প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লিঃ এতদিন ছিল বিজেপি বনাম সমমনোভাবাপন্ন বিরোধী শিবিরের লড়াই। শুক্রবার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সেই অভিমুখ পালটে দিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পটনায় বিহার মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের বাসভবনে আয়োজিত বিরোধী দলীয় বৈঠকে বক্তব্য রাখতে উঠে জানালেন, ‘মাথায় রাখুন, এটা বিজেপি বনাম বিরোধীদের লড়াই নয়, আসলে মোদি বনাম দেশের জনতার লড়াই। সমগ্র দেশবাসীর স্বার্থ এই লড়াইয়ে জড়িত।’ এ প্রসঙ্গে তাঁর সংযোজন, সব থেকে ক্ষমতাশালী দলকে রাজ্য স্তরে সমর্থন করতে হবে৷ সকলের মন্ত্র একটাই – ‘নো ভোট টু বিজেপি’৷ মমতার যুক্তি, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ও বিধেয়, সবই দেশের সার্বিক বিকাশ৷ মনে রাখা জরুরি এদিনের বৈঠকের ইতিবাচক বিষয়গুলি নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগোতে হবে সবাইকে৷’
শুক্রবার পাটনায় আয়োজিত হওয়া বিরোধী দলীয় শিবিরে উপস্থিত ১৫ জন বিরোধী দলনেতারাও একইসুরে কণ্ঠ ভাসিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বৈঠকের আহ্বায়ক বিহার মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডিইউ সুপ্রিমো নীতিশ কুমার জানিয়েছেন, ‘এই বৈঠক কার্যত ঐতিহাসিক। গোটা দেশ এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে। বহু গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এই বৈঠকে উপস্থিত, আগামী দিনে আরও বহু ছোট-বড় দল এই মোর্চায় সামিল হবেন।’
প্রবীণ নেতা ও আরজেডি সুপ্রিমো লালুপ্রসাদ যাদবের দীর্ঘদিন বাদে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন দেখা গেল এই বৈঠকের মাধ্যমে। সূত্রের দাবি, লালুপ্রসাদের বিধান, ‘প্রভাবশালী বড় বিরোধী রাজনৈতিক দলকে রাজ্যে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক৷’ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কংগ্রেসকে ‘হৃদয়বান’ হতে পরামর্শ দেন লালু৷ তিনি এও বলেন, বিহার খুব বড় উদাহরণ মহাগঠবন্ধনের৷ অতীতের মত ভবিষ্যতেও বিরোধী শিবিরের জয়যাত্রা বিহার থেকেই শুরু হবে।’ দলীয় সূত্রের দাবি, এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ারও বিরোধী ঐক্যের পক্ষে সওয়াল করেন। আপ সুপ্রিমো ও দিল্লি মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও বিরোধী ঐক্যের পক্ষে সওয়াল করার পাশাপাশি ‘একের বিরুদ্ধে এক’ ফর্মুলার কথা বলেন৷ তাঁর দাবি- ‘দেশ আগে, দল পরে৷ যখন বিরোধী দলের মধ্যে আসন বিন্যাস করা হবে তখন যেন মাথায় রাখা হয় এই জরুরি বিষয়টি৷’ একটি আসনে বিরোধী দল জয়ী হলে ধরা হোক বিরোধী ঐক্যই জিতেছে, প্রস্তাব দেন কেজরিওয়াল৷ এই সময় কোন বিরোধী দলের সম্প্রসারণের আদর্শ সময় নয়, একবছর কোনও রাজ্যে সম্প্রসারণ করা হবে না, প্রস্তাব অরবিন্দ কেজরিওয়ালের৷ অর্ডিন্যান্স ইস্যুতে কংগ্রেসের সমর্থন চান তিনি৷ অবস্থান স্পষ্ট করার কথা বলেন৷
ডিএমকে প্রধান এবং তামিলনাড়ু মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন বলেছেন, বিভিন্ন রকম জোট হতে পারে, রাজ্য স্তরে, বা সর্বভারতীয় স্তরে৷ রাজ্য স্তরে আলাদা করে আসন ভাগাভাগির কথা ভাবা যেতে পারে, রাজ্যভিত্তিক আসন বিন্যাসের মাপকাঠিতে, দাবি ডিএমকে প্রধানের। শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের দাবি, ‘আমরা বিরোধী নই, আমরা সবাই দেশপ্রেমী, প্রজাতন্ত্র প্রেমী৷ সকলে যেন তা মাথায় রাখেন।’ কাশ্মীরের নেত্রী এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘সবাইকে সামনে তাকাতে হবে৷ মনে রাখতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা সকলে দায়বদ্ধ। এই অন্ধকার শাসনের ইতি হওয়া প্রয়োজন।’ কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ওমর আবদুল্লাহ বলেন, ‘৫৪৩ টি আসনে একের বিরুদ্ধে এক ফর্মুলা না হলেও ৪৫০ টি আসনে করা যেতে পারে এই ফর্মুলা৷ এখন দেশ বাঁচানোর লড়াই, আর লড়তে হবে সবাইকে৷’ সিপিএমের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির দাবি, ‘শুধু জাতীয় বা অন্য ইস্যু নয়, সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়েও ভাবতে হবে বিরোধীদের। মোদি সরকার দেশবাসীকে যেভাবে প্রতারণা করেছে, বঞ্চিত করেছে, তার সুরাহা খুঁজতে হবে।’
এই মর্মে প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধির মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধির দাবি, ‘কারও বিরুদ্ধেই আমার কোনও ক্ষোভ নেই, কারও সঙ্গে আমার কোনও বিদ্বেষ নেই৷ এই বৈঠকে যোগ দিতে এসেছি খোলা মনে, মাথায় কিছু না রেখেই৷ এই বিরোধী ঐক্য বজায় রাখার জন্য কংগ্রেস সব কিছু করবে৷’ রাহুলের দাবি, ‘বিজেপির ফিনান্সিয়াল, ইনস্টিটিউশনাল এবং কমিউনিকেশন মনোপলি আছে, সর্বাগ্রে এটা ভাঙতে হবে৷ বিজেপি যখন আমাদের কাউকে আক্রমণ করবে, তখন সবাইকে একত্রে, একসাথে রুখে দাঁড়াতে হবে৷’
জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হিমালয় প্রদেশের সিমলায় অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় বিরোধী বৈঠক, এবং তৃতীয় বৈঠক হওয়ার কথা চেন্নাইতে। এদিন চার ঘন্টার ম্যারাথন বৈঠকের পর মধ্যাহ্নভোজে মিলিত হন সকলে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজে উপোস করে থাকলেও সবার টেবিলে গিয়ে গিয়ে খাবারের তদারকি করেন তিনি, সবার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন৷ তবে এদিনের বৈঠকে উত্থাপিত হয় অগ্নিগর্ভ মণিপুরের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়েও। মণিপুর দ্বিতীয় কাশ্মীর হতে চলেছে, রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিরোধী নেতারা৷ শনিবার, কেন্দ্রের ডাকা সর্বদল বৈঠকে সকলে একসুরে এই বিষয়ে সোচ্চার হবেন বলে জানা গেছে বিশেষ সূত্রে।