- যোগেন্দ্র যাদব
রাজা মারা গিয়েছেন। রাজা দীর্ঘজীবী হোন।
গত ২৬ জানুয়ারি এই ব্রিটিশ প্রবাদটা খুব মনে পড়ছিল। এর সঙ্গে প্রজাতন্ত্র মৃত, প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক কথাগুলির কোথায় যেন মিল রয়েছে। ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ২০২৪-এ যা অনেকাংশে ভেঙে পড়েছে। বহুদিন ধরে যে প্রক্রিয়া চলেছে।
কিছুদিন যাবৎ আমি ‘প্রজাতন্ত্রের সমাপ্তি’র আশঙ্কা করছি। বর্তমানে আমরা একটি নতুন ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাস করছি। যাঁরা সুযোগসন্ধানী তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন। আর আমরা যাঁরা প্রজাতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর তাঁদের সামনে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নতুন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা ছাড়া বিকল্প নেই। আমাদের রাজনীতির একটি নয়া ধারার কথা ভাবতে হবে যা প্রজাতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করবে। নিশ্চিত করবে এর নিরাপত্তা। আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক কৌশলে বদল আনতে হবে। পুরোনো ধাঁচে প্রতিরোধের রাজনীতিকে শুধু সংসদীয় গণ্ডির মধ্যে না বেঁধে অন্যান্য নিয়মতান্ত্রিক বিকল্পগুলির কথা বিবেচনা করার সময় এসেছে।
এটা ভাবা ভুল যে, অযোধ্যার অভিষেক অনুষ্ঠান শুধু মূর্তি, ভগবান রাম বা রাম মন্দিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। একে আদর্শ, আস্থা বা ধর্ম দিয়েও পুরোপুরি বিচার করা যাবে না। এর সঙ্গে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মর্যাদার একাধিক লঙ্ঘন জড়িত। নিঃসন্দেহে এটি কোটি কোটি বিশ্বাসীর আস্থার সঙ্গে জড়িত। তবে অনেক আগেই বিষয়টিকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। ধর্মের বিপরীতমুখী রাষ্ট্রতন্ত্র এর গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেছে। যা বকলমে হিন্দু রাজনৈতিক উপনিবেশের প্রতিনিধিত্ব করে।
পটভূমি, নকশা, গতিশীলতার প্রকৃতি, প্রভাবের নিরিখে ২২ জানুয়ারির অনুষ্ঠানটি ছিল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। যা রাজনৈতিক বিজয়ের পূর্বাভাসকে ইঙ্গিত করছে। যার সারমর্ম হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ দ্বারা সংজ্ঞায়িত হিন্দু রীতি বা প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
বিবর্তনের পথে আমাদের সামনে নতুন সংবিধান রয়েছে। তবে তা নতুন দলিলের অবয়বে নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতার এক নয়া ব্যবস্থা রূপে, যা আমরা গত এক দশক ধরে প্রত্যক্ষ করছি। মূল সংবিধানে সংখ্যালঘুদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধিকারকে গণ্ডিবদ্ধ করা হয়েছে। তবে নতুন ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাই চূড়ান্ত, যাকে সরকারের কোনও কাঠামো ছাপিয়ে যেতে পারে না। মূল সংবিধানে কী রয়েছে তা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ধারণাটিও একক সরকারের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে যেটি প্রদেশগুলিতে কিছু প্রশাসনিক কাজকর্ম সম্পাদন করে। শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজনরেখাটি খুব তাড়াতাড়ি ম্লান হয়ে গিয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার বদলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের পথ সুগম হয়েছে। একজন নির্বাচিত রাজা- এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে মানুষ তাদের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে। তারপর তাঁর ওপর সবকিছু ছেড়ে দেয়।
সাংবিধানিক ব্যবস্থার এই রূপান্তর এখনও গণপরিষদের বৈধতাকে নস্যাৎ করতে পারেনি। মন্ত্রীসভা হয়তো প্রস্তাব পাশ করে দাবি করতে পারে যে, ভারতের চেতনা ২০২৪-এর ২২ জানুয়ারি জাগ্রত হয়েছে। তবে এটি এখনও ভারতের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের জন্মের আনুষ্ঠানিক তারিখ নয়। সংবিধানের বাস্তবিক বিলুপ্তি ঠেকাতে লড়াইয়ের পরিসর এখনও বিদ্যমান। আসন্ন লোকসভা ভোট যে লড়াইয়ের প্রথম ফ্রন্ট হতে চলেছে। নির্বাচনের ফল যাই হোক না কেন আমরা এই নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারি না। আমরা রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল বদলের চ্যালেঞ্জকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জায়গায় নেই।
প্রজাতন্ত্রের এই কঠিন সময়ে সবার আগে আমাদের নিজেদের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এজন্য বিজেপি-আরএসএসকে দোষারোপ করা অর্থহীন। নিজস্ব নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য তাদের কাছেও পর্যাপ্ত যুক্তি রয়েছে। প্রজাতন্ত্র এবং সংবিধানের প্রতি যাঁরা আনুগত্যের শপথ নিয়েছেন তাঁদেরই এর রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোয় ধসের অন্যতম কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতার অবক্ষয়। যার পিছনে রয়েছে বিশ্বাসের রাজনীতির মাধ্যমে সুবিধা অর্জনের চেষ্টা। ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ পালনের আপাত অহংবোধ জনগণের থেকে একে বিচ্ছিন্ন করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তারা সর্বসাধারণের মতো করে এই আদর্শের ব্যাখ্যা করতে এবং এর গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আমরা ভুলতে পারি না যে, বাবরি মসজিদ ধবংসের ৩০ বছর পর এক ঘোষণার মাধ্যমে এর মৃত্যু আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত হয়েছিল। ৩০ বছর যাবৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রবক্তারা মনে করেছেন সময়ের সঙ্গে আপনা থেকেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চিরাচরিত শ্রেণি রাজনীতি বোধহয় সব সমস্যার চাবিকাঠি। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যদি আজ নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে তার দায় এর প্রবক্তাদেরই নিতে হবে।
রাজনীতি করতে গিয়ে আমরা যা হারিয়েছি রাজনীতির মাধ্যমেই সেটা ফিরে পেতে হবে। আমাদের সামনে বিকল্প কমে আসছে। আমরা যাঁরা সংবিধানের পক্ষে রয়েছি তাঁরা হয়তো নিজেদের দেশেই বিক্ষুব্ধ আদর্শিক সংখ্যালঘুর জীবনযাপন করতে পারি। মাঝেমধ্যে কাগজ-কলমে প্রতিবাদ জানিয়ে দায় সারতে পারি। অথবা সাহস করে প্রজাতন্ত্রের ভিত শক্ত করার চেষ্টা করতে পারি।
দ্বিমুখী পথ এই প্রজাতান্ত্রিক রাজনীতিকে দ্বিমুখী পথ ধরে এগোতে হবে। প্রথমত, আগামী কয়েক দশকের জন্য একটি সাংস্কৃতিক এবং মতাদর্শগত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। এই লড়াই শুরু হবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, সভ্যতা, ঐতিহ্য, ভাষা, হিন্দুধর্ম সহ ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। সবকিছু হবে পিরামিডের নীচের অংশের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আদর্শগত ভারসাম্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞা প্রদানের প্রয়োজন রয়েছে। বিংশ শতকের কিছু মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব, যেমন- কমিউনিস্ট-সমাজতন্ত্রী এবং গান্ধিবাদের মধ্যেকার টানাপোড়েন আজ অপ্রাসঙ্গিক। আমাদের উদার, সমতাবাদী এবং ঔপনিবেশিকতা বিরোধী অবস্থানকে জোরদার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলগুলিকে আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিকল্প উপস্থাপন করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দল ভাঙানোর গুরুত্ব কমে আসছে। যাঁরা প্রজাতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ, তাঁদের একজোট হওয়াটা এখন সময়ের দাবি। নতুন পরিস্থিতিতে রাজপথে আন্দোলনের গুরুত্ব বেড়েছে। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদের পথ সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রতিরোধের রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক ও অহিংস পথে পরিচালিত করতে উদ্ভাবনী মননের প্রয়োজন।সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রতি একটি কৌতুক পোস্ট নজরে এসেছে। যেখানে আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবসটি ভালোভাবে পালন করার ডাক দেওয়া হয়েছে, পাছে এটিই শেষ দিন হয়। বার্তাটা স্পষ্ট। তবে সব হতাশা-নিরাশাকে পিছনে ফেলে ২৬ জানুয়ারি আমাদের প্রজাতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জাতীয় সংকল্প গ্রহণের দিন হতেই পারে।
(লেখক রাজনীতিক, সেফোলজিস্ট)