প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: নয়া সংসদ ভবন ‘বয়কট’ প্রসঙ্গ এখন অতীত। বিরোধী শিবিরে আবারও উঠে এসেছে ভাঙনের আভাস। বিভাজনের দুটি ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি ও রাহুল গান্ধী-মল্লিকার্জুন খড়গের কংগ্রেস। দিল্লি প্রশাসনিক শাসনভার নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্ডিন্যান্স-এর বিরুদ্ধে সংসদীয় পরিসরে সমর্থনের আশায় দেশের শতাব্দী প্রাচিন দল কংগ্রেসের দ্বারস্থ হন ‘আপ’ সুপ্রিমো অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এ নিয়ে আলোচনায় বসতে কংগ্রেস সভাপতি খড়গে ও প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন কেজরি৷ ‘আপ’ সুপ্রিমোর অনুরোধে সাড়া দেয়া আদৌ উচিত হবে কিনা তা খতিয়ে দেখতেই সোমবার দিল্লি এবং পঞ্জাব কংগ্রেসের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন খড়গে-রাহুল। সূত্রের খবর, দুই রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্বই দলের দুই শীর্ষ নেতার কাছে আর্জি জানিয়েছেন, কোনও মতেই যেন আপকে সমর্থন জানানো না হয়।
‘কেজরিওয়ালের সঙ্গে হাত মেলানো উচিত হবে না৷ এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে অদূর ভবিষ্যতে কংগ্রেসের সমস্যা বাড়বে বই কমবে না’, এমনই দাবি সহ কংগ্রেসের একঝাঁক প্রথম সারির নেতা এদিন বৈঠক করেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে এবং রাহুল গান্ধীর সঙ্গে, খবর দলীয় সূত্রে৷ দিল্লি এবং পঞ্জাবের প্রথম সারির কংগ্রেস নেতাদের একটা বড় অংশের এই অভিমত জানার পরে শীর্ষ আধিকারিকদের নিয়োগ ও বদলি ইস্যুতে দিল্লি সরকারের ক্ষমতা খর্ব করে কেন্দ্রীয় সরকারের আনা অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে রাজ্যসভায় ভোট দেওয়া হবে কী না সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে রীতিমত দোলাচলে কংগ্রেস হাইকমান্ড৷ সূত্রের খবর, দিল্লির বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা অজয় মাকেন, শক্তিসিং গোহিল সহ অরবিন্দ লাভলি, হারুণ ইউসুফ, অনিল কুমারের মত কংগ্রেসের এক ঝাঁক প্রবীণ নেতার মনোভাবকে সরাসরি অগ্রাহ্য করতে পারছেন না মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং রাহুল গান্ধী৷ এই মর্মেই অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তাঁর দলকে কংগ্রেস সমর্থন জানাবে কী না সেই সিদ্ধান্তও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে৷ এমনকী আপ সুপ্রিমো তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিজে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে এবং রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চাওয়ার চারদিন পরেও সেই বিষয়ে এখনও কোনও সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়নি৷ বলার অপেক্ষা রাখে না, এই পরিস্থিতিতে খুশির হাওয়া গেরুয়া শিবিরে৷ রাজ্যসভায় কংগ্রেস পাশে না থাকলে আম আদমি পার্টির পক্ষে সরকারের আনা অধ্যাদেশ রোখা কোনওভাবেই সম্ভব হবে না, তা ভালো মতই বুঝতে পারছে বিজেপি শিবির।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সাল থেকেই শুরু আপ বনাম কংগ্রেস লড়াই ৷ সেই সময়ে আপ সুপ্রিমো অরবিন্দ কেজরিওয়াল থেকে শুরু করে সঞ্জয় সিং, মনীশ সিসোদিয়া, সত্যেন্দ্র জৈনের মত আপ নেতারা বিজেপির পাশাপাশি নিয়মিত কংগ্রস নেতৃত্বেরও মুন্ডপাত করতেন৷ আপ-র তোপের হাত থেকে রেহাই পাননি তত্কালীন কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গান্ধীও৷ এখন হিমাচল এবং কর্ণাটকে নিজ ক্ষমতায় সাফল্য পাওয়ার পরে আপ আবার কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে এবং দিল্লি সরকারের ক্ষমতা খর্ব করে নিয়ে আসা অধ্যাদেশ ইস্যুতে রাজ্যসভায় কংগ্রেসের সমর্থন প্রার্থনা করছে৷ গত ১১ মে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছিল, রাজধানীর আমলাদের পোস্টিং ও বদলির ক্ষমতা থাকবে দিল্লির নির্বাচিত সরকারের হাতে। আর তার পরেই গত শুক্রবার রাত এগারোটা নাগাদ অধ্যাদেশ জারি করে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দিল্লির আমলাদের বদলি ও পোস্টিং নিয়ে চূরান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী উপরাজ্যপাল। কেন্দ্রের ওই অধ্যাদেশের বিরোধিতায় সমর্থন জোটাতে আসরে নেমেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতীশ কুমার, শরদ পওয়ার, তেজস্বী যাদব, উদ্ধব ঠাকরেদের সমর্থন আদায়ের পরে কংগ্রেসর সমর্থন চেয়েছিলেন। কিন্তু আপকে সমর্থন জানানোর বিরোধিতায় সরব হয়েছে দিল্লি ও পঞ্জাবের কংগ্রেস নেতৃত্ব। কেননা দুই রাজ্যেই আপের কাছে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে দলকে। বিরোধী জোটের স্বার্থে অবশ্য পুরনো শত্রুতার কথা মনে রাখতে চান না কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। তবুও কেন্দ্রের অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আপকে সমর্থন নিয়ে যাতে দলে কোনও রকম বিদ্রোহ না হয় সে কথা মাথায় রেখে দুই রাজ্যের দলীয় নেতৃত্বকে নিয়ে বৈঠকে বসেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে ও রাহুল গান্ধী।
জানা গেছে, অতীতে আপ নাকি বিজেপিকে প্রকারান্তরে সমর্থন করেছে এবং জম্মু-কাশ্মীর উপত্যকা থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের ইস্যুতে কংগ্রেসের পাশে থাকেনি, রাহুল গান্ধীর সামনে এমন যুক্তিও তুলে ধরেছেন অজয় মাকেন, অনিল চৌধুরীর মত দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতারা৷ আপ ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদানকারী নেত্রী অলকা লাম্বা সরাসরি তোপ দেগেছেন তাঁর প্রাক্তন দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে লক্ষ্য করে যেখানে সবার আগে নিজেদের অবস্থানের জন্য কংগ্রেসের কাছে আপ-কে ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি জানান তিনি৷ আপ-র প্রতি বিদ্বেষপোষণকারী কংগ্রস নেতারা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দলকে বিজেপির ‘বি-টিম’ বলেও অভিযোগ করেছেন৷ এই আবহে চাপ বাড়ছে কংগ্রেস হাইকমান্ডের উপরে৷ দিল্লি, পাঞ্জাবের কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা বড় অংশের প্রবল আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মল্লিকার্জুন খড়গে, রাহুল গান্ধী সহ কংগ্রেস হাইকমান্ড সেদিকেই এখন তাকিয়ে গোটা কংগ্রেস শিবির৷