- রণজিৎ দেব
উত্তরবঙ্গের বেশি অংশ রাজার শাসনাধীন ছিল। সেই অংশটুকু যেমন মোগলরা করায়ত্ত করতে পারেনি, তেমন ইংরেজরাও নয়। এই অংশের মানুষ স্বাধীন জাতিসত্তার অস্তিত্বটুকু নিজেরা তৈরি করেছে কিংবা বলা যায় গড়ে উঠেছে। উত্তরবাংলার ভৌগোলিক অবস্থান মানুষকে শিখিয়েছে ভালোবাসা, শিখিয়েছে ভ্রাতৃত্ববোধের কথা। উত্তরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আসলে প্রেম-প্রীতি আর গার্হস্থ্যসুখের চেয়ে কম কিছু নয়।
যখন দেখি, বন আছে গাছ নেই, পাহাড় আছে ঝরনা নেই, মানুষ আছে আহার নেই- বাঙালি হয়েও তখন একটি শব্দবন্ধ মনে পড়ে যায় ‘মৃত্যুময় বেঁচে থাকা।’ যাঁরা চেয়েছিলেন অনভিজ্ঞতার প্রসারিত পৃথিবীতে ফুটন্ত শস্যের শুদ্ধতা ও স্বাভাবিক পূর্ণতা নিয়ে উপভোগ করতে, তাঁরাই আজ বেদনা-নিষিক্ত অভাবিত অনিবার্য পরিণাম ভেবে আঁতকে উঠছেন। ভাবছেন এরকম তো হওয়ার ছিল না! উত্তরবঙ্গ কৃষিজ ও বনজ সম্পদে এগিয়ে থাকলেও কেন বনবাসীরা দালালদের খপ্পরে পড়ে বাস্তুহারা? কৃষকদের মাথায় কেন ছাদ নেই? জাতিসত্তার উপরে কুঠারাঘাত পড়ছে নানাভাবে। যেমন রাজবংশী এবং কামতাপুরি আজ দ্বিধাবিভক্ত। পাহাড়েও তাই, জাতিগত বর্ণগতভাবে এক একটি ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের অধীন। আমরা কি এর উত্তর খুঁজব না? আমরা যে দেখাতে ভালোবাসি নরম লতাগাছের চকচকে ডগা, ভালোবাসি পাহাড়ের পাথুরে প্রান্তর, ঝরনার কলতান, বনভূমিতে জমে থাকা কুয়াশা, প্রতিটি পতঙ্গের গুনগুন গান। আমরা উপলব্ধি করি চা বাগানের দৃশ্যময় জগৎ, উপমা, চিত্রকলা, প্রতীকের অজানা লিপি।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অনেকগুণে বেড়েছে, ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সুযোগ এসেছে। কিন্তু পরিকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। ছাত্র আছে শিক্ষকের অভাব, আবার শিক্ষক আছে ছাত্র নেই। এই পরিস্থিতি ভাবায় বৈকি! গ্রামীণ লাইব্রেরিগুলির প্রায় সবগুলি বন্ধ। দামি দামি বই পোকায় কাটছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে সেভাবে গড়ে উঠল না। সমাজের জন্য দরিদ্র মানুষের কথা জনপ্রতিনিধিরা ভাবেন না। নির্বাচন এলে ভোটের বৈতরণি পেরোতে যা করা দরকার, সেই পরিধিতে আটকে থাকেন। কাজের সুযোগ নেই উত্তরবঙ্গে। তাই হাজার হাজার যুবক ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে কাজের খোঁজে। এই অবস্থা সম্মানজনক নয়।
উত্তরবঙ্গের মানুষ কি নিজেরাই দিগভ্রান্ত, চাহিদার আড়ালে নিজের স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টায় মগ্ন? নাকি তাদের বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টায় ষড়যন্ত্র করছে উপর থেকে অন্য কেউ? উচ্চারিত দাবিকে প্রশমিত করতে কেউ বাড়িয়ে দিচ্ছেন চেয়ারম্যানের পদ, আবার কেউ রাজ্যসভার আসন। উত্তরবঙ্গের মানুষ কি আজ দিগভ্রান্ত, প্রত্যাশা কি অথই জলে নিমজ্জিত, প্রশ্নের পর প্রশ্ন উত্তরের বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে মরছে। দেখতে পাই, একদিকে মেরুকরণের বিভেদপন্থী ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে, ন্যায় ও গণতান্ত্রিকতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নির্মূলের ক্ষেত্রে উদাসীনতা। প্রত্যাশা অনেক, সমাধানের পথ কোথায়? ‘কৃত্রিম শব্দের বনে বাজে কার বিষণ্ণ নূপুর।’
(লেখক সাহিত্যিক। কোচবিহারের বাসিন্দা)