অর্ঘ্য বিশ্বাস, ময়নাগুড়ি : টিনের চালা দেওয়া ঘর রয়েছে লক্ষ্মীমোহনের। তবে তাতে ভরসা পান না তিনি। এখন কালবৈশাখীর সময়। যদি হঠাৎ জোরে ঝড়-বৃষ্টি হয়, তাহলে সেই টিনের চালা যে কোথায় উড়ে চলে যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই সেই ভাঙাচোরা ঘরে মাচা বানিয়ে তার তলায় গর্ত খুঁড়েছেন ময়নাগুড়ির চাপগড় গ্রামের লক্ষ্মীমোহন রায়। সেই গর্তই যেন তাঁর কাছে বাংকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় লক্ষ্মীমোহনের তিন ছেলেমেয়ে ও শাশুড়ি মাথা গোঁজেন ওই মাচার তলায় থাকা গর্তেই।
লক্ষ্মীরা আগে থাকতেন আলিপুরদুয়ারে। সেখানে তিনি দিনমজুরি করতেন। কয়েক বছর আগে তাঁর স্ত্রী মারা যান। তারপর সন্তানদের নিয়ে শাশুড়ির কাছে চলে আসেন তিনি। ময়নাগুড়িতে এসেও তিনি দিনমজুরিই করেন। তবে তা থেকে যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ঘর সারানোর কথা ভাবা তো বিলাসিতা! হ্যাঁ, যদি সরকারি আবাস যোজনার ঘর জুটত, তাহলে হয়তো একটা হিল্লে হত লক্ষ্মীদের। কিন্তু সবরকম সরকারি সুযোগসুবিধা থেকেই বঞ্চিত তাঁরা। ঘর মেলেনি, শৌচাগারও নেই।
লক্ষ্মী বলেন, কয়েক বছর আগেই এক ঝড়ে টিনের ছাপড়া ঘরটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর থেকেই আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম, যদি কোনও রাতের ঝড়ে চালা আমাদের উপর ভেঙে পড়ে। সেই আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় খুঁজে বের করেন লক্ষ্মীর শাশুড়ি। তিনিই ঘরের ভেতরে মাটি খুঁড়ে এই গর্ত তৈরি করেন।
তারপর থেকে ঝড়-বৃষ্টি হলেই আগেভাগে সেই গর্তে আশ্রয় নেন লক্ষ্মীরা। ময়নাগুড়ি-পানবাড়িগামী সড়ক সংলগ্ন চাপগড় গ্রাম। সেখানেই লক্ষ্মীমোহনের বাড়ি। বাড়ি বলতে টিনের ছাপড়া ঘর। সেখানে পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থাটুকুও নেই। আছে একটা মাটির কুয়ো। লক্ষ্মীমোহনের কথায়, কয়েক মাস আগে দিদির সুরক্ষা কবচ কর্মসূচি নিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন তৃণমূলের নেতারা। তখন ওদের বাড়ির কথা জানিয়েছিলাম। তারপর অবশ্য স্থানীয় পঞ্চায়েতের তরফে তাঁদের পাশে থাকার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এখনও অবধি ঘরের কোনও ব্যবস্থা হয়নি।
লক্ষ্মীর বড় মেয়ে সুমিত্রা ও ছোট মেয়ে চন্দনা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। ছেলে কৃষ্ণ দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। মায়ের অবর্তমানে বাবা ও দিদার কাছেই বড় হয়ে উঠছে ওরা। লক্ষ্মীমোহনের শাশুড়ি শোভা রায় জানালেন, অল্প হাওয়া দিলেই মনে হয় ঘরের টিন উড়ে চলে যাবে। চালের একাধিক জায়গায় ফুটো রয়েছে। সেখান দিয়ে ঘরে জল পড়ে। নাতি-নাতনিদের যাতে কিছু না হয়, তাই গর্ত খুঁড়েছি।
তাঁদের অসহায় অবস্থার কথা জানতে পেরে বুধবার লক্ষ্মীমোহনের বাড়িতে আসেন ময়নাগুড়ির বিধায়ক কৌশিক রায় সহ অন্য বিজেপি নেতারা। বিধায়ক বলেন, বিষয়টা আমি আগে জানতাম না। আমি ওই পরিবারের পাশে আছি। এদিকে, বিজেপির জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি বাপি গোস্বামী আবার ওই পরিবারের দুর্দশার জন্য প্রশাসনের প্রতি আঙুল তুলেছেন। বলেন, সরকারি প্রকল্পের ঘর যাঁদের প্রাপ্য ছিল, তাঁরা যে বঞ্চিত হয়েছেন, এটাই তার উদাহরণ। যদিও এই অভিযোগ মানতে চাননি তণমূল কংগ্রেসের ময়নাগুড়ি ব্লক সভাপতি মনোজ রায়। তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই ওঁদের ঘর মেরামতির কাজ শুরুর পথে।
কিন্তু এতদিন কোনও কাজ হয়নি কেন? স্থানীয় আমগুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান দিলীপ রায় বলেন, আলিপুরদুয়ার থেকে আসার পর ওই পরিবার রেশন কার্ডের ঠিকানা পরিবর্তন করেনি। তাই কিছুটা সমস্যা হয়েছে। প্রশাসনের তরফে ময়নাগুড়ির বিডিও শুভ্র নন্দীও লক্ষ্মীদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।