Sunday, May 5, 2024
Homeকলামকর্মীদের সঙ্গে সংঘাতে স্পষ্ট সরকারের দিশেহারা দশা

কর্মীদের সঙ্গে সংঘাতে স্পষ্ট সরকারের দিশেহারা দশা

  • গৌতম সরকার

শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব সম্প্রতি ক্ষমা চেয়েছেন তাঁর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের কাছে। ওই ওয়ার্ডের কিছু অংশে পুরনিগমের সরবরাহ করা জল পৌঁছোচ্ছে না কোনও কারিগরি কারণে। খোদ মেয়রের ওয়ার্ডে সমস্যার সমাধানে দেরি হলে জন অসন্তোষ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। গৌতম সেই আঁচ পেয়ে দেরি না করে ওয়ার্ডবাসীর কাছে নতজানু হয়েছেন। তিনি জানেন, এতে পুরোপুরি প্রশমিত না হলেও ক্ষোভে কিছুটা রাশ টানা যায়।

কাটু টু নবান্ন। সরকারি কর্মীদের উদ্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি যে ভাষায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন, তাতে সহনশীলতার বালাই ছিল না। কার্যত কর্মচারীদের শাস্তি দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। আইনের ৫৬-জে ধারা প্রয়োগ করবেন বলেছেন যাতে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কর্মীদের বাধ্যতামূলক অবসরগ্রহণের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সরকারি কর্মীরা সবসময় প্রশাসনের মূল স্তম্ভ। সরকারের বিভিন্ন নীতি বা সিদ্ধান্ত রূপায়ণে মুখ্য ভূমিকা তাঁদেরই। তাঁরা বেঁকে বসলে সরকার চালানো কঠিন হয়।

আবার কর্মীরা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে, কাজে গাফিলতি করলে তার দায় সরকারের ঘাড়ে চাপে, বদনাম হয় সরকারের। ফলে কর্মীদের ওপর কড়া নজরদারি থাকা দরকার সরকারের।

আবার তাঁদের দাবিদাওয়ার প্রতি সহনশীলতা থাকাও বাঞ্ছনীয়। যদিও সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকলে কর্মীরা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। বামফ্রন্ট জমানা তার বড় নজির। সেসময় সরকারি দপ্তরে আধিকারিকরা নন, শেষকথা বলার অধিকারী ছিলেন রাজ্য কোঅর্ডিনেশন কমিটির নেতারা।

সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভোগ করার স্বার্থে বামফ্রন্ট সরকারকে সংগ্রামের হাতিয়ার করার স্লোগানের আড়ালে কর্মচারী নেতৃত্ব সরকারকে চোখের মণির মতো রক্ষা করত। সিপিএম আবার এই নেতাদের মাধ্যমে প্রশাসনে নজরদারি করত, লাগাম রাখত।

অফিসাররা নন, কর্মচারীরাই ছিলেন সরকারের চালিকাশক্তি। যদিও জমানার শেষদিকে সেই লাগাম আলগা হতে থাকে। বিভিন্ন নির্বাচনে সরকারি কর্মীদের পোস্টাল ভোটগণনায় তৃণমূলের প্রতি গোপনে সমর্থন বৃদ্ধির ইঙ্গিত মিলতে শুরু করে।

কিছু নেতা সরকারকে আগলে রাখলেও সাধারণ কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছিল। বামফ্রন্ট যুগ অবসানের নেপথ্যে সেই অসন্তোষ অন্যতম কারণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ব্যবস্থাটা আমূল বদলে দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি কর্মীদের বদলে অনেক বেশি অফিসার নির্ভর হয়ে উঠলেন। শুধু প্রশাসনে নয়, নিজের দলের নানা বিষয়ে নাক গলানোর ঢালাও অধিকার দিলেন আধিকারিকদের। আলিপুরদুয়ার জেলার প্রাক্তন এক জেলা শাসককে আড়ালে-আবডালে দলের জেলা সভাপতি বলতেন এমনকি তৃণমূলের স্থানীয় নেতারাও।

ভোটে তৃণমূলকে জেতানোর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে জেলা শাসক, পুলিশ সুপারদের হাতে। কোনও জেলায় তৃণমূলের ফল খারাপ হলে দলের নেতাদের চেয়ে বেশি জবাবদিহি করতে হয় তাঁদেরই। শাস্তির খাঁড়া নামে ওই অফিসারদের ঘাড়ে। কাউকে বদলি, কাউকে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠিয়ে সরকারের ইচ্ছা পালন না করার খেসারত দিতে বাধ্য করা হয়। আসলে দলের প্রভাব সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে তেমন তৈরি করতে না পারায় আধিকারিক নির্ভরতার পথে হাঁটেন মমতা।

তৃণমূল ঘনিষ্ঠ কর্মীরা কোঅর্ডিনেশন কমিটির মতো ক্ষমতা না পেয়ে অসন্তুষ্ট হতে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রীর আমলা নির্ভরতা তাঁদের আরও হতাশ করে। বিভিন্ন ভোটের পোস্টাল ব্যালটে পদ্ম চিহ্নে তাই ছাপ বাড়তে থাকে। তৃণমূল রাজত্বে কর্মচারীদের উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে কোঅর্ডিনেশন কমিটির নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ। এই নিয়‌ন্ত্রণ ভাঙতে পারেনি তৃণমূল। তার ওপর বামফ্রন্ট সরকারের মতো ঘনঘন বেতন বৃদ্ধিতে অপারগ হওয়ায় কর্মীদের অসন্তোষ আরও বাড়ে।

বেতন বা মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ, সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়। মহার্ঘ ভাতা নিয়ে মমতার অনড় মনোভাব সেই ক্ষোভের আগুনে ঘি ফেলে দেয়। ফলে সরকারি কর্মীদের বৃহদাংশের সঙ্গে মমতার এখন সম্মুখ সংঘাত। মুখ্যমন্ত্রীর হুমকিতে সেই সংঘাতের বার্তা স্পষ্ট। একদিকে কর্মসংস্থানের অভাব, নিয়োগে কেলেঙ্কারি, র‌্যাশন দুর্নীতি ইত্যাদিতে জনপরিসরে ক্ষোভ, অন্যদিকে কর্মী অসন্তোষে মমতার প্রশাসন কার্যত দিশেহারা।

কর্মীদের প্রতি কার্যত মমতার বিদ্রোহে সেই দিশেহারা অবস্থার প্রতিফলন। সরকারি কর্মচারীদের কাজে ফাঁকি নতুন ঘটনা নয়। পরে এসে আগে অফিস থেকে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাম আমলেও ছিল। এ সব ঠেকাতে এতদিন কড়া নজরদারি ছিল না। এখন হঠাৎ সেটা ঠেকাতে ৫৬-জে ধারার হুমকি সেই দিশেহারা ভাবের লক্ষণ। অর্থাভাবে বেতন বা মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধি করা না গেলে তা নিয়ে কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারত সরকার, দুঃখপ্রকাশ করা যেত।

সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার বদলে মুখ্যমন্ত্রী যে সংঘাতের রাস্তায় গেলেন, তাতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সম্ভাবনার দরজা খুলে যেতে পারে। সেটা সরকারের পক্ষে মারাত্মক হবে। কেননা, কর্মীরা পুরোপুরি অসহযোগিতার পথে গেলে প্রশাসন চালানো কঠিন। অথচ প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ার দায় তিনি কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। যেমনভাবে কোথাও তৃণমূল ভোট কম পেলে শাস্তির খাঁড়া নামে অফিসারদের ঘাড়ে। এই পরিস্থিতি সুষ্ঠু প্রশাসনের অনুকূল নয়।

সহিষ্ণুতার সঙ্গে যে কাজটা গৌতম দেব করলেন, সেটা মমতার না পারার কিছু ছিল না। এই দুর্বলতার ছিদ্রপথে বিরোধীরা সিঁধ কাটবে জেনেও তাঁর এই অপারগতা বিস্ময়কর।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

government blood bank is anemic, the families of patients are returning empty-handed

Blood Bank | সরকারি ব্লাড ব্যাংক রক্তশূন্য, খালি হাতেই ফিরছেন রোগীর পরিজনরা

0
রণজিৎ ঘোষ, শিলিগুড়ি: রক্তশূন্য ব্লাড ব্যাংক(Blood Bank)। প্রায় আড়াই মাস ধরে সেভাবে কোনও রক্তদান শিবির না হওয়ায় উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আঞ্চলিক ব্লাড...

Abhijit Ganguly | রয়েছে বহুমূল্য ফ্ল্যাট, ১২ লক্ষের আইনের বই! কত সম্পত্তির মালিক অভিজিৎ...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Abhijit Ganguly)। কিন্তু কিছুদিন আগেই...
web series was made by YouTuber 'Nongra Sushant's team

Youtube | ওয়েব সিরিজ বানিয়ে তাক লাগাল ইউটিউবার ‘নোংরা সুশান্ত’র টিম

0
বিধান সিংহ রায়, কোচবিহার: ইউটিউবে(Youtube) কমেডি ভিডিও ছেড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করা কোচবিহারের(Cooch Behar) সুশান্ত বর্মন এবার সিরিয়াস! তিনি এবং তাঁর ‘নোংরা সুশান্ত’ টিম...

First Flush Tea | বৃষ্টির অভাব, ফার্স্ট ফ্লাশ চায়ের উৎপাদনে ৩৫ শতাংশ ঘাটতি

0
ময়নাগুড়ি: বর্তমানে ফার্স্ট ফ্লাশের চা পাতা তোলার কাজ চলছে বাগানগুলিতে। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে এবারের উৎপাদন চরম ক্ষতির মুখে। উৎপাদনে ৩৫ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। শুধু...

Sunidhi Chauhan | মঞ্চে সুনিধির দিকে ছোড়া হল জলের বোতল! তারপর কী করলেন গায়িকা?

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: হাজার হাজার দর্শকের সামনে মঞ্চে গান গাইছিলেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সুনিধি চৌহান (Sunidhi Chauhan)। কিন্তু সেই মুহূর্তে হঠাতই তাঁর দিকে ধেয়ে...

Most Popular