Monday, April 29, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ হয়ে উঠছে প্যাকেট

কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ হয়ে উঠছে প্যাকেট

‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ এক ধরনের প্রতারণা না ব্যবসা বাঁচানোর বাধ্যবাধকতা? সেটা ঠিক করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নীতি-নির্ধারকরাও হিমসিম।

  • অতনু বিশ্বাস

ছোটবেলা থেকেই বেশির ভাগ মিষ্টির দোকানে একটা জিনিস দেখে আসছি। তা হল ক্রমেই কমতে থাকা মিষ্টির সাইজ। বিশেষ করে দাম অক্ষুণ্ণ রেখে রসগোল্লা বা সন্দেশের মতো মিষ্টির আকার যেন ক্রমেই ছোট হতে থাকে। ছেলেবেলায় মজা করে আমি একে তুলনা করতাম কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের সঙ্গে। কিন্তু সন্দেশ তো তৈরি হয় ছাঁচে। তাহলে একই নকশার সন্দেশের আকার ছোট হয় কীভাবে? একবার পাড়ার মিষ্টির দোকানে এর রহস্য জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম যে, একই নকশার বিভিন্ন আকৃতির ছাঁচ থাকে। থাকতেই হবে। তাই তো সন্দেশের আকার কমতে পারে। কিন্তু সন্দেশের আকার কেন ছোট হচ্ছে, পাড়ার দোকানে সে প্রশ্ন করে উত্তর জোটে যে কাঁচামালের দাম বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে শ্রমের মূল্য। অগত্যা… ওই দোকানি যদি অর্থনীতিবিদ হতেন তাহলে এক কথায় এর উত্তর দিতেন- মূল্যবৃদ্ধি। ইনফ্লেশন।

কিন্তু তখন তো আর বুঝতে পারিনি যে এটা শুধু মিষ্টির দোকানের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যাপ্তি দুনিয়াজুড়ে। তাবড় তাবড় কোম্পানি, এমনকি নানা বহুজাতিক কোম্পানিও এই কৌশল অবলম্বন করে চলেছে তাদের ব্যবসার প্রয়োজনে। এর একটা গালভরা পারিভাষিক নামও জুটেছে ২০০৯ নাগাদ। ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’। নামটা দেবার কৃতিত্ব অর্থনীতিবিদ ফিলিপা ‘পিপা’ ম্যামগ্রেন-এর। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বিশেষ সহকারী হিসেবে একসময় কাজ করেছেন এই ম্যামগ্রেন। যাই হোক, একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে, ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ শব্দটা ‘শ্রিঙ্ক’ এবং ‘ইনফ্লেশন’-এর হাঁসজারু সংস্করণ। সোজা কথায় যার অর্থ মূল্যবৃদ্ধির কারণে ছোট হওয়া। এ যেন মূল্যবৃদ্ধির এক বিপথগামী তুতো ভাই।

জানুয়ারির গোড়ার দিকে কিন্তু এই ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ নিয়ে হইচই কাণ্ড ইউরোপের বাজারে। নামজাদা ফরাসি সুপারমার্কেট চেইন কেরিফোর তাদের ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, স্পেনের মতো দেশের বিভিন্ন স্টোরে পেপসিকো কোম্পানির বিবিধ পণ্য, যেমন পেপসি, ৭আপ, লেজ, কোয়েকার ওটস, লিপটন চা, ইত্যাদির বিক্রি বন্ধ করে দিল। কেরিফোরের অভিযোগ, পেপসিকো এইসব দ্রব্যের দাম অক্ষুণ্ণ রেখে প্যাকেটের আকৃতি বা পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।

এমনটা অবশ্য অনেক কোম্পানিই করে চলেছে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখলাম, আমেরিকার ডলার স্টোরগুলি, যেখানে মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্তর ভিড়, সেখানেও দেদার চলছে এই তথাকথিত ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’। যাই হোক, কেরিফোর কিন্তু গত বছরই শুরু করেছিল তাদের ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ নিয়ে প্রচার। তাদের স্টোরে বিভিন্ন পণ্যের গায়ে স্টিকার সেঁটে দেয় তারা, ক্রেতাকে সচেতন করতে জানিয়ে দেয় যে সেই পণ্যগুলির আকার কমেছে আর বেড়েছে দাম। কেরিফোরের এই আচরণ কিন্তু ফরাসি সরকারের নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। নিজেদের উৎপাদন শিল্পকে সুরক্ষার প্রয়োজনে ফ্রান্স খুচরো বিক্রির বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কঠোরভাবে। বড় বড় সুপারমার্কেটকে এই কোম্পানিগুলির সঙ্গে বছরে একবার আলোচনার মাধ্যমে পণ্যের দাম স্থির করতে হয়। এটা সে দেশের নিয়ম।

যাই হোক, প্যাকেটের সাইজ বা পণ্যের সাইজ কমানোর এই কৌশল কিন্তু গোটা দুনিয়াজুড়েই চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কারণ হিসেবে উৎপাদকরা সাধারণত বলে যে কাঁচামাল, জ্বালানি, শ্রমের দাম বাড়ছে, সমস্যা হচ্ছে জোগানে, সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। তাই তাদের ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে এ ছাড়া পথ নেই।

একটা পথ অবশ্যই আছে, তা হল সরাসরি জিনিসের দাম বাড়ানো। ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ও তো সেই দাম বাড়ানোই হল, কিন্তু পরোক্ষে। কিন্তু সরাসরি দাম বাড়লে ক্রেতারা যেভাবে মানসিকভাবে প্রভাবিত হন, ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’-এর ফলে ততটা হন না। কোম্পানিগুলি দীর্ঘদিন ধরেই সেটা জানে, অথবা বিশ্বাস করে। তাই দুনিয়াজুড়ে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতোই আকার ছোট হয়ে আসে বিবিধ পণ্যের। চকোলেটের, কফির, সাবানের, নরম পানীয়র, পটেটো চিপসের, টয়লেট পেপারের, এমনকি ইন্টারনেট ডেটা প্ল্যানের।

বিশ্বজুড়ে অজস্র ছোট-বড় উদাহরণ রয়েছে। টেটলির চায়ের প্যাকেটে ১০০টা টি-ব্যাগের জায়গায় ৮৮টা হয়ে গেল ২০১০-এ। সে বছরই ক্রাফট-এর বিখ্যাত টবলরিন চকোলেট বারের ওজন ২০০ গ্রাম থেকে হয়ে গেল ১৭০ গ্রাম। ২০১৪-তে কোকাকোলার বড় বোতল দু’লিটার থেকে হয়ে গেল পৌনে দু’লিটারের। ইউনিলিভারের ডাভ সাবানের বার ১০০ গ্রাম থেকে ৯০ গ্রাম হয়ে গেল ২০২২-এ। এমন উদাহরণ আরও অনেক, অনেক। একটু চোখ-কান খোলা রাখলে আমাদের গণ্ডির মধ্যেই এমন উদাহরণ আমরা নিজেরাই খুঁজে পাব বিস্তর এবং একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, এই ধরনের ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’-এর ঘটনাগুলির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিক্রেতারা কিন্তু জিনিসের দাম হয় বাড়িয়েছে নয়তো অক্ষুণ্ণ রেখেছে।

‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ আদপে পরোক্ষে মূল্যবৃদ্ধি। ‘ইনডাইরেক্ট ইনফ্লেশন’। হয়তো খানিক বিস্ময়করভাবেই, বহু মানুষই একে লুকোচুরি হিসেবে দেখেন। ক্রেতাদের সংগঠন একে ‘চুরি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, চোখে পড়েছে এমনটাও। যদিও, একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে ব্যাপারটা বেআইনি নয়, বিশেষ করে প্যাকেটের গায়ে যদি জিনিসের ওজন বা পরিমাণ পরিষ্কারভাবে লেখা থাকে তাহলে তো নয়ই। এমনকি ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ এক ধরনের প্রতারণা নাকি ব্যবসা বাঁচানোর বাধ্যবাধকতা, সেটা নির্ধারণ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নীতি নির্ধারকরাও হিমসিম।

আমাদের দেশের প্রেক্ষিতেও ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ যে মিষ্টির দোকানের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ তেমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। রুমাল থেকে বিড়াল হয়ে যাবার স্টাইলে ১৪০ গ্রামের বিস্কুটের প্যাকেট ১১০ গ্রাম হয়ে যাচ্ছে, বা ১০০ গ্রামের নুডলসের প্যাকেট হয়ে যাচ্ছে ৭০ গ্রামের, কিংবা ১৫০ গ্রামের ডিটারজেন্ট বার হয়ে যাচ্ছে ১৪০ গ্রামের, এমনটা তো হামেশাই হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় আমরা হয়তো চট করে খেয়ালও করি না এসব। আর খেয়াল হলেও আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি কৃষ্ণা চাঁদের এ ধরনের মোহিনী মায়ার জাদুতে।

একটু অন্য এক ধরনের ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ও এদেশে ঘটেছে গত তিন দশকে। প্রধানত ১৯৯০-এর দশক থেকে এদেশে শুরু হয়েছে স্যাশে বিপ্লব। তেল, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট বড় বোতল বা প্যাকেটের পরিবর্তে হাজির হয় ছোট্ট স্যাশেতে। পরিমাণ কম, কিন্তু দামও কম। প্রধানত আধা শহর কিংবা গ্রামীণ অঞ্চলে এর সূত্রপাত হয় এবং এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের মধ্যে, যারা চট করে বড় প্যাকেট কেনার পরিবর্তে অল্প দামের স্যাশেতে উপযোগিতা খুঁজে পায়। ক্রমে কিন্তু অনেক শহরের এবং তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধতর জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বাড়তে থাকে বিভিন্ন পণ্যের স্যাশের জনপ্রিয়তা। বড় প্যাকেট বা বোতল থেকে ছোট্ট স্যাশের গণ্ডিতে ঢুকে পড়াও এক ধরনের ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ নিশ্চয়ই।

যাই হোক, ফিরে আসা যাক কেরিফোরের বৈপ্লবিক কাজের প্রেক্ষিতে। পেপসিকোর মতো মস্ত কোম্পানির সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয় নিশ্চয়। সেই কাজটাই করেছে কেরিফোর। এর মীমাংসা কীভাবে হবে তার উপর অনেকটাই কিন্তু নির্ভর করবে ভবিষ্যতের এ গ্রহের পণ্যের পরিমাণ হ্রাসের গতিপ্রকৃতি। আমরা সাধারণ গ্রাহকরা কী সব সময় পণ্যের প্যাকেটের গায়ের বিস্তারিত বিবরণ পড়ে বুঝে জিনিস কিনি? বাস্তবে সেটা কি সম্ভব সর্বক্ষেত্রে? বেশির ভাগ মানুষ হয়তো কখনোই পড়ে দেখেন না এসব। কেরিফোরের বিপ্লব কিছুটা হলেও হয়তো জনসচেতনতা জাগিয়ে তুলতে পারবে এ বিষয়ে এবং সেই সঙ্গে তা নাড়া দিতে পারে বিশ্বজুড়ে নীতি নির্ধারকদেরও। উৎপাদক এবং বিক্রেতারাও খানিকটা নড়েচড়ে বসতে পারে হয়তো। কী জানি কখন, অন্য কোনও সুপারমার্কেটও তাদের শেলফ থেকে সরিয়ে দেবে এমনই কোনও পণ্যসামগ্রী। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ হবার জন্য।

(লেখক কলকাতার আইএসআইয়ের অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

ISL | মধুর প্রতিশোধ যুবভারতীতে, ২-০ গোলে ওডিশাকে হারিয়ে আইএসএল ফাইনালে মোহনবাগান

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: টানটান উত্তেজনার ম্যাচে ওডিশাকে ২-০ গোলে হারিয়ে আইএসএলের ফাইনালে পৌঁছে গেল মোহনবাগান। ইনজুরি টাইমে জয়সূচক গোলটি করেন আব্দুল সাহাল। মোহনবাগানের...

AAP | আপের হয়ে দিল্লিতে প্রচারে অরবিন্দ পত্নী, ভিড় জমালেন মহিলারা

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ‘যার স্বামী জেলে আছে, তাঁকে তো বাইরে আসতেই হবে’ কথাগুলি ৫২ বছরের কমলেশ জৈনের। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের স্ত্রী সুনীতা...

Titanic | নিলাম হল টাইটানিকের ধনকুবের যাত্রীর সোনার পকেটঘড়ির, দাম উঠল  ১০ কোটি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ডুবে গেলেও আজও জীবিত আছে মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায়। ১১০ বছরেরও বেশি জলের তলায় রয়েছে বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক। টাইটানিককে নিয়ে রয়েছে...

Siliguri | মাটিগাড়ায় হামলা, আক্রান্ত বিজেপির বুথ সভাপতি সহ ৬

0
শিলিগুড়ি: মাটিগাড়ার কলাইবক্তরি এলাকায় রবিবার সন্ধ্যায় একদল দুষ্কৃতী বিজেপির স্থানীয় বুথ সভাপতি নন্দকিশোর ঠাকুর সহ কয়েকজন বিজেপি কর্মকর্তার বাড়িতে হামলা চালায়। যার জেরে দু’জন...

Migrant Worker | রমরমিয়ে চলা মাছের ব্যবসাই হল কাল, কেরালায় খুন হলেন মানিকচকের পরিযায়ী...

0
মানিকচকঃ কেরালায় গিয়ে মাছের ব্যবসায় ব্যাপক পসার জমিয়েছিলেন মালদার মানিকচক নাজিরপুরের একটি ছোট্ট গ্রাম লস্করপুরের যুবক প্রকাশ। স্বল্প লাভে মাছ বিক্রি করায় অল্প দিনের...

Most Popular