- রামসিংহাসন মাহাতো
শীতগ্রামের শাহজাহানকে দেখেছি স্কুলবেলায়। সাদামাঠা, মৃদুভাষী, গ্রামের ছেলে। আমাদের সঙ্গে পড়ত বিদ্যাচক্রে। ওর তেজ দেখেছি মুখস্থবিদ্যায়। ইংরেজির উনিশটা প্যারাগ্রাফ পরপর মুখস্থ বলে যেতে পারত।
আর আসল শাহজাহানকে দেখেছি ঘরোয়া আটপৌরে ড্রেসে। এক শীতের সন্ধ্যায়, শিলিগুড়ি দীনবন্ধু মঞ্চে। উলিকোটের গেঞ্জি, পাজামা আর মাঙ্কি ক্যাপ পরে কাতরাচ্ছেন। প্রিয়তমার জন্য তাজমহল বানানোর টেন্ডার দিয়ে অফিসারদের অনুরোধ করছেন একটু তাড়াতাড়ি করার জন্য। যাতে মরার আগে প্রিয়তমার স্মৃতিসৌধটা দেখে যেতে পারেন। সরকারি দুর্নীতি, অকর্মণ্যতা, পক্ষপাতিত্ব নিয়ে এনএসডি রেপার্টরি কোম্পানির অসাধারণ নাটক তাজমহল কা টেন্ডার। সারা জীবন মনে রাখার মতো প্রহসন। তাই মনে গেঁথে আছেন শাহজাহান চরিত্রের সেই অভিনেতা।
আর তিন নম্বর সন্দেশখালির শাহজাহানের কথা তো অমৃতসমান। যদিও তাঁকে আমি দেখিনি, চিনিও না। শুধু এটুকু বুঝেছি এই শাহজাহান রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট ভোটের প্রোডাক্ট। এঁরা মানুষের ভোটে বলীয়ান হয়ে মানুষকেই দমিয়ে রাখতে চান। আর এরকম শাহজাহান স্রেফ ভূমিকা বদলে অনেক জায়গাতেই ঘাপটি মেরে আছেন। হাতের কাছে বালুরঘাটের উদাহরণটাই নেওয়া যেতে পারে। পেছনে অদৃশ্য কোনও শক্তির মদত না থাকলে তরুণীকে কি প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করে মারধর করা যায়? দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের ওই তরুণীর অপরাধটা কী? তাঁর সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা করায় প্রতিবাদ করেছেন। কাজ না হওয়ায় থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন। এই অভিযোগ তুলে না নেওয়াতেই তাঁকে মারধর করতে হবে? আর যিনি এটা করতে পারেন তিনিও তো সন্দেশখালির শাহজাহানের মিনি সংস্করণই। অভিযুক্তের দাবি, তিনি নির্দোষ, তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে। সন্দেশখালির শাহজাহানের দাবিও তাই। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। প্রশ্ন হল, কিছু যদি নাই ঘটে থাকে তাহলে সন্দেশখালির মহিলারা অথবা বালুরঘাটের এই তরুণী, শাহজাহানকে অথবা এই মিনি শাহজাহানকে সম্ভ্রমের বাজি রেখে ফাঁসাতে চাইছেন কেন? এসব বিষয় মহামান্য আদালত বিচার করছেন। তাই এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
বরং রক্ত নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তাদের দিকে চোখ ফেরানো যাক। প্রতিদিনকার খবরের কাগজে আমরা নজর রাখলে দেখতে পাব, রক্ত নিয়ে বিশাল চক্র তৈরি করে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের ব্লাড ব্যাংক। আর এই অভিযোগ যে নির্জলা মিথ্যে নয়, তার বড় প্রমাণ সম্প্রতি পুলিশ অভিযান চালিয়ে এক দালালকে গ্রেপ্তারও করেছে। একজন ধরা পড়লেও মেডিকেল কর্তৃপক্ষের ইন্ধন থাকায় দালালরাজ বন্ধ হয়নি। তাই উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসাপাতালের ইস্যু করা রক্তের ক্রেডিট কার্ড থাকলেও ক্যানসার আক্রান্ত মায়ের জন্যে রক্ত পান না ছেলে। কিন্তু দাদার হাত ধরে এলে এবং উপযুক্ত নগদ দিলে অনায়াসেই রক্ত মিলে যায়। আর এই ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ একটা কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা তাদের রক্তের মজুত সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে কিছু জানায় না। উত্তরবঙ্গের সমস্ত হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজে রক্তের জোগানের তালিকা জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত থাকে। কিন্তু একমাত্র উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সেই তথ্য কাউকে জানানো হয় না। অথচ সরকারি নির্দেশিকা রয়েছে মজুত রক্তের তথ্য টাঙিয়ে রাখতে হবে। আর সেজন্যই ডিসপ্লে বোর্ডের ব্যবস্থা। যেখানে ডিসপ্লে বোর্ড নেই অথবা তা খারাপ হয়ে রয়েছে সেখানে কম্পিউটারের একটি প্রিন্ট অথবা কোথাও হাতে লিখেই নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে রাখা হয়। সবাই এই নিয়ম মানে। শুধু উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এই নিয়মের তোয়াক্কা করে না।
সরকারি নিয়মে প্রতিটি ব্লাড ব্যাংকে মজুত রক্তের তথ্য প্রতিদিন নিয়ম করে সরকারি পোর্টালে আপলোড করতে হবে। কেন্দ্র হোক বা রাজ্য এবং সাধারণ মানুষ, সবাই যাতে রক্তের জোগান জানতে পারেন সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু উত্তরবঙ্গ মেডিকেলের আঞ্চলিক ব্লাড ব্যাংকের কোনও তথ্য পোর্টালে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সমস্যা বলে দায় এড়ায় ব্লাড ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারা জানে, মাসের পর মাস এই তথ্য কাউকে না জানালেও তাদের কেউ কিছু বলবে না। ফলে স্টকে কত রক্ত রয়েছে, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অন্ধকারেই থাকেন। আর এই সুযোগেই চলে রক্ত নিয়ে ব্যবসা। মেডিকেল কলেজের তরফে জনসাধারণকে রক্তের তথ্য না জানানোর বিষয়টি যে একটা কৌশল তা মানছেন রক্ত নিয়ে কাজ করা শিলিগুড়ির বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মকর্তারাও। তাঁরা এও মানছেন, মেডিকেলে রক্ত নিয়ে ব্যবসা করছে যে দালালরা তার পেছনে বরাভয় মুদ্রায় দাঁড়িয়ে আছেন কর্তারা। আর এই কর্তাদের পেছনে ধরাছোঁয়া যায় না শুধু অনুভব করা যায় এমন ঐশ্বরিক শক্তির মতো আছে রাজনৈতিক শক্তি। ফলে পাবলিকের অবস্থা এখন মারে হরি রাখে কে?