Thursday, May 16, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়বিশ্বনাথের আলো সমাজেই বিলীয়মান

বিশ্বনাথের আলো সমাজেই বিলীয়মান

ক্রিকেটের অসামান্য রত্ন গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথের ৭৫ পূর্ণ হল এ সপ্তাহেই। তাঁর মহিমায় প্রভাবিত হত বঙ্গসমাজ।

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

রোদ্দুরকে ওই সময় কিঞ্চিৎ অলস দেখাত। নরম, নরম। অথচ ঝলমলে। কমলালেবুর গন্ধে মিশে যেত অমল সোনালি আলো। সোয়েটার বোনার উল কাঁটাগুলোয় রোদ পড়লে আরও ঝকঝক করত রোদ।

গঙ্গার ওপার থেকে হাওয়া এসে ইডেনের গ্যালারিতে মানুষজনকে আলতো গলায় ডাকাডাকি করত, কই হে, ভালো আছ?

ঠিক এ সময়ই মাঠে এক ছোটখাটো দাড়িওয়ালা উদাসীন ব্যাটসম্যান হয়তো ব্যাটের সঙ্গে বলের স্পর্শ এমনভাবে ঘটালেন, যা কবিতা হয়ে উঠত। অথবা রবিশংকর-আলি আকবরের সেতার-সরোদ, বাখ-বিটোভেনের সিম্ফনি। শক্তি নয়, ক্রিকেটের শট সৃষ্টিতে বেশি মিশে থাকত কবজির মোচড়। খুট– সামান্য একটি শব্দ থেকে হাততালির আওয়াজে কেঁপে উঠত ক্রিকেটের স্বর্গোদ্যান। সেই শব্দে রণহুংকার যত না ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল উচ্ছ্বাসমাখা রোমান্টিকতা। ক্রিকেট ম্যাচ দেখা ছিল দুর্গাপুজো দেখার মতো অনন্ত আকুতির রহস্য। বছরে একবার সেই স্বর্গীয় আখরোট ভাঙা যেত। আন্তরিক উচ্ছ্বাসের সেই আওয়াজ শব্দব্রহ্ম হয়ে রেডিওর মাধ্যমে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে যেত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে।

ফরাক্কায় গঙ্গাপাড়ের কোনও ঘাটে। শিলিগুড়ির কোনও রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে চায়ের দোকানে। কৃষ্ণনগরের কাছে পাগলাচণ্ডীর কোনও ছোট জমিদারবাড়ির কৃষ্ণচূড়ার গাছের নীচে। মালদার গ্রামের ডাকবাংলোর কুয়োতলায়। আলিপুরদুয়ারের চা বাগানে। মেদিনীপুরের হিজলি জেলের পাশের মাঠে।

সেই শব্দ নিজেদের গ্রামের, নিজেদের প্রান্তরের হয়ে উঠত নিমেষে। চার, চার, চার…। তখন ওভারবাউন্ডারি মুড়িমুড়কি হয়ে ওঠেনি। চার রানই রক্তে দোলা আনার জন্য যথেষ্ট ছিল প্রিয় পাঠক আমার।

পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চির গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথ এই সময় অপ্রাকৃতিক এক রোমান্টিক গাথার নায়ক হয়ে উঠেছিলেন আরও কয়েকজনের সঙ্গে। কোথাও সে নাম ক্রিকেটের, কোথাও ফুটবল বা অন্য খেলার। তাঁদের হয়তো জীবনে চোখের সামনে দেখেনি কেউ, তাঁর সঙ্গে কথাও বলেনি কেউ। অথচ তাঁর ভঙ্গি নিজের মনে অনিবার্য গেঁথে নিয়েছে, এঁকে নিয়েছে নিজস্ব কল্পনায়। একটা স্কোয়ার কাট, একটা স্কোয়ার ড্রাইভ, একটা লেট কাট বা অন ড্রাইভ। তাঁর পরের দিকে রাখা দাড়ির সঙ্গে উদাস বাউল বা তরুণ কবির সঙ্গে মিল পেত বাঙালি। যে চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজেকে একাত্ম ভাবাটা গর্বের মনে হত। ইডেনের গ্যালারি আওয়াজ তুলত– জয় বাবা বিশ্বনাথের চরণ সেবা লাগে…মহাদেব।

ক্রিকেট মানে যে শিল্প, সেই কথাটা কি বিশ্বনাথের কবজির মোচড়ের আগে বাঙালি সেভাবে জানত? উল কাঁটা বোনা ভুলে ইডেনের গ্যালারির মহিলারা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত তাঁর মহিমাময় সৌন্দর্যের দিকে। ঐকেক লড়াইয়ে শান্ত বিশ্বনাথ কতবার যে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সৃষ্টিকাজে নিমগ্ন হয়ে ফিনিক্স পাখি হয়ে উঠেছেন, তালিকা দেওয়া কঠিন। এই ‘লিটল মাস্টার’ সেঞ্চুরি করলে দেশ হারেনি কোনওদিন।

সেই বিশ্বনাথ পঁচাত্তর পেরিয়ে গেলেন গত সোমবার এবং আবার মনে করিয়ে দিলেন কত আলোকবর্ষের পৃথিবী পেরিয়ে আমরা চলে এলাম। সেই আমলের খেলার দুনিয়াকে কল্পনায় ভাবলে জুরাসিক যুগের মনে হয়। ক্রিকেট পিচে এক একটা মাইলস্টোন পেরিয়ে কী অসম্ভব শান্ত থেকে যেতেন বিশ্বনাথ। খেলোয়াড়রাও অত উচ্চকিত হতেন না গর্বে, সমর্থকরাও নন। ভদ্রতাবোধের শেষকথা বললে বিশ্বনাথের নামই হত। আউট হয়ে যাওয়া বব টেলরকে জুবিলি টেস্টে ফিরিয়ে আনা এত মহাকাব্যিক, তার তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে আর একটি মূল্যবান তথ্য। লিলির বিরুদ্ধে মাথা গরম করে যে মেলবোর্ন টেস্টে গাভাসকার মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলেন, সেখানে অসামান্য সাহসী সেঞ্চুরি করেছিলেন ভিশি। তিনিই ইতিহাসের ম্যাচের সেরা হন শেষপর্যন্ত। সৌন্দর্য, সাহস, শিল্প– বিশ্বনাথের সঙ্গী ছিল এই তিনটে। ব্যাটেও লোগো ছিল এসএস বা এসপি। যা খুলে দিত গতানুগতিকতার বাইরে দৃষ্টিসুখের শিল্পের জ্বালা-মুখ।

ভিশি পরবর্তী কর্ণাটকী ক্রিকেট থেকে যে মহাতারকাদের আমরা পেয়েছি, তাঁরা যেন অজাতশত্রু বিশ্বনাথের পদধ্বনিতেই পা ফেলতে চেয়েছেন। বিশ্বনাথ শৈশবে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি নীল হার্ভের ভক্ত। দ্রাবিড়, শ্রীনাথ, কুম্বলেদের মাঠের বাইরের আচরণে আমাদের মনে হয়েছে যেন তাঁরা বিশ্বনাথের ঘরানাকেই অনুসরণ করেছেন নিঃশব্দে নীরবে।

গ্রামীণ স্কুলের মাঠে কোনও কিশোর হয়তো একটা স্কোয়ার কাট মারার চেষ্টা করল অজান্তেই। বাতাসে উড়ে এল বড়দের বিদ্রুপ, ওহ তুই বিশ্বনাথ হওয়ার চেষ্টা করছিস। এখন এত বেশি ঘনঘন খেলা হয়, ব্যর্থতাকে ঢেকে ফেলার অনেক সুযোগ আসে ক্রিকেটারদের কাছে। পরপর পাঁচটা ম্যাচে দশের কম স্কোর, বিশ্বনাথদের আমলে হলে তুমি সঙ্গে সঙ্গে ঘচাং ফু। এখন এত টানা খেলা, ছয় নম্বর ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করে আরও দীর্ঘদিন খেলে ফেলা যায়। তিনটে ফর্ম্যাটের যে কোনও একটায় রান পেলেই হল। তখন তো এত টেস্ট হত না। তার মধ্যেই ৯১ টেস্ট খেলে ফেলেছিলেন ভিশি। এখনকার সময় হলে কেউ অবধারিত টেস্ট খেলার চেষ্টা চালিয়ে যেত আপ্রাণ। বিশ্বনাথরা ওরকম ছিলেন না, ওই আমলের ক্রিকেটও এমন ছিল না। ভারতীয় ক্রিকেটের বম্বে ঘরানার ব্যাটসম্যানশিপের সৃষ্টিকর্তা বিজয় মার্চেন্ট কতদিন আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বিশ্বনাথের বিকাশ নিয়ে!

একটা সময় ছিল যখন উত্তম-সৌমিত্র, মান্না-হেমন্ত, সত্যজিৎ-মৃণালের মতো বাঙালিও বিভক্ত ছিল দুটো ভাগে। গাভাসকার বনাম বিশ্বনাথ তর্কে। বাঙালি কেন বলছি, গোটা ভারতেই এই তর্কটা চলত। কে বড় ব্যাটসম্যান? গাভাসকার না বিশ্বনাথ? গাভাসকার চিরকাল তাঁর উদাস, শান্ত, কম কথার ভগ্নীপতির হয়ে সওয়াল করে বলে গিয়েছেন, আমার চেয়ে ভিশি অনেক বড় ক্রিকেটার। দু’দিন আগে বললেন, ‘বুকে হাত রেখে বলছি, আমাদের প্রজন্মে ওর চেয়ে বড় ক্রিকেটার আর হয়নি।’ এই পারস্পরিক শ্রদ্ধার ব্যাপারটাও আজকাল ক্রিকেট থেকে সমাজ সর্বত্র বেমালুম হাওয়া। কাশ্মীর থেকে কুমারিকা তাঁদের দুজনের তুলনায় মেতেছে। এবং ওঁরা নিজেরা মেতে উঠেছেন আরও গভীর বন্ধুত্বে। বিশ্বনাথ যে গাভাসকারের বোন কবিতাকে বিয়ে করলেন, তা নিয়ে তেমন গসিপ হাওয়ায় ওড়েইনি।

এই লোকটাকে মনসুর আলি পতৌদি বলে গিয়েছেন, আমার সেরা সতীর্থ। আপনার প্রিয় ক্রিকেটার কে? আদর্শ কে? প্রশ্ন করলে কপিল দেব নিখাঞ্জ, রবি শাস্ত্রীরা শৈশবে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় বলতেন ওঁর নাম। স্টাইলিশ ভিশির অপার্থিব ব্যাটিং দেখে ফিল্ডিং করতে করতে হাততালি দিয়েছেন মুগ্ধ গ্রেগ চ্যাপেল। টনি গ্রেগ কোলে তুলে নিয়েছেন মাঠেই। এখনকার খেলা আর এমন অমল ধবল চরিত্র দেখবে না কোনওদিন। বাস্তব হল, সময় কাউকেই মনে রাখতে চায় না। ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জিতে ফিরছেন কপিল, গাভাসকার, বেঙ্গসরকাররা। বিশ্বনাথও লন্ডনে খেলা দেখে ফিরছেন। সেবারই ফেব্রুয়ারিতে জীবনের শেষ টেস্ট খেলেছেন। বিমানবন্দরে বিশ্বজয়ীদের অভ্যর্থনা করতে যে ভক্তরা গিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন বিশ্বনাথকে। একা একা সবার অলক্ষে বিমানবন্দর ছাড়ার সময় চোদ্দো বছর টেস্ট খেলা জিআরভিকে চিনতেই পারেনি আর।

এত ঘনঘন ক্রিকেট না হওয়ার দিনে ইডেন মনে মনে বেছে নিত তার বরপুত্রকে। সেখানে মুস্তাক আলি, জয়সীমা, সেলিম দুরানি, আজহারউদ্দিনদের হারিয়ে হয়তো চিরকালের হিসেবে এক নম্বরেই থাকবেন নিভৃতবাসী বিশ্বনাথ। সেই প্রাণের কলকাতায় একটা ক্লাবের অনুষ্ঠানে একবার অপমানিতও হতে হয় তাঁকে। এর নামই জীবন, মশাই। শুধু বিশ্বনাথ কেন, সব ক্ষেত্রেই এককালের নায়কদের এভাবে উপেক্ষিত হতে হয়েছে কোনও না কোনও সময়। গানে, সাহিত্যে, রাজনীতিতে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে।

তিরাশি– বিশ্বনাথের শেষ টেস্ট খেলার বছরটা সবদিক দিয়ে ভারতীয় খেলাকে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে। আমরা বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ পেতে পেতে পালটে যেতে থাকলাম। দেশের অন্য খেলাগুলো ক্রিকেটের চাপে চলে যেতে থাকল মৃত্যুগহ্বরে। দর্শকরা ভালো খেলার থেকে কোনওমতে শুধুই জয়ের কথা ভাবতে শুরু করল। ক্যাপ্টেনরাও নিজেদের মর্জিমতো উইকেট বানানো অভ্যাস করে ফেললেন। গুরুত্বহীন হয়ে যেতে থাকলেন বোলাররা। ব্যাটের বিবর্তনে ব্যাটারদের শক্তির কাছে হেরে যেতে থাকল ব্যাটসম্যানদের শিল্প।

শিল্প হারিয়ে গেল এবং বিশ্বনাথের মতো ছায়াময়, অন্তর্মুখী মানুষগুলোও যেন উচ্চকিত পৃথিবীতে দৃষ্টির বাইরে বসবাস শুরু করলেন। প্রচ্ছন্ন থেকেই তাঁদের আনন্দ। জীবনজিজ্ঞাসায় অন্য অন্বেষণে ব্যস্ত। তবু আমরা জানি, বিশ্বনাথ চরিতাবলির এইসব মানুষের লয় নেই, বিনাশ নেই। জীবন এঁদের ভূমিতে লুটিয়ে অভিবাদন জানাবে ইতিহাসের বর্ণমালায়।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

0
রায়গঞ্জ: পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার বার্তা নিয়ে গাছ বাঁচানোর লক্ষ্যে মহা ধুমধামে বট পাকুড়ের বিয়ের হল রায়গঞ্জের রূপাহার তুলসীপাড়ায়। একদিকে তীব্র তাপপ্রবাহ, অন্য দিকে বৃষ্টির...

Sunil Chhetri | ফুটবল কেরিয়ারে ইতি টানলেন সুনীল ছেত্রী, কুয়েতের বিরুদ্ধে কলকাতাতেই শেষ ম্যাচ

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: অবসর (Retirement) নিচ্ছেন জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক (Indian football team captain) সুনীল ছেত্রী (Sunil Chhetri)। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও বার্তায়...

Digha Accident | দিঘা যাওয়ার পথে ভয়াবহ দুর্ঘটনা, বাস-গাড়ি সংঘর্ষে মৃত ৪

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: দিঘা যাওয়ার পথে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বাস ও চারচাকার গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত্যু হল ৪ জনের। বৃহস্পতিবার সকালে সাড়ে সাতটা নাগাদ...

Fire | গভীর রাতে অগ্নিকাণ্ড শিলিগুড়িতে, ভস্মীভূত একটি দোকান

0
শিলিগুড়ি: অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত (Fire) হল একটি দোকান। ঘটনার ঘটেছে শিলিগুড়ি (Siliguri) পুরনিগমের ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের হায়দার পাড়া বাজারে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার গভীর...

Balurghat | আত্রেয়ীর জলের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে কাশিয়া খাঁড়ি, সমস্যায় কৃষকরা

0
বালুরঘাট: আসছে না আত্রেয়ীর জল (Atreyee river)। ফলে শুকিয়ে যাচ্ছে বালুরঘাটের কাশিয়া খাঁড়ি। এদিকে খাঁড়ির জল না পেয়ে সমস্যায় এলাকার হাজার হাজার কৃষক। জলের...

Most Popular