- শংকর
এদেশে প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিকথায় স্মরণীয় মানুষদের দেহবর্ণনা খুবই কম থাকে। ফলে, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দর দৈহিক উচ্চতা কত ছিল, গায়ের রং কীরকম, মুখের ভাস্কর্য কীরকম এসব জানতেও হিমসিম খেতে হয়। পশ্চিমের লেখকরা তাঁদের স্বাভাবিক বিচক্ষণতায় নিতান্ত প্রয়োজনীয় এই কাজগুলি প্রথমেই সেরে নেন। এই সমস্যা পরমহংসদেবের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট। সাবধানি মহেন্দ্রনাথও গুরু রামকৃষ্ণের সম্বন্ধে কিছু দৈহিক বিবরণ রেখে গিয়েছেন।
‘শ্রীরামকৃষ্ণের চোখ হইল ক্ষুদ্র যাহাকে বলে- হাতিচোখ। মুখে বিশেষ ওজস্বী ভাব নেই, বাহু-সঞ্চালন অতি ধীর ও করুণাব্যঞ্জক। সাধারণ অবস্থায় কণ্ঠস্বর মৃদু, এক প্রকার কাতর স্বর বলা যাইতে পারে। দেখিলে বোধহয়, যেন জগতের সম্পর্ক হইতে বিশ্লিষ্ট হইয়া স্বতন্ত্র থাকিবার- নিরিবিলি ও একাকী থাকিবার তাঁহার ইচ্ছা, জগৎ যেন তাঁহাকে স্পর্শ করিতে না পারে।’
এরপর মহেন্দ্রনাথের বিশ্লেষণ, শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের বিশেষ লক্ষণ হইল- বহুবিধ স্নায়ু দিয়া বহু প্রকার চিন্তা করা। শক্তি-বিকাশ করা বা যাহাতে ক্ষাত্রশক্তির আবশ্যক, এইরূপ কার্য তাঁহার নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের হইল গভীর চিন্তা করা মুখ্য, শক্তি-বিকাশ করা গৌণ। এইজন্য প্রথম অবস্থায় সাধারণ লোক তাঁহাকে কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া উন্মাদ ও বাতুল বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা করিত।’
শ্রীরামকৃষ্ণের দেহবর্ণনার আরেকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র লাহোর ট্রিবিউনের খ্যাতনামা সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। তিনি ১৮৮১ সালে (যে বছর নরেন্দ্রর সঙ্গে ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাৎ) স্টিমারে রামকৃষ্ণের সহযাত্রী হয়েছিলেন। এই জাহাজের মালিক কেশবচন্দ্র সেনের জামাতা কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ। দক্ষিণেশ্বর ঘাটে পরমহংসদেব তাঁর ভাগ্নে হৃদয়কে নিয়ে জাহাজে উঠলেন, সঙ্গে একধামা মুড়ি ও সন্দেশ। তিনি লালপেড়ে ধুতি ও পাঞ্জাবি পরেছিলেন- পাঞ্জাবির বোতাম খোলা ছিল।
নগেন্দ্রনাথের বর্ণনা, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামবর্ণ ছিলেন। দাড়ি রাখতেন এবং তাঁর চোখ দুটি কখনও সম্পূর্ণরূপে উন্মীলিত হত না- অন্তর্মুখী ছিল। তাঁর দৈর্ঘ্য ছিল মাঝারি। গড়ন ছিল পাতলা, প্রায় শীর্ণ বলা যায় এবং চেহারা ছিল অত্যন্ত ছিপছিপে।… একটু তোতলা ছিলেন, কিন্তু সেই তোতলামি শ্রুতিমধুর ছিল। তিনি খুব সরল বাংলায় কথা বলতেন এবং প্রায়ই আপনি তুমি মিলিয়ে ফেলতেন।’
এই বিবরণ মিলছে না। পরমাপ্রকৃতি সারদামণির স্বামী-বর্ণনার সঙ্গে। শ্রীশ্রী মায়ের কথা বইতে ঠাকুরের চেহারা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘তাঁর গায়ের রং যেন হরিতালের মতো ছিল- সোনার ইষ্ট কবচের সঙ্গে গায়ের রং মিশে যেত। যখন তেল মাখিয়ে দিতাম, দেখতুম সব গা থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে।… যখনই কালীবাড়িতে বার হতেন, সব লোক দাঁড়িয়ে দেখত, বলত, ওই তিনি যাচ্ছেন। বেশ মোটাসোটা ছিলেন। মথুরবাবু একখানা বড় পিঁড়ে দিয়েছিলেন, বেশ বড় পিঁড়ে। যখন খেতে বসতেন তখন তাতেও বসতে কুলাত না। ছোট তেল ধুতিটি পরে যখন থপ থপ করে গঙ্গায় নাইতে যেতেন, লোকে অবাক হয়ে দেখত।’
মঠের আমেরিকান সন্ন্যাসী স্বামী বিদ্যাত্মানন্দ পরবর্তী সময়ে অনেক খোঁজখবর করে লিখেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের দেহের ওজন ও দৈর্ঘ্য লিপিবদ্ধ করা হয়নি। বিদ্যাত্মানন্দ জানাচ্ছেন, ১৯৫৫ সালে ভাস্করকে নির্দেশ দিতে গিয়ে স্বামী নির্বাণানন্দ হিসেব করেছিলেন যে ঠাকুরের দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৯ ১/৪ ইঞ্চি। এই সিদ্ধান্তে আসতে তিনি নির্ভর করেছিলেন ঠাকুরের কোটপরা আলোকচিত্র এবং সেই কোটটি থেকে। কোটটি মেপে এবং কোটটির সঙ্গে আকৃতির সম্বন্ধ হিসাব করে দেহের দৈর্ঘ্য প্রতিপাদন করা হয়েছিল।
স্বামী নির্বাণানন্দ একসময় স্বামী ব্রহ্মানন্দের সেবক ছিলেন। ১৯১৮ সালে উকিল অচলকুমার মৈত্রের পত্নী এক ভক্তিমতী মহিলা ঝাউতলায় কর্মরত এক প্রতিভাবান মারাঠি ভাস্করের স্টুডিওতে গিয়ে মর্মর মূর্তি নির্মাণের দায়িত্ব দেন।
এই মূর্তিটির মডেল অনুমোদন করার জন্য তখনকার প্রেসিডেন্ট মহারাজকে অনুরোধ জানালেন স্বয়ং স্বামী সারদানন্দ। স্বামী ব্রহ্মানন্দ প্রথমে তেমন উত্সাহিত হলেন না। তারপর বললেন, ‘ঠাকুরের কোন মূর্তি অনুমোদন করব? তাঁকে একই দিনে বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে দেখেছি। কখনও দেখেছি তিনি কৃশ ও ক্ষীণকায়, একটি কোণে চুপ করে বসে আছেন। আবার খানিকক্ষণ পরে দেখা গিয়েছে, তিনি দেহ ও বেশভূষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে বিস্মৃত হয়ে সর্বক্ষণ হাততালি দিতে দিতে কীর্তন করছেন। কখনও বা গভীর সমাধিতে নিমগ্ন হতেন, তখন তাঁর মুখমণ্ডল এক স্বর্গীয় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত এবং দেহ থেকে এক দিব্যজ্যোতি বিকীর্ণ হত। কখনও কখনও দেখা যেত তাঁর আকৃতি স্বাভাবিক অপেক্ষা দীর্ঘতর এবং তিনি দক্ষিণের বারান্দার এক প্রান্ত পর্যন্ত বড় বড় পা ফেলে জোরে জোরে পায়চারি করছেন।’
স্বামী সারদানন্দ বিনীতভাবে বললেন, ‘মহারাজ, ঠাকুর যে ছবি সম্বন্ধে নিজে বলছিলেন, যে ঘরে ঘরে পূজিত হবে, আমি সেই ছবির কথা বলছি। তারই প্রতিমূর্তির মডেল তোমাকে অনুমোদন করতে হবে।’
মহারাজ হাসিমুখে উত্তর দিলেন, ‘চলো যাই’। সেইদিন বিকালবেলায় মহারাজকে ঝাউতলা স্টুডিওতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হল। এই উপলক্ষ্যে তাঁর সঙ্গে স্বামী সারদানন্দ, স্বামী শিবানন্দ ও অন্য সাধুরাও গেলেন।
মহারাজ মডেলটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর শিল্পীকে দেখালেন, ‘দেখো তুমি ঠাকুরকে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বসিয়েছ।’ শিল্পী বললেন, ‘মহাশয়, আপনি দেখবেন যদি কেউ এইভাবে পায়ে সামনে হাতজোড় করে বসেন, তাহলে তিনি সামনের দিকে একটু ঝুঁকে যেতে বাধ্য হবেন।’
মহারাজ উত্তর দিলেন, ‘আমরা কখনও ঠাকুরকে এইভাবে বসতে দেখিনি। তুমি যা বলছ তা সাধারণ লোকেদের পক্ষে প্রযোজ্য। কিন্তু ঠাকুরের ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। তিনি দীর্ঘবাহু ছিলেন। হাঁটু পর্যন্ত তাঁর হাত পৌঁছোত।’
প্রেসিডেন্ট মহারাজ এরপর শিল্পীকে ঠাকুরের কান সম্বন্ধে নির্দেশ দিলেন, ‘দেখো, সাধারণ মানুষের কান ভ্রূরেখার উপরে আরম্ভ হয় এবং তুমি ঠাকুরের কান সেইভাবে রূপায়িত করেছে। কিন্তু ঠাকুরের কান ভ্রূরেখার নীচে থেকে আরম্ভ হয়েছিল।’
উপস্থিত সকলে ঠাকুরের চেহারা সম্বন্ধে এইরূপ খুঁটিনাটি বিবরণ শুনে অত্যন্ত আকৃষ্ট হলেন। মহারাজের নির্দেশ অনুসারে ভাস্কর মডেলটি সংশোধন করতে সম্মত হলেন। তিনি বললেন, ‘অনুগ্রহ করে এক সপ্তাহ পরে আসুন, ইতোমধ্যে আমি মডেলটি সম্পূর্ণ করে রাখব।’
এক সপ্তাহ পরে মহারাজ সদলবলে স্টুডিওতে পুনর্বার পদার্পণ করলেন। সংশোধিত মডেলটি দেখে মহারাজ গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ‘এখন এটি অবিকল হয়েছে।’
অন্যদিকে, বিবেকানন্দের নির্ভরযোগ্য দেহবিবরণ দিয়েছেন রোমাঁ রোলাঁ তাঁর ‘বিবেকানন্দের জীবন’ বইতে। তাঁর হিসেব মতো, ‘বিবেকানন্দের ওজন ছিল ১৭০ পাউন্ড। দেহ ছিল মল্লযোদ্ধার মতো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। তাহা রামকৃষ্ণের কোমল ও ক্ষীণ দেহের ছিল ঠিক বিপরীত। বিবেকানন্দের ছিল সুদীর্ঘ দেহ (পাঁচ ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি), প্রশস্ত গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, সুদৃঢ় গঠন, কর্মিনষ্ঠ পেশল বাহু, শ্যামল চিক্কন ত্বক, পরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, সুবিস্তৃত ললাট, কঠিন চোয়াল, আর অপূর্ব আয়ত পল্লবভারে অবনত ঘনকৃষ্ণ দুটি চক্ষু। তাঁহার চক্ষু দেখিলে প্রাচীন সাহিত্যের সেই পদ্মপলাশের উপমা মনে পড়ত। বুদ্ধিতে, ব্যঞ্জনায়, পরিহাসে, করুণায় দৃপ্ত প্রখর ছিল সে চক্ষু, ভাবাবেগে ছিল তন্ময়, চেতনার গভীরে তাহা অবলীলায় অবগাহন করিত, রোষে হইয়া উঠিত অগ্নিবর্ষী, সে দৃষ্টির ইন্দ্রজাল হইতে কাহারও অব্যাহতি ছিল না।’
রোমাঁ রোলাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, ‘বিবেকানন্দের কণ্ঠস্বর ছিল ভায়োলন সেলোঁ বাদ্যযন্ত্রের মতন। তাহাতে উত্থানপতনের বৈপরীত্য ছিল না, ছিল গাম্ভীর্য, তবে তাহার ঝঙ্কার সমগ্র সভাকক্ষে এবং সকল শ্রোতার হৃদয়ে ঝঙ্কৃত হইত।’
এমা কাল্ভে বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন চমত্কার ব্যারিটোনের অধিকারী, তাঁহার গলার স্বর ছিল চিনা গঙের আওয়াজের মতো।’
শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রর প্রথম সাক্ষাৎ কবে কোথায় তা নিয়ে যথেষ্ট মতবিনিময় ও গবেষণা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, প্রথম দর্শন ও প্রথম বাক্যালাপ একইদিনে হয়নি। বিবেকানন্দ জীবনীকার অনেক অনুসন্ধানের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতেই প্রথম দর্শন। রোমাঁ রোলাঁ জানিয়েছেন, এই ভদ্রলোক সংগতিপন্ন ব্যবসায়ী এবং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
সুরেন্দ্রনাথের বাড়িতে নরেন্দ্রনাথ সেবার ভজন গান শোনালেন। নবাগত গায়কের শারীরিক লক্ষণ ও ভাবতন্ময়তা লক্ষ করে শ্রীরামকৃষ্ণ বিশেষ আকৃষ্ট হলেন এবং খোঁজখবর নিয়ে ভক্ত রামচন্দ্রকে অনুরোধ করলেন, একে একদিন দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে যেতে।
ঘোড়ার গাড়িতে সুরেন্দ্রনাথ ও দুজন বয়সের সঙ্গে ১৮৮১ সালের পৌষ মাসে নরেন্দ্রনাথ দত্ত দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হলেন। সৌভাগ্যক্রমে ঐতিহাসিক এই সাক্ষাত্কারের বিবরণ স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব এবং নরেন্দ্রনাথ দুজনেই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। এমন সৌভাগ্য সচরাচর হয় না। অযথা সময় নষ্ট না করে, আমরা স্বামী সারদানন্দ বিরচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ-র স্মরণ নিচ্ছি।
‘‘দেখিলাম, নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য নাই, মাথার চুল ও বেশভুষার কোনওরূপ পারিপাট্য নাই, বাহিরের কোনও পদার্থেই ইতর-সাধারণের মতো একটা আঁট নাই, সবই যেন তার আলগা এবং চক্ষু দেখিয়া মনে হইল তাহার মনের অনেকটা ভিতরের দিকে কে যেন সর্বদা জোর করিয়া টানিয়া রাখিয়াছে। দেখিয়া মনে হইল বিষয়ী লোকের আবাস কলিকাতায় এত বড় সত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভবে!
মেঝেতে মাদুর পাতা ছিল, বসিতে বলিলাম। যেখানে গঙ্গাজলের জালাটি রহিয়াছে তাহার নিকটেই বসিল। তাহার সঙ্গে দুই-চারি জন আলাপী ছোকরাও আসিয়াছিল। বুঝিলাম, তাহাদিগের স্বভাব সম্পূর্ণ বিবরীত-সাধারণ বিষয়ী লোকের যেমন হয়, ভোগের দিকেই দৃষ্টি।
গান গাহিবার কথা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, বাংলা গান সে দুই-চারিটি মাত্র তখন শিখিয়াছে। তাহাই গাহিতে বলিলাম, তাহাতে সে ব্রাহ্মসমাজের ‘মন চল নিজ নিকেতনে’ গানটি ধরিল ও ষোল আনা মনপ্রাণ ঢালিয়া ধ্যানস্থ হইয়া যেন গাহিতে লাগিল- শুনিয়া আর সামলাইতে পারিলাম না, ভাবাবিষ্ট হইয়া পড়িলাম।’’
একই সাক্ষাত্কার সম্বন্ধে স্বামী সারদানন্দ পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিকথাও সংগ্রহ করেছিলেন।