- তৃষ্ণা বসাক
দিনটা স্পষ্ট মনে আছে, পয়লা মে ২০১৫। শুধু তাঁকে দেখব বলে, তাঁর কবিতা পাঠ শুনব বলে ভারতীয় ভাষা পরিষদে চলে গিয়েছি সেদিন সন্ধ্যায়। গিয়ে শুনছি তাঁর আক্ষেপের কথা, বিরক্তির কথা। আক্ষেপ, কারণ সবাই মাতামাতি করে গীতিকার গুলজারকে নিয়ে। বিরক্তি, কারণ যাকে বলে খচাখচ ভরা প্রেক্ষাগৃহ থেকে শুধু অনুরোধ আসছে ‘চপ্পা চপ্পা চরখা চলে’ কিংবা ‘ইস মোড় পে আ গয়ে হাম’ এইসব শোনাবার।
তিনি বলেই ফেললেন ফিল্মের গানের লেখক নয়, তিনি এখানে এসেছেন কবি হিসেবে, কবিতা পড়তে। শুভ্রবসন মানুষটির নম্রতার মধ্যে এমন এক কাঠিন্য আছে, যে উশখুশ, গানের সুপারিশ থেমে গেল। তিনি যে কবিতা পড়েছিলেন, তার মধ্যে সম্ভবত প্লুটো গ্রহ ছিল। তখনই চলভাষে এমন একটা বার্তানু এল যে তখনই বেরিয়ে আসতে হল। মা নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন। সেই যে আমি গুলজারের কবিতা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম ১ মে সন্ধেবেলা, তা একেবারে ১৯ মে মা’র চলে যাওয়া অবধি, কীর্তনখোলা শ্মশান ছাড়িয়ে সে যাত্রা এখনও চলছে।
গুলজারের কবিতার স্মৃতি মানে কিন্তু শুধু মা’র মৃত্যু নয়, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত মা’র সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হওয়া ১৮টা বিকেল ধরে। একদিন সেই দেখা হয়তো বাইরে থেমে গেল। কিন্তু হাঁটা থামল না। আজও মনে পড়ে চরম উদ্বেগে বেরিয়ে আসছি ভরা হল থেকে, অথচ মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছে কবিতা শুনতে না পারার আক্ষেপ। এ কি পাপ? মা এত অসুস্থ, তবু আমার গুলজারের কাছ থেকে যেতে ইচ্ছে করছে!
কেন যে মনে পড়ে গালিবকে-
হজারো খোয়াহিশে অ্যায়সী কি হর খোয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে মেরে আরমান লেকিন ফিরভি কম নিকলে।
(সহস্র আকাঙ্ক্ষা এমন, যে প্রতি বাসনায় কণ্ঠাগত পরান
প্রকাশ হলও বহু ইচ্ছে আমার, তবুও হল না বাসনার অবসান)
এই যে বহু বাসনা- এই হচ্ছে আধুনিক মানুষের লক্ষণ। রাবণের দশমুণ্ডে যে জগৎ গ্রাস করতে চায়। ‘এ দিল মাঙ্গে মোর’।
তমাশা– এ গুলশ্ন তমান্না এ চীদন
ভার আফ্রীনা, গুনহগার হ্যাঁয় হাম
উদ্যানের রং আমায় পুষ্পচয়নে প্রলুব্ধ করে
বসন্ত অপরূপ, পাপ করেই ফেলি।
গালিবের চারপাশে তৈরি হয়েছে এনিগমার কুহেলি। কারণ তিনি আধুনিক, তিনি যুগের থেকে এগিয়ে। তাঁর কবিতা রংদার মেহফিলে বাহ ভাই বাহ করাতেই আটকে থাকেনি, নির্জন গলি দিয়ে একা মানুষের বাড়ি ফেরার পথে হেঁটে হেঁটে এসেছে পেছন পেছন, মরুভূমির বালিঝড়ের মতো চোখে নাকে ঢুকে গিয়েছে, কানের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে বহু বছর আগের সমুদ্রস্নানের স্মৃতি হয়ে, হোটেলের আয়নার সাঁটা টিপ হয়ে- যার মায়া আর বেদনা আমরা কোনওদিন কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
গালিবের মতোই নাগরিক, আধুনিক কবি গুলজার। তাঁর কবিতায় উঠে আসে মুম্বইয়ের অলিগলি, তার বর্ষা। ‘বর্ষা এলে জলেরও পাঁচ পা লেগে যায়,/প্রত্যেক দরজা ও দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে সে গলি ধরে বেরোয়’। অথবা ‘রাত যখন মুম্বইয়ের রাস্তায়/হাতের মুঠিকে পেটের ভেতর চেপে/কালো বিড়ালের মতো ঘুমোয়/চোখের তখন পলক পড়ে না, -/শুধু একটানা ঘনঘন নিঃশ্বাস/উড়তে থাকে শুকনো সমুদ্রতটে!’
(মুম্বই)
একা এক মাতৃহারা কিশোর বসে থাকত যে শহরের সমুদ্রতীরে। এই কলকাতার জনসমুদ্রের তীরে মাতৃহারা আমি হাঁটতে থাকি একা একা আর হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাওয়া মাকে আমি বলি/ এই পথ খুব সহজ তো নয়/যে পথে তুমি হাত ছেড়ে যাওয়া/ চলে যাও একা আর কোনও পথে/পাছে দিক ভুলে যাও এই শঙ্কায়/প্রতিটি মোড়ে আমি কবিতা দাঁড় করিয়ে রেখেছি …
আর যদি তোমার প্রয়োজন পড়ে, একটি কবিতার আঙুল ধরে ফিরে এসো!
(লেখক সাহিত্যিক)