- দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী
এতদিন আমরা জানতাম ‘নৈরাজ্য’ বা অ্যানার্কি শব্দটার দুটো অর্থ হয়। এক হল অরাজকতা, অর্থাৎ যেখানে কোনও নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা বা সরকারের মতো কোনও কর্তৃপক্ষের তোয়াক্কা কেউ করে না, কারণ মানুষ জানেন সরকার বা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষ দুর্বল। আর একটা অর্থ, যা আদর্শগত নৈরাজ্যবাদীদের সৃষ্টি, তা হল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা সরকারের বিলোপ ঘটিয়ে স্বেচ্ছাপ্রসূত সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাজকে সংগঠিত করা।
এখন পশ্চিমবঙ্গে আমরা নৈরাজ্যের একটা তৃতীয় অর্থ দেখতে পাচ্ছি। এই অর্থটা হল, রাজ্য সরকারের এবং পুলিশবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদতে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে দিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সংগঠিত যথেচ্ছাচারকে আমন্ত্রণ করা। যদিও রাজ্যের শাসকদলের নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটছে, মনে হয় না আদালতের এত ক্ষমতা আছে যে এই অবস্থা থেকে রাজ্যকে তারা উদ্ধার করতে পারবে। তার একটা বড় কারণ কেন্দ্রীয় সরকারও সম্ভবত এসব নিয়ে উদাসীন থাকবে।
এই পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সন্দেশখালির ঘটনা। রাজ্যের দক্ষিণতম প্রান্তে বাংলাদেশ লাগোয়া অঞ্চলটিতে শাহজাহান নামে এক ব্যক্তির ভয়ংকর দৌরাত্ম্যের কথা অনেক বছর ধরে মিডিয়ায় প্রচারিত ও আলোচিত হচ্ছিল। হাজার হাজার কোটি টাকার র্যাশন দুর্নীতির তদন্তে সেই ব্যক্তির বাড়িতে ইডি পৌঁছানোর পর বাড়ির লোকেরা নিজেদের তালাবন্দি করে রাখেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে হাজার হাজার মানুষের সংগঠিত জনতা এসে যায়, এবং তারপর তাণ্ডব চালাতে থাকে। স্পষ্টই, দুর্নীতির অনেক প্রমাণ ওই বাড়িতে ছিল, এবং সেইজন্যই এই তাণ্ডব। পুরো ঘটনাকে এক দুর্বৃত্তের বেপরোয়া কার্যকলাপ বলে ধরে নেওয়া যেত, যদি তারপর কতগুলো ঘটনা না ঘটত। একটু খতিয়ে দেখা যাক সেই ঘটনাগুলো কী।
প্রধান দুর্বৃত্ত তো অতিপরিচিত মুখ। আর সেদিন যারা ওই কাণ্ড করছিল, তাদের অনেকের মুখ টিভি ক্যামেরায় বন্দি হয়েছে। কিন্তু তাদের কাউকে ধরার কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। পুলিশের স্থানীয় থেকে শীর্ষ মহল উদাসীন। উলটে তাঁরা ইডির বিরুদ্ধে এফআইআর করেছেন। এর স্পষ্ট অর্থ, রাজ্যে সাংবিধানিক শাসন ভেঙে পড়ছে। কারণ সংবিধান অনুযায়ী সরকারের কর্তব্য হল দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। এমন ঘটনা এই রাজ্যে বা অন্যত্র এই প্রথম ঘটছে তা নয়। উত্তরপ্রদেশে পুলিশের সামনে এক অভিযুক্তকে হত্যা করার ঘটনা আমরা দেখেছি। তাতে অবশ্য রাজ্য সরকারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, কারণ মানুষ দুরাচারীদের হাত থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন, এবং তাঁরা জানেন আইন-আদালত অনেক সময়েই এই ধরনের লোকেদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু এভাবে যে সংবিধান লঙ্ঘিত হয়, তাতে তো সংশয় নেই। এই রাজ্যে যা ঘটছে তাতে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে কি না, তা বলা মুশকিল। কারণ এখন আর এই রাজ্যের মানুষ কী চান, কীসে তুষ্ট হন, তা বোঝা কঠিন।
এখানে যে ভয়ংকর ঘটনা তারপর থেকে দেখা গেল, সেটা আরও বৃহত্তর উদ্বেগের কথা। ঘটনার পর শাসকদলের শিক্ষিত মানুষ এসে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দুর্বৃত্তের পক্ষে সওয়াল শুরু করে দিলেন। এর থেকে একটা বিষয়ই স্পষ্ট হয়। তাহলে মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয়। আর সন্দেশখালি তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন ঘটনা ছোট আকারে তো রাজ্যের সর্বত্র দেখা যায়, এবং শাসকদল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেগুলো সমর্থন করে। কিন্তু এভাবে বিবেকবর্জিত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকলে, এই অবস্থা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা সুদূরপরাহত হয়ে যায়।
এখন যেসব দুষ্কৃতীকে দেখা যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের যে ঔদাসীন্য দেখা যাচ্ছে, তার পিছনে আগের বামফ্রন্ট সরকারের অবদানও তো কম কিছু নয়। সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড, বিজন সেতু হত্যাকাণ্ড, মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড থেকে নেতাই হত্যাকাণ্ড, এমন অসংখ্য ঘটনা বামপন্থীরা গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে তাঁদের জমানার শেষ ভাগ পর্যন্ত ঘটিয়েছেন। তারপরেও রাজ্যের মানুষ তাঁদের বারবার ক্ষমতায় এনেছেন। এখন তৃণমূলও মানুষের থেকে একইভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে। কাজেই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে, এবং সমাজের মধ্যে বিস্তৃত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় এমন ঘটনা যে ঘটবে, তার ইঙ্গিত ছিল সিঙ্গুর আন্দোলন, বিধানসভা আক্রমণ এবং এমন আরও নানা কাজের মধ্যে। সিঙ্গুর আন্দোলনের লক্ষ্য যেখানে হওয়া উচিত ছিল জমি হারানো মানুষের জন্য আরও বেশি ক্ষতিপূরণ আদায় করা, তার পরিবর্তে তা হয়ে দাঁড়াল টাটা গোষ্ঠীকে উচ্ছেদের চেষ্টা। বাধ্য হয়ে রতন টাটা বাংলায় তাঁর স্বপ্নের ন্যানো প্রোজেক্ট বন্ধ করে গুজরাটে নিয়ে চলে গেলেন। সেই সময়ে এইভাবে একজন অতি–প্রভাবশালী শিল্পপতিকে হারিয়ে দিয়ে রাজ্যে এবং পুরো দেশে বহু মানুষ উল্লসিত হয়েছিলেন।
যে জমি আর চাষযোগ্যই নেই, কোনওদিন হবেও না, সেই জমি চাষিকে ফিরিয়ে দিয়ে যাঁরা উল্লসিত হয়েছিলেন, তাঁদের আর যাই বলা যাক প্রগতিশীল মানুষ তো বলা যায় না। শুধু তাই নয়, একটা বিপথগামী আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের একটা বড় সম্ভাবনা নিঃশেষ করে দিয়েছিল।
তারপরেও মানুষ যে ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিল, তার কারণ তারা ভয়ংকর বাম জমানা থেকে মুক্তি চেয়েছিল। মমতা যদি সত্যিই জননেত্রী হতেন, তাহলে তিনি মানুষের জন্য নতুন গণতান্ত্রিক পরিসর খুলে দিতেন। কিন্তু তিনি বামের মডেলটাই অনুসরণ করলেন, আর সেইসঙ্গে তাঁর জমানায় আর্থিক দুর্নীতি একটা ভয়ংকর আকার নিল। সিদ্ধার্থশংকর রায় তাঁর জমানায় দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে নিজের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন বসিয়েছিলেন। কিন্তু তৃণমূল নেত্রী তদন্তকারীদের বিরুদ্ধে হাতাখুন্তি নিয়ে মহিলাদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর অনুগামী মানুষ এখন সেটাই করছেন। সাম্প্রতিক ঘটনাটির অবশ্য তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে এই রাজ্যের বাইরে। বিভিন্ন কেন্দ্রবিরোধী সংবাদপত্র এই ঘটনার কড়া সমালোচনা করেছে। তারা এ কথাও বলছে যে, এই ঘটনা মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কেন্দ্রীয় এজেন্সির ব্যবহারের অভিযোগটিকেও নড়বড়ে করে দিল।
ক্ষমতা মানুষকে এমনভাবে অন্ধ করে দেয় যে কখন কোন রন্ধ্র দিয়ে তার পতনের বীজ প্রবেশ করবে এবং ক্রমে মহীরুহ হয়ে যাবে, তা আর মানুষ বুঝতে পারে না। বামফ্রন্টও পারেনি। নৈরাজ্যকে উৎসাহিত করা হলে পরে আর তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এখন প্রায়দিন তৃণমূলের হাতে তৃণমূলের মানুষ খুন হন। তৃণমূলের বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী ক’দিন আগে নিজের বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন নিজের দলের লোকেদের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে।
তবে এরপরেও এই পরিস্থিতি আরও তিন বছর চলবে না তিরিশ বছর, তা বলা সম্ভব নয়। তার একটা বড় কারণও আছে। এই রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমশই নানা কারণে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে, তা কেন্দ্রীয় সরকার জানে। এবং তারা এ কথাও জানে যে কোনওদিন পরিস্থিতির বিস্ফোরণ ঘটলে সেনা পাঠিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের তিনদিনের বেশি সময় লাগবে না। কারণ পশ্চিমবঙ্গের পাশে পাকিস্তান নেই। আর পশ্চিমঙ্গ তাদের ঢেলে ভোটও দেয় না। কাজেই এই রাজ্য নিয়ে আপাতত কেন্দ্রেরও মাথাব্যথা নেই।
(লেখক সাংবাদিক)