- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
বাবা চলে গিয়েছেন কবে, বহু আলোকবর্ষ দূরের কথা মনে হয়। তার কথা মনে হলে অনেকেরই হয়তো সবার প্রথমে মনে পড়ে জবাকুসুম তেলের আশ্চর্য মায়াময় গন্ধ।
সেই তেল মাখতেন বাবা। তাঁর শরীরের ওমে সেই পারিজাত সম সুবাস। ছড়িয়ে পড়ত বাড়ির বিভিন্ন কোণে। আর মাখতেন গোলাকৃতি মোতি সাবান বা মহীশূর চন্দন সাবান। হাতে থাকত এইচএমভি-র ঘড়ি। ঘোর শীতের মধ্যে রেডিওতে শুনতেন রাত সাড়ে সাতটার দিল্লির খবর, সাতটা পঞ্চাশের স্থানীয় সংবাদ। সঙ্গী এক মারফির রেডিও।
জবাকুসুম তেল আর বেশি দেখা যায় না। লোকে ভুলে গিয়েছে, এশিয়ায় প্রথম তেল নিয়ে বিজ্ঞাপন হয়েছিল জবাকুসুমের জন্য। বানিয়েছিলেন দেশের প্রথম ফিল্মমেকারদের অন্যতম হীরালাল সেন। এইচএমটির বিশাল কারখানা বেঙ্গালুরুর বেল্লারি রোডে প্রায় পরিত্যক্ত পড়ে। মারফি উঠে গিয়েছে। তার মডেল হয়ে যে ছেলেটি হাসত, সে এখন অভিনেত্রী মন্দাকিনীর স্বামী। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন আগে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একদিন আগে আমূলের অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর ভারতে অনেক ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমূলের মতো কোনও ব্র্যান্ড হয়নি।’ আমূলের কথা শুনলে সবার আগে মনে পড়ল আমূল গার্লের কথা। তারপর ধীরে ধীরে আরও অনেক ব্র্যান্ডের কথা ঘুরতে থাকে মাথার মধ্যে। যা হারিয়ে গিয়েছে। যা আর ফিরবে না। যা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছে। মারফির মতো। এইচএমটি ঘড়ি, এইচএমভি ক্যাসেট-রেকর্ডের মতো।
প্রিমিয়ার পদ্মিনী গাড়ি, গোদরেজ আলমারি, ডায়ানোরা বা ওয়েস্টন বা ক্রাউন টিভি, কণিকা ফিল্ম, ক্যাম্পাকোলা। প্রাণের মানুষজন চিরকালের জন্য চলে গেলে যেমন হৃদয়ের, শৈশবের একটা টুকরো চলে যায়, এই ব্র্যান্ডগুলোও তেমন। দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। আরও ভাবা যাক না একটু- যারা ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যাচ্ছে প্রতিযোগিতার টানাপোড়েনে। ডালডা, রাসনা, নিরমা, গোল্ড স্পট, কেলভিনেটর, পলসন…। ওই জন্যই আমূল কিশোরীর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজ হারিয়ে গেলে বুকের মধ্যে কষ্ট হয়। আবার নতুন করে ফিরে এলে স্বজনের প্রত্যাবর্তনের কথা মনে হয়। আমূল কন্যাকে জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতায় ফেলতে পারে মহারাজ বা এশিয়ান পেইন্টসের গাট্টু। গাট্টু আবার অমর কার্টুনিস্ট আরকে লক্ষ্মণের সৃষ্টি।
এখন মানুষের মধ্যে ব্র্যান্ড সচেতনতা এত বেড়ে গিয়েছে যে, গ্রামীণ হাটেও কোনও টি-শার্টের মধ্যে যদি নাইকি, জুতোয় আদিদাসের মতো তিনটি সমান্তরাল দাগ থাকে, তার দাম চড়াৎ করে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। শুনসান জঙ্গলের মধ্যে নাইকির সিম্বল আঁকা শার্ট পরে সাইকেলে যাচ্ছে কোনও তরুণ, এই দৃশ্যটি ডুয়ার্সের দিকেও দেখা, পুরুলিয়াতেও। সে সব অরিজিনাল নয়, তাতে কী?
ব্র্যান্ড এমন এক জিনিস, যা লোকের মনের মধ্যে গেঁথে গেলে ভুল হয়ে যায় মারাত্মক। অনেকে এখনও বলে থাকেন, জেরক্স করে আনতে। কে বোঝাবে, বাক্যতে কত বড় ভুল। এই ভাবেই চিরচেনা হয়ে উঠে কোম্পানিই জিনিস হয়ে উঠেছে ডালডা, ফেভিকল, সার্ফ, বোরোলিন, বাটা, আমূল, মেরি বিস্কুট, রু আফজার ক্ষেত্রে। ৯৫ বছরের বোরোলিন, বাঙালি গৌরমোহন দত্তের বোরোলিন বললে অনেককে মনে করায় শ্রাবন্তী মজুমদারের বিজ্ঞাপনী গান। সে গানও আমূল বালিকার মতো, ভোলা কঠিন।
ব্র্যান্ডের প্রতি টান তরুণ প্রজন্মের কীভাবে বাড়ছে, তার সাক্ষী থাকে প্রত্যেক সন্ধের শপিং মলগুলো। প্রতিটি দোকানেই ভিড়। কোনও ব্র্যান্ডের পোশাক কিনলেই সঙ্গে সঙ্গে তা দেখে ‘ওয়াও’ অভিব্যক্তি। জিনিসটার দাম আকাশছোঁয়া হলে ক্ষতি নেই, জিনিসটা খুব সাধারণ হলেও ক্ষতি নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, স্বাধীনতার পরে আমূলের মতো ব্র্যান্ড দেশে হয়নি। কথাটা স্রেফ বলার জন্য বলা কিনা জানি না। আমূল তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতার ঠিক কয়েক মাস আগে। ১৯৪৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর। তার আগে ব্রিটিশ আমলে বেশ কিছু ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে, যা আজও অটুট অক্ষয় অমর। কয়েকটার নাম লিখি। লিখে আনন্দ অন্যরকম। কয়েকটার নাম লিখলে বোঝা যায়, কাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু আজও একইরকম রয়ে গিয়েছে। এলাহাবাদ ব্যাংক (১৮৬৫) টাটা (১৮৬৮), ডাবর (১৮৮৪), গোদরেজ (১৮৯৭), ভাডিলাল (১৯০৭), পার্লে জি (১৯২৯)।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমূল ভারতীয়দের আত্মনির্ভরতার প্রতীক। একেবারে সত্যি কথা। এই কথার সুর ধরে ব্র্যান্ড ডাইরেক্টরি ডট কমে সেরা দশটি ভারতীয় ব্র্যান্ডের খোঁজ নিতে বসি। চোখে পড়ে, প্রথম দশে রয়েছে টাটা গ্রুপ, ইনফোসিস, এলআইসি, এয়ারটেল, রিলায়েন্স, এসবিআই, মহীন্দ্রা, উইপ্রো, এইচডিএফসি এবং এইচসিএল টেক। জানতে চাইতে পারেন, বিশ্ব ব্র্যান্ড সরণিতে সেরা গ্লোবাল টপ ফাইভে কারা। সেখানে রয়েছে অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যামাজন এবং সামসুং।
দু’বছর আগের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করেছিল, ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া ক্যাম্পেন চালু করবে। প্রচারের অভিমুখ কী হবে? কিছু বিশেষ সেক্টরে রপ্তানিতে জোর দেওয়া হবে। রত্নালঙ্কার, টেক্সটাইল, চা, কফি, শিক্ষা, হেলথকেয়ার, ফার্মা, ইঞ্জিনিয়ারিং। এসবের মধ্যেও নজর থাকবে জিনিসের মান, হেরিটেজ, টেকনলজি, ভ্যালু এবং নতুন ভাবনার ওপরে। সমস্যা হল, ব্র্যান্ড সমুদ্রে ভেসে গেলেও ভারত সম্পর্কে তিনটি ধারণা বিদেশে এখনও পালটায়নি। দেশটায় সর্বত্র দুর্নীতি, পরিকাঠামোর সমস্যা আর আমলাতান্ত্রিক ঢিলেঢালা মানসিকতা।
এখন সরকার বলছে ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া ক্যাম্পেন। ২০০৬ সাল নাগাদ ছিল ‘ইন্ডিয়া এভরিহোয়্যার’ ক্যাম্পেন। সেবার সুইৎজারল্যান্ডের ডাভোসে ছিল বিশ্ব ইকোনমিক ফোরামের অনুষ্ঠান। জুরিখ বিমানবন্দর ঢেকে গিয়েছিল ভারতের পোস্টারে। দ্রুততম গতিতে ফ্রি মার্কেট ডেমোক্র্যাসির নাম ভারত- এসব ছিল লেখা। বিদেশিরা নামলেই তাঁদের কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসাররা উপহার দিচ্ছিলেন পশমিনা শাল। আল্পসের দেশে লাগবে তো! তখনই বিশ্বকে বার্তা দেওয়া হয়েছিল- ভারত এসে গিয়েছে, তাকে আর উপেক্ষা করা যাবে না।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শপিং মলগুলোতে লোকের বন্যা এবং ব্র্যান্ডের আলোকময় দোকান। সেখানে ঢুকলে একরকম সুগন্ধীতে বিদেশ বিদেশ লাগে। দেশে ধনী ও দরিদ্রের ফারাক কতটা, এই সব জায়গায় আরও ফুটে ওঠে। আর বোঝা যায়, ভারতীয় ব্র্যান্ড কীভাবে সব অর্থে বিশ্বজনীন হয়ে উঠছে দিন-দিন। অনেক ব্র্যান্ডেরই নাম শুনলে ভুল করে আজও মনে হয় বিদেশি। ল্যাকমে থেকে জাগুয়ার, লুই ফিলিপে থেকে হাইডসাইন, ওল্ড মংক থেকে লা ওপালা। ভাবুন ভ্যান হিইউসেন, অ্যালেন সোলি, দ্য মিলানো, ফ্লাইং মেশিন। সবই কিন্তু ভারতের। কত ইতিহাস মেখে বসে আছে ব্র্যান্ডগুলো। ওল্ড মংকের গ্লাস নিয়ে সন্ধে থেকে রাত যাঁরা বসে থাকেন, তাঁদের অনেকেই জানেন না, ওল্ড মংকের সঙ্গে জড়িয়ে জালিওয়ানওয়ালা বাগের কুখ্যাত ও ডায়ারের পরিবারের নাম। ডায়ারের বাবা এডওয়ার্ড আব্রাহাম ডায়ার হিমাচস প্রদেশের কসৌলিতে ১৮৫৫ সালে তৈরি করেছিলেন ওল্ড মংকের প্রথম ব্রিউয়ারি।
আমূল দিয়ে শুরু করা হয়েছিল, আমূল দিয়েই শেষ হলে ভালো। ব্র্যান্ডের প্রেক্ষাপটে পরপর দু’বার ভারতে ১৬ নম্বরে রয়েছে আমূল। খাবারের ব্র্যান্ড তালিকার ওপরদিকে ধারেকাছে নেই আমূল ছাড়া। সব ব্যাংক, পেট্রোলিয়াম, টেলিকম, গাড়ি, বিমা বা টাটা-রিলায়েন্স-আইটিসি-আদানির মতো বহুমুখী সংস্থা সেখানে। খাবারের পরিচিত ব্র্যান্ড বলতে ২৯ নম্বরে দেখছি ব্রিটানিয়া, ৩৬ নম্বরে মাদার ডেয়ারি।
এসব দেখলে আমূল কিশোরীর নানা ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞাপনগুলো চোখের মধ্যে ভাসবে। মনে পড়বে প্রথম দিকে আমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ পলসনের পতনের কাহিনী। আমূল গার্ল তৈরি হয়েছিল পলসনের বিখ্যাত বাটার গার্লকে ভেবেই। ১৯৬৭ সেটা। মুম্বইয়ের সিলভেস্টার দ্য কুনহার কোম্পানির আর্ট ডিরেক্টর ইউস্টাস ফার্নান্ডেজ তৈরি করেছিলেন এই বিখ্যাত ম্যাসকট। বহু বিতর্কে জড়িয়েছে এই মেয়ের বিজ্ঞাপনী সংলাপ। তবু পলকা ডট ফ্রক, হাফ পনি টায়েড নীল চুলের কিশোরীর দেশজোড়া আবেদন অটুট আজও। মেয়েটির সঙ্গে ‘আটারলি, বাটারলি’ বিখ্যাত শব্দ দুটো জুড়ে অন্য ছন্দ দিয়েছিলেন ইউস্টাসের স্ত্রী নিশা।
ইউস্টাস চলে গিয়েছেন বছর চোদ্দো হল। তবু ভারতীয় বিজ্ঞাপনী ও ব্র্যান্ডের মহাবৃত্ত ভোলেনি তাঁকে। যেমন ভোলেনি এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজের স্রষ্টা নার্গিস ওয়াডিয়া, স্টেট ব্যাংকের নীল লোগোর কারিগর শেখর কামাট, দূরদর্শনের লোগোর স্রষ্টা দেবাশিস ভট্টাচার্য, হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম-টাইটানের লোগোর শিল্পী সুদর্শন ধীরদের।
ব্র্যান্ড বিশ্বে ভারতের জয়গানের তুফানে আসলে ওই লোগো আর ম্যাসকটগুলো সহযন্ত্রীদের কাজ করে যাবে। চিরদিনের জন্য। সম্পূর্ণ পরিপূরক হয়ে।