- গৌতম সরকার
হম্বিতম্বি ততক্ষণ, ক্ষমতা আছে যতক্ষণ। চেয়ারটা চলে যাওয়ার বিপদ বুঝলে কেঁচো হয়ে যেতে সময় লাগে না। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। হ্যাঁ, নিজের ভালো। জন বারলাও অতঃপর নিজের ভালো বুঝলেন। আচমকা এমন বিদ্রোহ করে বসলেন যেন, বিজেপির হাতের মোয়াটা খসে পড়ল আলিপুরদুয়ারে। কিন্তু নিশ্চয়ই দলের কোনও সান্ত্বনা বা সতর্কবার্তা জোঁকের মুখে নুন ঠেলে দিয়েছে।
প্রার্থী না হলে মন্ত্রিত্ব থাকবে না। এতেই ঘোর বিপদ ঠাউরেছিলেন লক্ষ্মীপাড়ার চা বাগানের শ্রমিক থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে উঠে আসা মানুষটি। যাঁর নেতৃত্বে একসময় ডুয়ার্স আন্দোলিত হয়েছিল আদিবাসী আন্দোলনে। যে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে চা বাগানে ট্রেড ইউনিয়নের একচ্ছত্র দাপট চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সেই বারলা বিদ্রোহে ইতি টেনে যে মনোজ টিগ্গাকে তিনি দলে মূল শত্রু ঠাউরেছিলেন, তাঁর হয়ে প্রচারে নেমে পড়েছেন।
মোক্ষ খুঁজতে কি আর লাজলজ্জা রাখলে চলে? মমতার হাত মাথা থেকে সরে যাওয়ার পর ২০১৯-এ ব্যারাকপুরের অর্জুন সিংয়ের মুকুল রায়কে কৃষ্ণ মেনে পদ্মের গন্ধ শুঁকতে দেরি হয়নি। সেই গন্ধে অচিরেই কৃষ্ণ ও অর্জুনের গা গুলিয়ে উঠল, করেকম্মে চলার মতো যোগ্য ব্যবস্থাটার হদিস না পাওয়ার কারণে। বঙ্গে হালে পানি পেতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হওয়ার পর ‘কৃষ্ণ’ মুকুল রায়ের তখনকার সারথি কৈলাস বিজয়বর্গীয় মনের দুঃখে ‘চলো নিজ নিকেতনে’ বলে ফিরে গেলেন।
সারথিহীন মুকুল না রাজ্যে, না সর্বভারতীয় পদ্মপুকুরে স্বার্থ সুরক্ষার পথ খুঁজে পেলেন। অগত্যা যাঁর উত্থানে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে ঘাসফুলের বাগান থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলেন, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ানো উত্তরীয় গলায় পরে পুনর্মূষিকো ভব হলেন। যদিও সেই বাগানের মালি হওয়া আর হল না তাঁর। খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর। ব্যারাকপুরের অর্জুনও তাই জোড়াফুলে জীবনের মোক্ষ ঠাউরে নিয়েছিলেন।
ছিলেন বিজেপি সাংসদ। সেই পদ অক্ষুণ্ণ রেখে হয়ে গেলেন তৃণমূল নেতা। যদিও তিনি বিজেপি সাংসদের তকমা অক্ষুণ্ণ রেখে আবার পদ্মের উত্তরীয় গলায় পরলেন। তেমনই কাঁথির শান্তিকুঞ্জের দুই অধিকারী বর্ষীয়ান শিশির ও নবীন দিব্যেন্দু জোড়াফুলের টিকিটে জিতে পাঁচটা বছর কাটিয়ে দিলেন পদ্মপাতার ছায়ায়। দলত্যাগ বিরোধী আইন না ছুঁল দুই অধিকারীকে, না ছুঁল অর্জুন সিংকে। আইনটি নিয়ে হিরণ্ময় নীরবতায় লোকসভায় বসে থাকলেন ওম বিড়লা।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় শুধুই চিৎকার ও আইনি লড়াই লড়ে গেলেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু একইরকম নীরব থাকলেন বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী, আলিপুরদুয়ারের সুমন কাঞ্জিলাল প্রমুখ তৃণমূলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেও কাগজে-কলমে থেকে গেলেন বিজেপির বিধায়ক। সুকুমার রায়ের হযবরল কবিতাকেও যেন হার মানায়। তৃণমূলের ঝান্ডা কাঁধে কৃষ্ণ কল্যাণী রইলেন বিজেপি বিধায়ক। সেই পদে থেকে আবার জোড়াফুল প্রতীকে প্রার্থী হলেন লোকসভায়।
আবার দেখুন, হতে পারেন তিনি বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা, কিন্তু বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল পুঁজি তো তিনি সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই। শুধু সেই পুঁজিতে নিজেকে কেউকেটা ভাবেন তিনি। সেই জোরে প্রার্থী হতে না পারার ক্ষোভে বাবুন হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁর বিদ্রোহ নিয়ে খুব মাতামাতি হবে। কিন্তু দিদি যে এভাবে তাঁকে পথে বসাবেন, তা হয়তো ভাবেননি।
মমতা যে মুহূর্তে ঘোষণা করলেন, ও আর আমার পরিবারের কেউ নয়, ওকে আমার পরিবারের কেউ ভাববেন না, অমনি সাপের ফণা নেতিয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রীর ভাই পরিচয়টা না থাকলে যে আম, ছালা, দুটোই যাবে বুঝতে দেরি করেননি তিনি। সাংসদ হওয়া পরের কথা, প্রার্থী হতে না পারার দুঃখ একদিন কেটে যাবে। ‘বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ একবিংশ শতাব্দীতে হয়তো তাও নয়।
মুখ্যমন্ত্রীর ভাই তকমাটা সরে গেলে পায়ের তলার জমিও যে সরে যাবে। এত এত ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা, মোহনবাগানের ফুটবল সচিবের পদ যে চলে যাওয়া অবধারিত হয়ে যাবে, তা আঁচ করতে বাবুনের অসুবিধা হয়নি। যত কথা বললাম, সেগুলির সঙ্গে আমার আপনার মতো পাঁচ পাবলিকের কোনও সম্পর্ক নেই। কৃষ্ণ কল্যাণী বা অর্জুন সিং ভোটে জিতুন বা হারুন, আমাদের কী বলুন তো? আমরা ওঁদের জেতাব পদ্ম বা ঘাসফুলে ছাপ মেরে। তারপর পালটি খেয়ে ওঁরা ভিনদলে চলে যাওয়ার সময় আমাদের মত তো নেন না।
অথচ অর্জুনের মতো নেতারা বলবেন, যা করছি ব্যারাকপুরের স্বার্থে। ব্যারাকপুরের কোন স্বার্থটা তিনি পূরণ করেছেন বলুন তো। বরং উপহার দিয়েছেন নিত্য অশান্তি, দলের মধ্যে গণ্ডগোল। এসবের জন্য কি আমরা ভোট দিই? খুব সম্প্রতি তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা লগ্নের অন্যতম সেনাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষের মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রতিজ্ঞা ঘোষণায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ে গেল, ‘জলস্পর্শ করব না আর/ চিতোর-রানার পণ,/ বুঁদির কেল্লা মাটির পরে/ থাকবে যতক্ষণ।’
তৃণমূলের রবিবাবু পণ করেছেন, নিশীথ প্রামাণিককে না হারানো পর্যন্ত তিনি মৎস্য স্পর্শ করবেন না। নিশীথকে যদি হারায় হারাবে তো জনগণ। তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারেন মাত্র। তিনি একা হারাবেন কীভাবে? তিনি জীবনভর নিরামিষ খেলেই বা আমাদের মতো পাঁচ পাবলিকের কী যায় আসে বলুন? উলটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাতেই মনে শঙ্কা জাগে, ‘কী প্রতিজ্ঞা হায় মহারাজ…।’
চিতোরের রানার পণ রক্ষায় শেষপর্যন্ত নকল বুঁদির গড় গড়তে হয়েছিল তাঁর সেপাই-সান্ত্রীদের। তাও শেষরক্ষা হয়নি। একা কুম্ভ রুখে দাঁড়িয়েছিল। তখন পণের মান রক্ষায় ‘রানার সেনা ঘিরি তারে/ মুণ্ড কাটে তরবারে…।’ সে তো বলপ্রয়োগ। তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকে না। মৎস্যমুখের পণরক্ষায় ভোটে সেটাই কি তবে ভবিতব্য?