- কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিম এশিয়ার ইয়েমেনের রাজধানী সানার কাছাকাছি মরু অঞ্চল। জিপ, পিকআপ ট্রাকে করে কয়েকশো সশস্ত্র মানুষ হাতের অ্যাসল্ট রাইফেল তুলে স্লোগান দিচ্ছে ‘আমেরিকা, ইজরায়েল, ইহুদি নিপাত যাক’ বলে। খানিক আগেই মার্কিন হামলা হয়ে গিয়েছে তাদের এই মরুঘাঁটিতে। তাদের বেশ কয়েকজন সঙ্গী মারা গিয়েছে, ঘাঁটিরও মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। যে কোনও সময় ফের হামলা হতে পারে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে ইরানি মদতপুষ্ট এই হাউথি উপজাতি জঙ্গিরা তাদের আস্ফালন করে চলেছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের ইজরায়েলে আক্রমণের পালটা তেল আভিভের হামলা গাজায় হতেই এই হাউথি জঙ্গিবাহিনী সশস্ত্র প্রতিবাদে নেমে পড়েছে। ইরাক আর সিরিয়াজুড়ে থাকা মার্কিন সেনাঘাঁটিগুলোর উপর বারংবার ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন হামলা চালিয়েছে হাউথিরা। এদের হামলায় জর্ডনের সেনাঘাঁটিতে তিন মার্কিন সেনার প্রাণ গিয়েছে। হাউথিদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে বারংবার মার্কিন ও ব্রিটিশ হামলাও যে এদের পিছু হটতে বাধ্য করছে- এখনও পর্যন্ত এমন কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
মার্কিনদের এই হিমসিম অবস্থার মধ্যেই এবার যুক্ত হয়েছে লোহিত সাগরে অস্থিরতা। পশ্চিম এশিয়ার এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সংযোগকারী সুয়েজ খালের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে ইয়েমেনের দক্ষিণ সীমার লোহিত সাগরে। এই জলরাশি দিয়ে বছরে গড়ে ১৯ হাজার পণ্যবাহী জাহাজ বিশ্বের ১৫ ভাগ বাণিজ্য করে থাকে। হাউথিরা তাদের স্থল সন্ত্রাসের সঙ্গে এই লোহিত সাগরকেও নিশানা করেছে। এই জলরাশি দিয়ে কোনও পশ্চিমী পণ্যবাহী জাহাজ (বিশেষ করে মার্কিন ও ইজরায়েলি জাহাজ) যেতে দিতে এরা রাজি নয়। এজন্য তারা মুহুর্মুহু ড্রোন হামলাও চালাচ্ছে পণ্যবাহী জাহাজের উপর। ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজও আক্রান্ত হয়েছে এই জঙ্গি গোষ্ঠীর হাতে।
অর্থাৎ গাজা যুদ্ধ আর ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ভূখণ্ডের সীমিত পরিসরে আবদ্ধ নেই। এই যুদ্ধের লেলিহান শিখা সিরিয়া, ইরাক হয়ে লোহিত সাগরে ছড়িয়ে পড়ছে। তবে কি আগের মতো পেন্টাগনের অঙ্গুলিহেলনে আরব বিশ্ব চলছে না? যদি নাই চলে থাকে, তাহলেই বা এর পিছনে কারণ কী?
এই ‘কেন’র কারণ খুঁজতে পশ্চিমী দুনিয়ার বিশেষজ্ঞরা নেমে পড়েছেন। তাঁদের প্রাথমিক অনুমান, গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ আদতে যুদ্ধ হিসাবে যত না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে ঢের বেশি প্রভাব ফেলতে চলেছে বিশ্বের শক্তির ভারসাম্যে। তাঁদের মতে, গত তিন দশকের ওয়াশিংটনের একাধিপত্যের অবসান শুধু নয়, শুধুমাত্র বেজিং পরাশক্তি হিসাবেই উত্থান হচ্ছে না, চিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাশিয়া, ইরান আর উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে এক নয়া অক্ষশক্তির উদয় হচ্ছে। এই অক্ষশক্তি একদিকে যেমন পশ্চিম এশিয়াতে মার্কিন প্রভাব শেষ করতে চাইছে, তেমনি ধীরে ধীরে পূর্ব ইওরোপের ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের পায়ের তলার জমি শক্ত করছে। পরিণতিতে দুটো রণাঙ্গন থেকেই পেন্টাগনকে পিছু হটতে হতে পারে। আর তা হলে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারসাম্যের বড়সড়ো পরিবর্তন হতে পারে।
প্রথমে গাজা যুদ্ধের প্রসারতা নিয়েই দেখা যাক। ইজরায়েল আর প্যালেস্তাইনের মধ্যে বৈরিতা কোনও নতুন খবর নয়। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েলের জন্মাবধি এই বৈরিতা চলে যাচ্ছে। আরব পড়শিরা বারকয়েক একযোগে আক্রমণ করে নবজাতক রাষ্ট্রকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে গিয়েছে। ফলে বিগত কয়েক দশক ধরে প্যালেস্তাইনের মধ্যেই সীমিত যুদ্ধের আগুন জ্বলেছে। এমন নয় যে আরব বিশ্ব চুপ করে থেকেছে। কিন্তু তর্জন গর্জন পর্যন্তই, তারপর কেউই আর এগোয়নি। কারণ তেল আভিভের পিছনে রয়েছে ওয়াশিংটনের বরাভয় হাত।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বারবার দেখা যাচ্ছে পশ্চিম এশিয়াতে ওয়াশিংটনের ইচ্ছাই শেষ কথা এমনটা আর বলা যাচ্ছে না। ইজরায়েলের পরে যে সৌদি আরব ওয়াশিংটনের পরম বন্ধু হিসাবে চিহ্নিত, সেও পেন্টাগনের ঘোষিত দুশমন সিরিয়ার একনায়ক বশির অল আসাদকে আরব লিগে শুধু যে ফেরত এনেছে তাই নয়, গাজায় হামলার জেরে তেল আভিভের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াও স্থগিত করেছে। অথচ আরবদুনিয়ার সঙ্গে তেল আভিভের সম্পর্ক ঠিক করা মার্কিন বিদেশনীতির মূল লক্ষ্য। এতেই শেষ নয়। চিনের মধ্যস্থতায় বেজিং গিয়ে পেন্টাগনের আরেক দুশমন ইরানের সঙ্গে রিয়াধ শান্তিচুক্তি করে এসেছে। এতে যে পশ্চিম এশিয়ায় চিনের গ্রহণযোগ্যতা এক লাফে অনেকটাই কিন্তু বেড়ে গেল তা তো বলাই বাহুল্য। আরও ভালো করে বললে সিরিয়ার আসাদ জমানাকে পেন্টাগনের হাত থেকে রক্ষা করে পুতিন যেমন পশ্চিম এশিয়াতে তাঁর পায়ের তলার জমি শক্ত করেছেন, তেমনি রিয়াধ আর তেহরানের মধ্যে শান্তিচুক্তি করিয়ে এলাকার আরেক ‘বিগ ব্রাদার’ হিসাবে শি জিন পিং আবির্ভূত হয়েছেন। এমনকি জর্ডনের মতো মার্কিন নির্ভরশীল দেশও বেসুরো লাগছে পেন্টাগনের কাছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় পেন্টাগনে হিসাব মিলছে না আর আগের মতো।
ইজরায়েলে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল বিবাদে একদা মধ্যস্থতাকারী মার্টিন ইন্ডিকের মতে, আর পাঁচটা যুদ্ধের মতোই গাজার লড়াইও নিত্যনতুন দিক খুলে দিচ্ছে। পেন্টাগনও ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছে। যত যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে তত হাউথির মতো নতুন কুশীলবদের হাজির করছে মস্কো-বেজিং জুটি। এক্ষেত্রে তেহরান আর দামাস্কাস হল এই অক্ষশক্তির সামনের সারি। ফলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যতই দীর্ঘ লড়াইয়ের কথা বলুন না কেন, পেন্টাগন চাইছে এই বৈরিতার দাবানলে জল ঢালতে। কিন্তু যতদিন না হামাসের কবল শতাধিক ইজরায়েলি পণবন্দিকে ছাড়ানো যাচ্ছে ততদিন যে এটা সম্ভব নয় তাও ওয়াশিংটন হাড়ে হাড়ে জানে। তাই আপাতত ইগোকে একপাশে সরিয়ে কাতারের মাধ্যমে হামাসের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চাইছে ওয়াশিংটন।
ইউক্রেনেও পশ্চিমী শক্তির অবস্থা বিশেষ সুবিধার নয়। দেশের পূর্বভাগ যে রুশ দখলে গিয়েছিল তা মরণপণ চেষ্টা করেও জেলেনস্কির বাহিনী এখনও উদ্ধার করতে পারেনি। এমনকি প্রিগোজিন বিদ্রোহের যে ফায়দা রণাঙ্গণে পাওয়া যাবে বলে কিভ আশা করেছিল, তাও আপাতত দিবাস্বপ্নই রয়ে গিয়েছে। মাঝে দু’একটা রণাঙ্গণের বিক্ষিপ্ত সাফল্য সামগ্রিক চিত্রটাকে কিন্তু বদলাতে পারেনি।
আর যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে তত কিভের সমস্যা অন্যত্রও বাড়ছে। ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর ইউক্রেনকে সাহায্য করার ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ প্রথম থেকেই ছিল না। কারণ রুশ গ্যাসের উপর পশ্চিম ইউরোপ অনেকাংশে নির্ভরশীল। ওয়াশিংটনের চপাচাপিতে খানিকটা নিমরাজি হয়েই এরা কিভকে অস্ত্র সাহায্যে এগোয়। কিন্তু ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশ আর এগোতে চাইছে না। অন্যদিকে আমেরিকাতেও ইউক্রেনকে এই বন্যার মতো অকাতরে সাহায্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নভেম্বরে নির্বাচনকে মাথায় রেখে বাইডেন প্রশাসনকে তাই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে।
ঘরেও রয়েছে জেলেনস্কির অন্য সমস্যা। পুবের যে ডনবাস অঞ্চল মস্কোর দখলে গিয়েছে তা যে শুধু ইস্পাত তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ তাই নয়, দেশের অস্ত্র নির্মাণের অন্যতম মূলকেন্দ্রও ওটা। ফলে যুদ্ধে দেশীয় অস্ত্র পাওয়া মুশকিল হয়েছে ইউক্রেন সেনার। বহুলাংশেই বিদেশি অস্ত্রের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আর সেই সরবরাহেই যদি টান পড়ে তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে কিভের পক্ষে। এরমধ্যে আবার দুর্নীতির বিষবৃক্ষও মাথাচাড়া দিয়েছে ইউক্রেনে। ফলে একদা টিভি সোপ অপেরার কমেডিয়ান জেলেনস্কির দিনকাল মোটেও ভালো যাচ্ছে না।
ইউক্রেন যুদ্ধে কিভের হয়ে বকলমে যদি ন্যাটো লড়াইয়ে ময়দানে থাকে, তো মস্কোর পিছনে রয়েছে বেজিং-তেহরান-পিয়ং ইয়ং অক্ষশক্তি। পেন্টাগন এও খুব ভালো করেই জানে যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে এই অক্ষশক্তি তত সুসংহত হবে।
আরেক শীতল যুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে কি?
(লেখক সাংবাদিক)