়া, বেঙ্গালুরু, মুম্বই এবং চেন্নাই পাড়ি দিচ্ছেন।
কেন বাংলা থেকে ফুটবলাররা ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছেন তার অনুসন্ধানে না গিয়েও এক কথায় বলতে পারি তা হল, বাংলার ফুটবলের জৌলুস এখন আর আগের মতো নেই।
এখনকার মতো সুযোগসুবিধা, পরিকাঠামো না থাকা সত্ত্বেও অতীতে এই বাংলা থেকে বছরের পর বছর ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটবলার উঠে এসেছে। তখন চিত্রটা ছিল এরকম, কৈশোর থেকেই ফুটবলের আকর্ষণে ছেলেরা মাঠে ছুটে আসত। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পরে তাদের ঠিকানা ছিল ফুটবল মাঠ। তাদের তত্ত্বাবধানে এমন কয়েকজন ফুটবল অন্তঃপ্রাণ মানুষ ছিলেন যাঁরা ফুটবলার গড়ার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। স্যর দুখীরাম মজুমদারের সম্পর্কে আপনারা অনেকেই জানেন। তাঁর সময়ের পঞ্চাশ বছর পরে যাঁরা ফুটবলার গড়ার স্বপ্নে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন তাঁদের কয়েকজনের কথা এখানে তুলে ধরছি।
যেমন সাদার্ন স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের খোকন বসু মল্লিক। ঘরসংসার ছিল না। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের নীচে সাদার্ন স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের ঘরে থাকতেন। স্টেডিয়ামের বাইরের মাঠে ফুটবলারদের অনুশীলন করাতেন। তাঁদের টিফিন, খেলার সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতেন। অসুখ-বিসুখের সময়ে পাশে থাকতেন। তাঁদের কলকাতার ক্লাবে খেলার সুযোগ করে দিতেন। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন ফুটবলারদের অভিভাবক। ফুটবলাররা তাঁর উপর ভরসা রাখতেন। সত্তর দশকে খোকন বসু মল্লিকের ক্যাম্প থেকে উঠে এসেছেন নিমাই গোস্বামী, কম্পটন দত্ত, শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তি সাহা, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, বাসুদেব মণ্ডলের মতো এহেন বহু ভারতখ্যাত ফুটবলার।
খোকন বসু মল্লিকের আগে যাঁর নাম বলতে হবে তিনি টালা পাইকপাড়া যুগের যাত্রী ক্লাবের নিশীথ বিশ্বাস। তাঁর ক্যাম্পের প্র্যাকটিস হত টালা পার্কে। সাইকেলে চেপে উত্তর কলকাতার অলিতে-গলিতে ফুটবলারের সন্ধানে চষে বেড়াতেন। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছেন এশিয়া খ্যাত ফুটবলার সুধীর কর্মকার। আরও বেশ কয়েকজনের নাম বলতে হবে। যেমন মীর্জাপুর ইউনিয়নের মতিয়ার রহমান, হৃষীকেশ পার্কের এসি চট্টোপাধ্যায়, চাঁপাতলা ব্যায়াম সমিতির মনোরঞ্জন দে (মনাদা)। তাঁরা সকলেই ছিলেন ফুটবলে নিবেদিত মানুষ। যে অর্থ রোজগার করতেন তার সিংহভাগটাই ফুটবলের পিছনে ব্যয় করতেন। ফুটবল মাঠই ছিল তাঁদের ঘরবাড়ি। ফুটবলারদের নিয়েই ছিল তাঁদের ঘরসংসার।
এতগুলো কথা বলার কারণ হল, এরকম ফুটবলে নিবেদিত মানুষ এখন আর নেই। সেই কারণে এখনকার ছেলেরা ফুটবল খেলতে আগ্রহী হচ্ছে না।
আরেকটি দিক হল, আন্ডার হাইট টুর্নামেন্ট। ‘আন্ডার হাইট’ (৪ ফুট ৮/১০ ইঞ্চি) ফুটবল টুর্নামেন্ট তখন কলকাতা, শহরতলি, জেলার মাঠে প্রচুর অনুষ্ঠিত হত। দেশপ্রিয় পার্কে চক্রবেড়িয়া ইয়ং সার্কেল আয়োজিত ফুটবল টুর্নামেন্ট, শিয়ালদায় কাশিমবাজার টুর্নামেন্ট, শ্যামবাজারে লীলাবতী টুর্নামেন্ট। দমদম, গোরাবাজার, সিঁথি, বেলঘরিয়া, হুগলি জেলার ভদ্রেশ্বরে এরকম অনেক ফুটবল টুর্নামেন্ট হত। চক্রবেড়িয়া ইয়ং সার্কেল টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হত নৈশালোকে। ছোটবেলায় এই ধরনের টুর্নামেন্টে খেলার সুবাদে খুদে ফুটবলাররা আকৃষ্ট হত এই খেলাতে।
আন্ডার হাইটের পরেই স্কুল ফুটবলে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেতেন ফুটবলাররা। ১৯৬১ সালে তৎকালীন এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পরে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে শুরু হয় সুব্রত কাপ স্কুল ফুটবল। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাছাই করে সেরা স্কুল দলগুলিকে নিয়ে শুরু হয় এই সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতা। সেনাবাহিনী পরিচালিত এই স্কুল প্রতিযোগিতাকে বলা হয় ‘লিটল ডুরান্ড কাপ’। ১৯৬২ সালে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে শুরু হয়েছিল এই প্রতিযোগিতা। প্রথম বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ধর্মতলার রানী রাসমণি হাইস্কুল। রানী রাসমণি স্কুল দলের ফুটবলার ছিলেন ১৯৭২ সালে কলকাতা লিগের বর্ষসেরা ফুটবলার মোহন সিং। ১৯৬৩ সালে রানী রাসমণি স্কুলকে ফাইনালে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাটানগর হাইস্কুল। ফাইনাল ম্যাচ এতটাই উচ্চমানের হয়েছিল যা দেখে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন মাঠে উপস্থিত দর্শকরা। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাইকপাড়া কুমার আশুতোষ ইনস্টিটিউশন। সেই দলের অপরিহার্য সদস্য ছিলেন ভারত ও এশিয়ার সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার সুধীর কর্মকার। ১৯৭৬ সালে ফাইনালে কুমার আশুতোষ ইনস্টিটিউটকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আগরপাড়া নেতাজি শিক্ষায়তন। সেই দলে খেলেছিলেন খ্যাতনামা ফুটবলার-কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য। পরবর্তীতে নাগাড়ে তিন বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মধ্যমগ্রাম হাইস্কুল। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্কুল ফুটবল থেকেই ফুটবলাররা উৎসাহী হতেন তখন। সুব্রত কাপের মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জনের জন্য জেলার স্কুলগুলির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হত।
এরপরে স্কুল দলে যাঁরা ভালো খেলতেন তাঁদের জেলার ক্লাবগুলি দলে টেনে নিত। আর এই জেলা লিগ এতটাই জমজমাট থাকত যা দেখতে মাঠে ভিড় উপচে পড়ত। কলকাতার কর্মকর্তারা হাজির হতেন জেলার মাঠে। তাঁদের পছন্দের ফুটবলারদের টেনে নিতেন নিজেদের দলে। যেমন ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, সুব্রত ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, অলোক মুখোপাধ্যায়, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, মিহির বসু, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় – তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। এইভাবেই বছরের পর বছর বাংলার ফুটবল সমৃদ্ধশালী হয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হল, এখন সেই ছবিটা পালটে গিয়েছে। ছোট মাঠগুলি হারিয়ে যাওয়ায় আন্ডার হাইট ফুটবল বন্ধ। স্কুল টুর্নামেন্ট পরিচালনার জন্য উদ্যোগের অভাব, জেলা লিগও এখন তার কৌলীন্য হারিয়েছে। যে কারণে ছেলেরা এখন আর ফুটবল মাঠে আসতে উৎসাহ পাচ্ছে না।
(লেখক সাংবাদিক)