Wednesday, May 15, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ডিসেম্বরই বারবার মনে করিয়ে দেয় স্বামীজির ‘শ্রীম’ জেজে গুডউইনকে

ডিসেম্বরই বারবার মনে করিয়ে দেয় স্বামীজির ‘শ্রীম’ জেজে গুডউইনকে

  • পীযূষ আশ

‘নরেন শিক্ষে দেবে’। কথাটি শ্রীরামকৃষ্ণ স্বহস্তে লিখে গিয়েছিলেন। কথাটি কত মোক্ষম আমরা জানি। স্বামীজির রচনা ও বাণী বহু মানুষের প্রেরণা। স্বামীজি বলেছিলেন, তিনি যখন আর স্থূল দেহে থাকবেন না, তাঁর লেখা বইগুলিই কাজ করবে। সেগুলিই পাঠ্য। তাতেই থাকবে দিকনির্দেশ। এগিয়ে চলার পাথেয়।

ঠিকই তো, স্থূল দেহে স্বামীজিকে কতটুকুই বা পাওযা গিয়েছে! শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠরোগ ধরা পড়ল, গুরুভাইদের নিয়ে প্রাণপাত পরিশ্রম শুরু করলেন নরেন্দ্রনাথ। শ্রীরামকৃষ্ণের শরীরত্যাগের পর পরিব্রাজক হয়ে গোটা ভারত তিনি পায়ে হেঁটে ঘুরে ফেললেন। দেখলেন দেশের স্বরূপ, জাতির অবস্থা। এরপর জাহাজে পাড়ি দিলেন আমেরিকার উদ্দেশে। সেখানে নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে হিন্দু ধর্মের বাণী তিনি তুলে ধরলেন শিকাগোর ধর্ম মহাসভায়। আমেরিকাজুড়ে সাড়া পড়ে গেল। ধর্ম মহাসভার পর স্বামীজির দম ফেলার ফুরসত ছিল না। আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন। বক্তৃতা দিয়েছেন পরপর। শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, বোস্টন, ডেট্রয়েট তাঁর বিশ্রাম নেওয়ার জো ছিল না এক মুহূর্ত। কোথাও বক্তৃতা ছিল পূর্বনির্ধারিত, কোথাও আবার শেষমুহূর্তের অনুরোধ। পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই বেদান্তের ক্লাস নিতে হয়েছে স্বামীজিকে।

১৮৯৫ সালে নিউ ইয়র্কে অনুগামীরা অনুভব করছিলেন স্বামীজির অসামান্য বক্তৃতাগুলি নথিভুক্ত করা দরকার। স্বামীজি কোনও লেখা থেকে বক্তৃতা দিতেন না। নির্দিষ্ট বিষয় নিযে বলতেন অন্তর থেকে। বেদান্ত সোসাইটির সদস্যরা ডিসেম্বর মাসে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলেন এক লিপিকরের জন্য। বিজ্ঞাপনের বয়ান ছিল- ‘দ্রুত শর্টহ্যান্ড লিখতে পারেন এমন প্রার্থী যোগাযোগ করুন।’ এই বিজ্ঞাপন দেখে কাজের আবেদন জানালেন ইংরেজ যুবক জোসায়া জন গুডউইন। যিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘে জেজে গুডউইন নামে খ্যাত। বিজ্ঞাপনের জবাবে বেশ দ্রুতই আবেদন করেছিলেন গুডউইন। বেদান্ত সোসাইটিও তাঁকে কাজে বহাল করে নেয়। স্বামীজি ছিলেন থার্টি নাইন স্ট্রিটের ২২৮ নম্বর বাড়িতে। আর গুডউইন ওঠেন কাছে, একই রাস্তার ২৪৭ নম্বর ঠিকানায়। ১৫ ডিসেম্বর থেকেই স্বামীজির কয়েকটি বক্তৃতা টাইপ করার কাজ শুরু করেন জেজে।

গুডউইনের কাজ কেন গুরুত্বপূর্ণ? সংক্ষেপে খুব সুন্দরভাবে উত্তরটি দিয়েছেন বেলুড় মঠের প্রাক্তন সংঘাধ্যক্ষ স্বামী গম্ভীরানন্দ। তিন খণ্ডে স্বামীজির প্রামাণ্য জীবনী ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ও তাঁরই লেখা। ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’-তে তিনি লিখেছেন, গুডউইনের প্রযত্নে স্বামীজীর বক্তৃতারূপ অমূল্য রত্নরাজি আমরা পাইযাছি; নতুবা যে অল্প কয় বৎসর স্বামীজী ইহলোকে ছিলেন, ঐ কালে তিনি নানা কার্যে এতই ব্যাপৃত ছিলেন যে, স্থির হইয়া বসিয়া দার্শনিক গ্রন্থ লিখিবার মতো অবসর পাওয়া মোটেই সম্ভব ছিল না।’ সেই হিসেবে বলতে গেলে ঠাকুরের বাণী যেমন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন শ্রীম, তাঁর অসামান্য ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ গ্রন্থে, তেমনই গুডউইন ছিলেন বিবেকানন্দের শ্রীম বা মাস্টারমশাই।

অন্তত দুজন গুডউইনের আগে স্বামীজির স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। একজন স্বামী কৃপানন্দ। তিনি সম্ভবত স্বামীজির দ্রুতগতির বক্তৃতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেননি। আর দ্বিতীযজন বক্তৃতার আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। ফলে তাঁকেও সরে যেতে হয়। গুডউইনের সুবিধে ছিল তিনি প্রশিক্ষিত স্টেনোগ্রাফার। ফলে দ্রুত শর্টহ্যান্ড লিখতে তাঁর কোনও অসুবিধে হয়নি। আর তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন চার্চের সঙ্গে যুক্ত। অনুমান করা যায়, ধর্ম সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানাবোঝা তাঁর জিনের মধ্যেই ছিল।
এখানে খুব সংক্ষেপে গুডউইনের ছোটবেলার সম্পর্কে দুচার কথা বলে নেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তাঁর জন্ম ১৮৭০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, ইংল্যান্ডের বাথইস্টনে। অল্প বয়সেই তিনি শর্টহ্যান্ড লেখার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং সাংবাদিকতা শুরু করেন। সাংবাদিকতার কাজে গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু খুব যে সফল হয়েছিলেন, বলা যায় না। এরপর তিনি পাড়ি দেন আমেরিকায়, ভাগ্যান্বেষণে। স্বামীজির সঙ্গে তাঁর যখন দেখা হল, গুডউইনের বয়স ২৫।

জোসায়ারা ছিলেন তিন ভাইবোন। বোন সারার জন্ম ১৮৭২ সালে। পরের বছর গুডউইনের অন্য ভাইয়ের জন্ম হয়। নাম বেঞ্জামিন। সারার নাতনি মার্গারেট মার্কলে ফ্যামিলি হিস্টোরিয়ান হিসেবে তাঁদের পরিবারের ইতিহাস বেশ কিছুটা লিখে গিয়েছেন। উল্লেখ করা দরকার, গুডউইনের সুবাদে স্বামীজির বাণী আমরা ছাপার অক্ষরে পেলেও, তাঁর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধান এখনও পর্যন্ত হয়নি। পরিব্রাজিকা ব্রজপ্রাণার লেখা ‘মাই ফেইথফুল গুডউইন’ তাঁর সম্পর্কে একমাত্র বই। তবে এটিকে বই না বলে, পুস্তিকা অভিহিত করাই শ্রেয়। তবে স্বামীজির মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের লন্ডনে বিবেকানন্দ বইয়ে গুডউইন সম্পর্কে অনেক তথ্য রয়েছে। এছাড়া মেরি লুই বার্ক পাশ্চাত্যে বিবেকানন্দ সিরিজের বেশ কয়েকটি খণ্ডে কিছু তথ্য সন্নিবিষ্ট করেছেন। স্বামী যোগেশানন্দ গুডউইনের জীবন ও পরিবার নিয়ে বেশ কিছুটা কাজ করেছেন। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-বেদান্ত সাহিত্যে আরও কিছু প্রকাশনায় বিচ্ছিন্নভাবে গুডউইন সংক্রান্ত তথ্য মেলে।

গুডউইনের মৃত্যু ১৮৯৮ সালের ২ জুন। অর্থাৎ তাঁর জীবৎকাল মাত্র সাতাশ বছরের। এর মধ্যে তিন বছরের মতো তিনি স্বামীজির সঙ্গ পেয়েছিলেন। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন মারফত নিযুক্ত এক ইংরেজ যুবক কীভাবে বিবেকানন্দের ডানহাত হয়ে উঠেছিলেন, সে সম্পর্কে জানা যাবে স্বামীজির কয়েকটি চিঠি পড়লেই। যেমন, ১৮৯৫ সালের ২০ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক থেকে স্বামীজি তাঁর দক্ষিণ ভারতের ভক্ত আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লিখছেন, ‘ভক্তিযোগের কপি আগে থেকেই পাঠাচ্ছি। কর্ম সম্পর্কেও একটি বক্তৃতা পাঠালাম। এরা (নিউইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটি) এখন একজন সঙ্কেত-লিপিকর নিযুক্ত করেছে, ক্লাসে আমি যা কিছু বলি, সে সেগুলি টুকে নেয়। সুতরাং এখন তুমি পত্রিকার জন্য যথেষ্ট রসদ পাবে। এগিয়ে চলো।’
একইভাবে পরের বছর ১০ ফেব্রুযারি মেরি হেলকে স্বামীজি লিখছেন, ‘নিউইয়র্কে আমার তিনটি বক্তৃতা সংক্রান্ত কিছু পুস্তিকা পাঠিয়েছিলাম। এই সভায় প্রদত্ত রবিবারের বক্তৃতাগুলি আজকাল সাঙ্কেতিকলিপিতে নেওয়া হচ্ছে। পরে ছাপা হবে।’ আবার ২৯ ফেব্রুয়ারি মিস্টার স্টার্ডিকে লিখছেন, ‘সাঙ্কেতিক লেখক গুডউইন একজন ইংরেজ। সে আমার কাজে এতটা আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েছে যে, আমি তাকে ব্রহ্মচারী করে নিয়েছি। সে আমার সঙ্গে ঘুরছে। আমরা একসঙ্গে ইংল্যান্ডে যাবো। সে বরাবরের মতো আমার খুব কাজে লাগবে।’

১৮৯৬ সালের ২৮ অক্টোবরের এক চিঠিতে দেখা যাচ্ছে গুডউইন হযে উঠেছে স্বামীজির নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। গুডউইন যে আধ্যাত্মিক পথেরই পথিক হতে চান, তার ইঙ্গিতও রয়েছে চিঠিতে। স্বামীজি লন্ডনের ৩৯ ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের ঠিকানা থেকে আলাসিঙ্গা পেরুমলকে এক দীর্ঘ চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ‘খুব সম্ভব সেভিয়ার দম্পতি, মিস মুলার আর গুডউইনকে নিয়ে আমি ভারতে ফিরব। সেভিয়ার দম্পতি মনে হয় কিছুদিন আলমোড়ায় বাস করার জন্য যাচ্ছেন। আর গুডউইন সন্ন্যাসী হবে। সে আমার সঙ্গেই ভ্রমণ করবে। আমাদের সব বই-এর জন্য আমরা তার কাছে ঋণী। আমার বক্তৃতাগুলি সে সাঙ্কেতিক প্রণালীতে লিখে রেখেছিল, তাই থেকে বই হয়েছে। কিছুমাত্র প্রস্তুতি ছাড়াই মুহূর্তের প্রেরণায় এ সকল বক্তৃতা দেওয়া হয়েছিল। অপরেরা হোটেলে বাস করতে চলে যাবে। কিন্তু গুডউইন আমার সঙ্গে থাকবে।’

গুডউইনের মৃত্যু ভারতে। ১৮৯৮ সালের মে মাসে তিনি উটিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। জুন মাসের দুই তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়। স্বামীজি তখন আলমোড়ায়। মৃত্যু সংবাদ শুনে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘আমার ডানহাতখানি চলে গেল। এ আমার অপূরণীয় ক্ষতি।’ ভগিনী নিবেদিতার লেখায় পাওয়া যায়, স্বামীজির কাছে এই শোক-সংবাদ অসহনীয় হয়ে ওঠে। আলমোড়া ছেড়ে তিনি আবার পরিব্রাজনে বের হন।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

IPL-2024 | গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে জিতল দিল্লি, লখনউকে হারিয়ে প্লে অফের আশা বাঁচিয়ে...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ঘরের মাঠে জয় দিয়ে আইপিএলের গ্রুপ লিগের যাত্রা শেষ করল দিল্লি ক্যাপিটালস। মঙ্গলবার কোটলায় টস হেরে শুরুতে দিল্লি ক্যাপিটালসকে ব্যাট...

Narendra Modi | নরেন্দ্র মোদি লাখপতি নন, নেই বাড়ি-গাড়ি, প্রধানমন্ত্রীর সম্পত্তির পরিমান কত?  

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ মঙ্গলবার বারাণসীর বিজেপি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আর মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর প্রকাশ্যে এল তাঁর সম্পত্তির খতিয়ান।...

Kylian Mbappe | রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়ার আগে বড় স্বীকৃতি! এবারও ফ্রান্সের বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ পিএসজি ছেড়ে এবার কিলিয়ান এমবাপে পাড়ি দিচ্ছেন রিয়াল মাদ্রিদে। গত সাত বছর ধরে পুরোনো দলকে অনেক কিছুই দিয়েছেন। কিন্তু নিজের...

Bangladeshi tourist dead | গাড়ি রোহিনীতে উঠতেই শ্বাসকষ্ট শুরু বাংলাদেশি পর্যটকের, কিছুক্ষণেই সব শেষ

0
দার্জিলিং: দার্জিলিংয়ের (Darjeeling) পথে মৃত্যু হল এক বাংলাদেশি পর্যটকের (Bangladeshi tourist dead)। মৃতের নাম শেখ আজিজুল (৬৫)। বাড়ি বাংলাদেশের (Bangladesh) ঢাকায়। মঙ্গলবার গাড়িতে করে...

Gajole | জল জীবন মিশন প্রকল্পের পাইপ চুরির চেষ্টা, হাতেনাতে ৭ দুষ্কৃতীকে পাকড়াও করল...

0
গাজোলঃ জল জীবন মিশন প্রকল্পের পাইপ চুরি করতে এসে হাতেনাতে পাকড়াও হল সাত দুষ্কৃতী। দুষ্কৃতী দলের পাশাপাশি পুলিশ আটক করেছে পাইপ বোঝাই একটি ট্রাক...

Most Popular