- সুমন ভট্টাচার্য
সোজা এক থাপ্পড়! মৌলানা ইজাজ আরশাদ কাজমির কাছ থেকে এরকম শারীরিক আক্রমণের বোধহয় প্রত্যাশা ছিল না সুপ্রিম কোর্টের বর্ষীয়ান মহিলা আইনজীবী ফারাহ ফৈয়াজের। বিতর্ক হচ্ছিল ‘তিন তালাক’ নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন নিয়ে। কিন্তু জি হিন্দুস্তানি স্টুডিওতে কেন মুসলিম মহিলাদের জন্য ‘তিন তালাক’ নিষিদ্ধ করা উচিত, এই নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তির অবতারণা করতে করতে কখন যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হয়ে গিয়েছিল তা কারও খেয়াল ছিল না। কিন্তু সেই তর্কবিতর্ক হঠাৎ বদলে গেল শারীরিক আক্রমণে। এখনও ইউটিউবে সার্চ দিলেই ওই ভাইরাল ভিডিওটি সকলের নজরে পড়বেই।
কিংবা ধরা যাক কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া শান্তশিষ্ট মানুষ কনক দেবনাথ যেদিন কলকাতার এক টেলিভিশন চ্যানেলে বিপক্ষে বসে থাকা রাজ্যের শাসকদলের সমর্থক বলে পরিচিত এক প্যানেলিস্টের হাতে আক্রান্ত হয়েছিল। সিপিএমের তরুণ তুর্কি শতরূপ ঘোষ, এখনও মজা করে বলেন, তাঁরা কেউ বুঝতেই পারেননি টেলিভিশন স্টুডিওতে এরকম ‘অ্যাকশন সিক্যুয়েন্স’ ঘটে যাবে। এই পুরোটাকেই রসিকতা মনে করতাম যদি না কনক দেবনাথের ওপর চড়াও হওয়া ওই ‘বিদ্বজন’ একবার প্যানেল ডিসকাশনে আমাকেও দেখে নেওয়ার হুমকি দিতেন!
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে গেরুয়া শিবিরের একদল সমর্থকের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যের জেরে স্বঘোষিত শাসকদলের বুদ্ধিজীবী ‘পাড়ার মোড়ে’ দেখে নেওয়ার শাসানি দিয়েছিলেন।
তাহলে একথা মনে করার কোনও কারণ নেই সিরিয়ালের মতোই টেলিভিশন চ্যানেলের বিতর্কসভা আসলেই ‘সাজানো’, সবাই চিত্রনাট্য অনুযায়ী অভিনয় করে চলেছেন! আর সেটা হবেই বা কী করে? যেখানে চ্যানেলে কে কতটা আগ্রাসী, কার কীরকম পারফরমেন্স, তা অনেক সময়ই রাজনৈতিক কেরিয়ারকে নির্ধারিত করে দেয়। ইউপিএ সরকারের শেষ অর্ধে বিজেপির হয়ে টেলিভিশন চ্যানেলে যেতে যেতেই নির্মলা সীতারামনের উত্থান, প্রথমে রাজ্যসভার সাংসদ হওয়া, তারপরে নরেন্দ্র মোদির সরকার এলে ডেপুটি মিনিস্টার হওয়া। পশ্চিমবঙ্গেও তো শাসকদল তৃণমূলের এমন দুজন মন্ত্রী হয়েছেন, স্নেহাশিস চক্রবর্তী এবং পার্থ ভৌমিক, যাঁরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত টেলিভিশন চ্যানেলের প্যানেলিস্ট ছিলেন।
প্রয়াত অরুণ জেটলি, যিনি একসময় শুধু নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রক থেকে প্রতিরক্ষা দপ্তরের গুরুদায়িত্ব সামলে ছিলেন, তিনি প্রায় দুই দশক আগে একটি ‘কয়েনেজ’ ব্যবহার করেছিলেন, ‘স্পিন ডক্টর’। অর্থাৎ যাঁরা টেলিভিশন চ্যানেলে বসে দলীয় মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময়ই সদালাপী রসিক, পশমিনা শাল এবং ভালো কলমের সংগ্রাহক জেটলি একবার আমায় বলেছিলেন, ‘আসলে মুখ খোলার পর প্রথম ৭ সেকেন্ডেই স্পিন কতটা ‘টার্ন’ নিতে পারে তা বুঝিয়ে দিতে হয়।’ নিজে টেলিভিশনে কাজ করার সুবাদে জানি আসলে জেটলি কতটা ঠিক বলেছিলেন। প্রথম ৭ সেকেন্ডে যদি কেউ দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে, তাহলেই সে তারকা, না হলে সে ফ্লপ। স্বয়ং জেটলি, যিনি বাজপেয়ী জমানায় তথ্য এবং সম্প্রচারমন্ত্রীই ছিলেন, আর পরবর্তীকালে মোদির প্রথম দফায় সরকারের ‘নম্বর ২’, তিনি যদি এই ধরনের ‘বেঞ্চমার্ক’ তৈরি করে দিয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে বুঝে নিতে হবে আজকের রাজনীতিতে টেলিভিশন কতটা গুরুত্ব রাখে।
টেলিভিশন, যাকে আধুনিক ‘পোল স্ট্র্যাটেজিস্ট’ বা ‘ভোট কুশলী’রা ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’ বলে মনে করেন, সেখানে কে কেমনভাবে দলের ঝান্ডা বহন করছে তা গুরুত্বপূর্ণ বলেই তো এনডিটিভি প্রণয় রায়দের হাত থেকে গেরুয়া শিবিরের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আদানিদের হাতে চলে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে এনডিটিভির তৎকালীন মালিক এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে বিজেপি শিবিরের বিরোধ শুরু হয়েছিল এক টেলিভিশন বিতর্ককে কেন্দ্র করেই। এনডিটিভির তৎকালীন জনপ্রিয় সঞ্চালিকা নিধি রাজদানের সঙ্গে বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্রের বাদানুবাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, নিধি গেরুয়া শিবিরের প্রতিনিধিকে স্টুডিও ছেড়ে চলে যেতে বলেন। বিজেপির চাণক্য, তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি এবং বর্তমানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা’র আস্থাভাজন বলে পরিচিত সম্বিত পাত্র এই ‘অপমান’কে সহজে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। তিনি দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছে যে নালিশ করেছিলেন, তারই পরিণতিতে এনডিটিভি আদানিদের হাতে চলে যায় বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
এই সমস্ত উদাহরণ এবং রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে মাথায় রাখলে কখনও মনে করলে চলবে না টেলিভিশন চ্যানেলের রাজনৈতিক বিতর্ক আসলে সাজানো নাটক। আসলে এই বিতর্ক সবসময়ই রাজনৈতিক লুডো খেলা, যেখানে সাপের মুখে পড়ে যাওয়া আছে, আবার মই বেয়ে উঠে যাওয়ার উদাহরণও যথেষ্ট। তাই বলে আমি বলছি না টেলিভিশন চ্যানেলে বিতর্কের আগে বা পরে একসঙ্গে মুড়ি খাওয়া কিংবা বাইরে ধূমপানের বিরতি থাকে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেইসব খুচরো সৌজন্য বিনিময়ের মধ্যেও ওই সাপ-লুডো খেলা থাকে। দক্ষিণপন্থী দলের কোনও তরুণ নেতা হয়তো তাঁর বামপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বীকে বলেন, ‘সেদিন ছ’টার শোতে তোদের নেতা আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করল। আমাকে ‘দাদার লোক’ বলে গাল দিল। এসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টানা কি ঠিক? দ্যাখ, আমিও ওর সেই ভিডিও জোগাড় করে রেখেছি যার জন্য ও পার্টি থেকে সাসপেন্ড হয়েছিল। আরেকবার আক্রমণ করলে সেই ভিডিও দেখিয়ে দেব। তখন ও সামলাতে পারবে তো?’
এই যে সব বাউন্সারের বিরুদ্ধে ‘হেলিকপ্টার শট’ কিংবা ‘এলবো ড্যাশ’-এর পালটা হিসেবে করা ‘ট্যাকল’, এইসবই আসলে টেলিভিশন বিতর্কের চেনা চেহারা বা ‘চোরাস্রোত’। বিতর্ক শুরুর আগে যে দুই মহিলা প্যানেলিস্ট বিরুদ্ধ দলের প্রতিনিধি হয়েও একে অন্যের শাড়ির ডিজাইনের প্রশংসা করেছেন, ক্যামেরার সামনে তাঁরাই যে একে অপরকে চরমতম আক্রমণ করবেন না তার কোনও গ্যারান্টি নেই।
আসলে বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধি হয়ে কারা টেলিভিশন চ্যানেলে আসবেন, সেটা যেহেতু দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে ঠিক করা হয়, সেহেতু একটা ‘মনিটরিং সিস্টেম’ও চালু হয়ে গিয়েছে কে কীভাবে দলকে উপস্থাপিত করছেন তার পরিমাপ নেওয়ার জন্য।
কঠোর শৃঙ্খলার জন্য পরিচিত গেরুয়া শিবির তো বটেই, রাজ্যের শাসকদলও শো শেষ হলে অনেক সময় জানিয়ে দেয় সেদিন তিনি মুখপাত্র হিসেবে কত ‘নম্বর’ পেলেন। এই ‘নম্বর’ দেওয়াটা ঠিক হয় তিনি দলের বক্তব্য, দলের এতদিনের কাজকর্ম বা নির্দিষ্ট ওই বিষয়ে দলের অবস্থানের কথা কতটা তুলে ধরতে পেরেছেন তার উপর নির্ভর করে। প্রতিদিনই যেখানে পরীক্ষায় বসতে হয় এবং সেই পরীক্ষার ফলাফল ঠিক করে দেয় দলীয় নেতৃত্বের চোখে তাঁর ‘র্যাংকিং’ ঊর্ধ্বগামী না নিম্নগামী, সেখানে একজন মুখপাত্র ক্যামেরার বাইরে ব্যক্তিগত রসায়নকে কতটা গুরুত্ব দিতে পারেন?
ছাত্র রাজনীতি থেকে বন্ধু কিন্তু এখন দুই বিপরীত শিবিরের মুখপাত্র। তাই তাঁদেরও ‘দলীয় দস্তানা’ পরেই টেলিভিশন ‘রিং’-এ ঢুকতে হয়। বন্ধু সাংবাদিক যদি দলীয় মুখপাত্র হয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি কেন মাথায় দলের রঙের পাগড়ি বা শাড়িতে দলের প্রতীক লাগিয়ে বাক্যবাণে অন্যদের অস্থির করতে চাইছেন, ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ভুলে গিয়ে তীব্র আক্রমণে যাচ্ছেন, এই প্রশ্ন করে তাঁকে বিড়ম্বনায় ফেলবেন না। কারণ, তিনিও দলীয় ‘নজরদারি’র মধ্যে রয়েছেন। যাকে আজকের রাজনীতির পরিভাষায় ‘মনিটরিং সিস্টেম’ বলা হয়।
(লেখক সাংবাদিক)