- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের প্রথম কামরায় গিয়ে দাঁড়ালে চৌকোনা কাচের ফাঁকে চোখে পড়ে, কীভাবে রেললাইনগুলো সরে সরে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। একশো দশ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন গেলে যা হয়, সামনের সবকিছু দেখতে হাতে থাকে কয়েক সেকেন্ড মাত্র।
এই মুহূর্তে আবার সেখানে দাঁড়ালে কিছুই দেখা যায় না। হলুদ সর্ষেখেতের পাশে কী সবুজ বৈপরীত্য নিয়ে হাজির চায়ের খেত, সদ্য লাগানো ধান চারা। ভুট্টার খেতের পাশে উঁকি মারছে আলুর সবুজ রং। অথচ কিছুই দেখা যায় না। দিগন্তজুড়ে শুধু কুয়াশা, কুয়াশা। প্রতিদিনের মতো পাখির দল নিজস্ব নিয়মে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ বানিয়ে উড়ে যায় ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সব পাখিকেও দেখা যায় না ট্রেনের জানলা থেকে। কুয়াশা ঢেকে দিয়ে যায় তাদের।
ঢেকে দিয়ে যায় মহানন্দার জলও। মালদা থেকে শিলিগুড়ি যেতে পাঁচবার পেরোতে হয় মহানন্দার ব্রিজ। বাংলায় কোনও নদী এত কম দূরত্বের মধ্যে এতবার রেললাইন পেরিয়েছে বলে জানা নেই। শিলিগুড়ি, হাপতিয়াগছ বা বারসইয়ের কাছে সে নদীতে তেমন জল নেই। একলাখীর কাছে কিছুটা জল। মালদায় অনেকটাই। অথচ এত কুয়াশার মাঝে মহানন্দার জলের ফারাক বোঝা যায় না কিছুতেই। রেললাইনের গা ঘেঁষে মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে তালগাছ। জানলা দিয়ে তাকালে সেগুলোও ভালো করে বোঝা যায় না। এত ঘন কুয়াশা!
অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দিগন্তের মাঝখানে ছুটে চলে ট্রেন। এবং তখনই মনে হয়, এমন কুয়াশার মাঝেই কি আমাদের এখন বেঁচে থাকা? কোন পথে যাব বলে কুয়াশার মাঝে যেমন বিভ্রান্তির মাঝে পড়তে হয়, এখনও কি ঠিক সেই মুহূর্ত হাজির দেশবাসীর কাছে? সংবাদ সংস্থা পিটিআই আগ্রার ছবি পাঠায়। দেখি, কুয়াশায় ঢাকা তাজমহলের সব মিনার প্রায় অদৃশ্য। নয়াদিল্লির ছবি আসে। দেখি, ইন্ডিয়া গেট থেকে চোখে পড়ে না রাষ্ট্রপতি ভবনের চুড়ো।
এত কুয়াশা কোনও নতুন পথের সন্ধান দেয় না যে! এ যেন বিভ্রম ও বিভ্রান্তির কুয়াশা। দেশের শাসকদল দেশের হৃৎপিণ্ডে রাম মন্দির তৈরি নিয়ে চরম ব্যস্ত। লক্ষ লোক যাচ্ছে অযোধ্যায় রামভূমির স্পর্শ পেতে। এত আবেগ- তাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। দেশের প্রধান বিরোধী দল আবার পূর্ব থেকে পশ্চিমে হাঁটা শুরু করেছে। এই যাত্রায় আবার অন্যরকম আবেগ। কে কার প্রচারের আলো কেড়ে নিতে পারে, তারই যেন অদৃশ্য লড়াই। এর মাঝে রাজ্যের শাসকদল রাম মন্দির উদ্বোধনের দিনই সংহতি মিছিলে পথে নামছে। বামেরা শনিবারই বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রতিবাদী মঞ্চে।
রাম নিয়ে দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় সরকার পোষিত মহোৎসবের মাঝে একটা প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়। দেশে রামের তুলনায় হনুমানের মন্দিরই কি বেশি নয়? কেন এতদিন রাম অনাদরেই পড়েছিলেন তা হলে? যদি রাজ্য ধরে ধরে বিচার করা যায়, তাহলে হয়তো সর্বত্রই দেখব, মন্দিরের বিচারে রামকে অনায়াস হারিয়ে দিয়েছেন হনুমান। আপনারও চলার পথে দেখুন, রাস্তার ধারে কোথাও না কোথাও জায়গা করে নিয়েছেন হনুমান। রাম নেই।
রাম নয়, ন্যায় নয়, সংহতি নয়, বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ নয়। সবার আগে অন্য কিছু। সবারই ইষ্টদেবতা এখন ভোটেশ্বর। মানুষকে কুয়াশার মধ্যে ফেলে রেখে। এত কুয়াশার ভিতরে অনেক বড় হয়ে ওঠে জীবনানন্দের কবিতা। সেটা যেন ভারতীয় ভোটারদের কথা হয়েই ঝরে পড়ে। ‘একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;/হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন–গিয়েছে যে শান-হিম ঘরে,…।’
কুয়াশা কোথায় নেই হে, ভোটেশ্বর যেন প্রশ্ন করেন স্বপ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে।
এবং চারদিকে তাকিয়ে দেখি, কুয়াশা-কুজঝটিকা-কুহেলিকা, যাই বলুন না কেন, এসবই সর্বত্র ছড়িয়ে। গত কয়েকদিন শুধু উত্তরবঙ্গের কিছু খবরের কোলাজ তৈরি করা যাক। সেখানে ঘোর সামাজিক কুয়াশা।
শিলিগুড়িতে সেদিন এক বৃদ্ধ দম্পতি তাঁর প্রয়াত পুত্রের শিশুসন্তানকে বিক্রি করে দিলেন পুত্রবধূকে মিথ্যে বলে। বেলাকোবায় এক দম্পতি তাঁদের সাত মাসের সন্তানকে বিক্রির চেষ্টা করে ধরা পড়ে গেল।
পুরাতন মালদায় ল’ কলেজের অধ্যক্ষ ক্লাস নাইনের ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করল ফাঁকা এলাকায় নিয়ে। সেখানেই ক্লাস এইটের ছাত্রীর গলায় ছুরি চালাল এক তরুণ। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায়। রায়গঞ্জে ছেলে মদ খাওয়ার টাকা চেয়েছিল। তা না দেওয়ায় বাবাকে মাছ কাটার বঁটি দিয়ে খুন করতে গেল ছেলে। সেদিনেরই খবর, মালদার চাঁচলে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কিশোরীর অর্ধনগ্ন ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তারই এক বন্ধু ও বান্ধবী।
যাচ্ছি কোথায়, এই ঘন কুয়াশায়? শীতের কুয়াশা তবু একদিন চলে যায়। এই সামাজিক কুয়াশা তো আঁধার হয়ে ঘিরে ধরে।
উত্তর দিনাজপুরে হেমতাবাদের ঘটনা আরও ভয়ংকর। পরপর দুটি কন্যাসন্তান হয়েছিল বাইশ বছরের এরশাদ আলির। সেই ‘অপরাধে’ মাথায় রড মেরে তরুণী স্ত্রী নাসরিন খাতুনকে খুন করতে গিয়েছিল সে। স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও দেখি, কন্যাসন্তান হওয়ার জন্য কীভাবে অত্যাচারের মুখে পড়ছে মা। কত ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করছে মা-বাবার ওপর অভিমানে। কী, না দাবি অনুযায়ী স্মার্টফোন কিনে দেওয়া হয়নি। এই তো বৃহস্পতিবার রায়গঞ্জের কর্ণজোড়ায় মোবাইল কিনব বলে জেদ করছিল ছেলে। বাবা বলেছিলেন, যেভাবে বলা উচিত, সেভাবেই বলেছিলেন, ‘এখন পড়াশোনা করো মন দিয়ে। বড় হলে দেব।’ অভিমানে ক্লাস সেভেনের ছেলে ক্যারাটের বেল্ট দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করল। ওদিকে আবার অনেক স্কুল ছাত্রী টাকা রোজগারের জন্য ইনস্টাগ্রামে নিজেদের ছবি দিয়ে বেড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত শিকার হচ্ছে তথাকথিত প্রেমিকের, যারা অশ্লীল ছবি ফাঁস করে স্পষ্ট ব্ল্যাকমেল করছে। কোথাও স্কুলে লোডেড পিস্তল নিয়ে ঢুকছে ছাত্র, কোথাও নকল পিস্তল।
কী লিখব, কী লিখব ভাবতে গিয়ে হতাশায় আবার লিখি। যাচ্ছি কোথায়, এই ঘন কুয়াশায়? শীতের কুয়াশা তবু একদিন চলে যায়। এই সামাজিক কুয়াশা আরও আঁধার হয়ে ঘিরে ধরে। এত কুয়াশা কেন, কেন এত কুয়াশা?
শিলিগুড়িতে বুধবারই চারু মজুমদারের মূর্তির সামনে দুই তরুণের হাতে যৌন হেনস্তার শিকার হলেন এক পাহাড়ি তরুণী। শহর নিরুত্তাপ। আরও মর্মান্তিক মহিলা পুলিশ থানার ভূমিকা। সুয়োমোটো কেস না করে তারা চেপে যেতে চাইল ব্যাপারটা। তরুণীকে কোথায় ভরসা দেবে, তা নয়, এমন কথা বলল যে তিনি শহর ছেড়ে চলে গেলেন। এই জন্য কি রাজ্যজুড়ে মহিলা পুলিশ থানা তৈরি হচ্ছে? এভাবে খবর চাপার কাজ তাদের? পুলিশ এসে ক্রিকেটার রিচা ঘোষের বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে গেল, দুই তরুণের নোংরামি। তাদের ধরা তো হলই না, এখন বলা হচ্ছে, এমন তো কিছুই হয়নি। বাম জমানায় এই ধরনের একটা বাক্য নিয়েই হইচই হয়েছিল না?
কোনও রাম আরাধনা, কোনও ন্যায় যাত্রা, কোনও সংহতি যাত্রা বা ফ্যাসিবাদবিরোধী মঞ্চ কোথাও এসব বন্ধ করতে পারবে না। গোটা ভারতজুড়েই এসব কুহেলিকার দৃশ্য আমরা দেখে যাব এখন।
এসবের মাঝেই শুক্রবারের কাগজে একটি খবর মন ভালো করে দেয়। আবার পড়তে পড়তে ভাবি, এটা ঠিক মন ভালো করার খবর, না, কুয়াশায় আরও ভরিয়ে দেওয়া খবর?
স্বাধীনতার পরে প্রথম বিদ্যুৎ এল অসম-বাংলা সীমান্তে ফলিমারির তিনটি গ্রামে। এটা এমন দুর্গম জায়গা, যেখানে অসমের গ্রামে বাংলা থেকে বিদ্যুৎ দিতে হবে। আবার বাংলার গ্রামে বিদ্যুৎ দিতে হবে অসম থেকে। এই নিয়ে টানাপোড়েনের জন্য ৭৭ বছর ধরে আলোই আসেনি এলাকায়। জগদীপ ধনকরের উপরাষ্ট্রপতি পদে পুনর্বাসন নিয়ে দার্জিলিংয়ে বৈঠক করতে পারেন বাংলা ও অসমের সক্রিয় দুই মুখ্যমন্ত্রী। অথচ এত যুগ ধরে অন্ধকারে পড়েছিল এত গ্রাম। কারও একসঙ্গে কাজ করে এঁদের আলোয় আনার কথা মাথায় আসেনি। এ খবর আলোর নয়। আঁধারের। কুয়াশার। লজ্জার।
ওই ভাবেই আমাদের লজ্জা জাগিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে নদীর ধারে পড়ে আছেন কত গ্রামের মানুষ। যাতায়াতের কী সমস্যা! জীবনযাপনের কত জটিলতা! কেউ ভাবেনি, কেউ ভাবে না। আমরা সাংবাদিকরাও আর গুরুত্ব দিই না, এই প্রান্তিক মানুষগুলোর যন্ত্রণাকে। একই কথা শুনব–আরে এ আর নতুন কী? বহুদিন ধরে তো লেখা হচ্ছে!
কোনও রাম আরাধনা, কোনও ন্যায় যাত্রা, কোনও সংহতি যাত্রা, কোনও বুদ্ধিজীবী মঞ্চ সমাজের এমন ঘন কুয়াশা মুছে দিতে পারবে? না বোধহয়।