- চিরদীপা বিশ্বাস
সাত-আটটা ছেলেমেয়ের দলের সঙ্গে কলকাতা মেট্রোয় দেখা। পাশে বসে তাদের অ্যাকাডেমিক প্রেশার, ফ্রাস্ট্রেশনের গল্পগাছা শুনে যদ্দূর বুঝলাম, তারা স্কুলজীবনের একেবারে শেষলগ্নে দাঁড়িয়ে। বোর্ডটা উতরে গেলেই ব্যস, মুক্তবিহঙ্গ। তবে সাধারণ হালকা চালে এইসব গল্প আরও নজরে পড়ল তাদের ভাষার ব্যবহারের কারণে।
মিনিট কুড়ির মেট্রোযাত্রায় শুরু থেকেই তারা এক অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষায় কথা বলছিল। সেই ভাষাকে না শুদ্ধ ইংরেজি বলা যায়। না শুদ্ধ হিন্দি। আর বাংলা- ও বাবা, পৃথিবীর মিষ্টতম ভাষার তকমা সযত্নে মুছে দিতে এরাই পারবে! এটাকে এক প্রকারের ‘বাহিংলিশ’ ভাষা বললে মন্দ হবে না। তার ওপর এক লাইনে পাঁচ-ছ’টা করে উন্নতমানের কিছু শব্দের প্রয়োগ। বাংলার এমন কিছু শব্দ যা ভদ্রসমাজে ভুলবশতও ব্যবহার করা হয় না, সেগুলোই তারা স্মার্টলি অনর্গল বলে চলেছে। পাশাপাশি ইংরেজি কু’শব্দ প্রয়োগেও তারা সমান দক্ষ। অবশেষে মেট্রো থেকে নেমে কান দুটো যেন রীতিমতো শান্তি পেল!
তবে শুধু স্কুল বা কলেজ পড়ুয়াই নয়, প্রচুর মধ্যবয়স্ককেও চায়ের ঠেকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সাবলীলভাবে এ ধরনের শব্দ প্রয়োগ করতে শোনা যায়। বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য গেলে তাঁরা বলে বসেন, ‘খিস্তি দিলে একটা আলাদা শান্তি পাওয়া যায়, ও যারা দেয় না বুঝবে না।’ এঁরাই আবার নিজেদের সভ্য সমাজের অংশীদার বলে মনে করেন। জল দূষণ, বায়ু দূষণ বা দৃশ্য দূষণ নিয়েও পরিবেশকর্মীরা সচেতন অথচ শব্দ দূষণ! ডিজেই কি একমাত্র শব্দ দূষণের কারণ? ‘কুশব্দ’ নয়! বাকস্বাধীনতা নিয়ে যাঁরা আওয়াজ তোলেন তাঁরা কি বলতে পারবেন এ কী ধরনের বাকস্বাধীনতা?
এ প্রসঙ্গে আবার রে-রে করে উঠবে আল্ট্রা মডার্ন জেন জেড সদস্যরা। তাদের যুক্তি ‘গালাগাল দিলেই কি কোনও মানুষের চরিত্র খারাপ হয়!’ তা অবশ্যই নয়, তবে ভাষা চরিত্র নির্ধারণের এক এবং একমাত্র মাপকাঠি না হলেও অন্যতম একটি তো বটেই, তাই ভাষা প্রয়োগেও তো একটা যথাযথ গণ্ডি আঁকা দরকার। জল দূষণ, বায়ু দূষণের মতো শব্দ দূষণও পরিবেশকে ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্ত করে, এটা বুঝতে শিখুন। আর ‘মাথা গরম হলে গালাগাল চলে আসে’ এই ধরনের যুক্তি বর্জন করুন।
সামাজিক মাধ্যম যেন এই অসামাজিক কার্যক্রমে হোমে ঘৃত সংযোগের মতো। গালাগাল নির্ভর ভিডিওতে ছেয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। হালের এক সিনেমা, যার প্রধান অভিনেত্রী কি না জনগণের মুখ, সে সিনেমার আইটেম সং-এর নমুনা দেখে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়। এর প্রভাব পরোক্ষভাবে পড়ছে নতুন প্রজন্মের ওপর। ক্রমাগত তারা যা শুনছে, দেখছে- সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করছে।
এই ক্রমবর্ধমান অপশব্দ চর্চা যেন সমাজ মেনে নিতে শিখছে ধীরে ধীরে। তাই ‘খিস্তি’ শুনে কেউ এখন নাক কোঁচকায় না বা ‘এই এসব বন্ধ কর তো’-ও বলে না। বরং এটাকে মেনে না নিলে বলা হয় ‘আরে বস, এসব এখন নর্মাল। মানতে শেখো, পৃথিবী এগোচ্ছে। গর্তে আর আটকে থেকো না, স্মার্ট হও।’ দিনশেষে মনে হয়, অপশব্দ প্রয়োগ না করলে যদি ‘গেঁয়ো’র তকমা জোটে তাহলে তাইই সই। কিন্তু এমন স্মার্টনেসের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই যা মাতৃভাষার অবমাননা করে।
(লেখক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কোচবিহারের বাসিন্দা)