Monday, April 29, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়মোদি বনাম মহাত্মা এবং ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরা

মোদি বনাম মহাত্মা এবং ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরা

গান্ধি কিছু শিল্পপতির অর্থসাহায্য নিতে কুণ্ঠা করতেন না। এসব বলে গান্ধিকে ঢাল করে মোদি নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন।

  • উত্তম সেনগুপ্ত

পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম মহম্মদ আলি জিন্নাহর নাতি ছিলেন নুসলি ওয়াদিয়া। সত্তরের দশকের শুরু থেকে পদ্ম শিবিরের কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল পর্যন্ত জন সংঘ-বিজেপির অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

শুধু তিনি-ই নন, জন সংঘ-বিজেপির এমন পৃষ্ঠপোষক অনেকে ছিলেন। তাঁরা কংগ্রেসের বামঘেঁষা-সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁরা মনে করতেন, একমাত্র জন সংঘ-বিজেপি-ই পারবে ‘কমিউনিস্টদের’ বাড়বাড়ন্ত রুখতে। তাই গোয়ালিয়রের বিজয়ারাজে সিন্ধিয়া সহ বহু অভিজাত রাজপরিবার জন সংঘকে সমর্থন করেছিল।

১৯৭১ সালে সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে সেসময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি পাঁচশোর বেশি রাজার ভারত সরকারের রাজন্যভাতা বাতিল করেন। ফলে তাঁরা ইন্দিরার উপর ক্ষুব্ধ হন। এসময় তাঁরা পাশে পান দেশের বহু খ্যাতনামা শিল্পপতিকে। কিন্তু সরকারি লাইসেন্স, পারমিটের জন্য শিল্পপতিরা তখন শাসকদল কংগ্রেসকে সম্পূর্ণ এড়াতে পারেননি।

মোদ্দা কথা হল, রাজনীতি ও ব্যবসার মধ্যে সবসময়ই একটা মাখামাখি সম্পর্ক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে নানা সময় প্রচারে ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’-এর অভিযোগ আনা হয়। এই ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ কী? রাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে তৈরি ব্যবসায়িক লাভকে পুঁজিতে রূপান্তরিত করাকে অর্থনীতির ভাষায় ক্রনি ক্যাপিটালিজম বলা হয়। মোদি নিজেই এই সম্পর্কের কথা একাধিকবার উল্লেখ করে বলেছেন, মহাত্মা গান্ধিরও বহু শিল্পপতি বন্ধু ছিলেন। তিনি মাঝে মাঝেই তাঁদের আতিথেয়তা নিতেন। তাঁদের অর্থসাহায্য নিতে তিনি কুণ্ঠা করতেন না। এসব বলে গান্ধিকে ঢাল করে মোদি নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন।

দিল্লিতে যে বিড়লা হাউসে থাকা মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে টাটা, ঘনশ্যাম দাস বিড়লা, যমুনালাল বাজাজ সহ অন্যদের উষ্ণ সম্পর্কের কথা গোপন ছিল না। এইসব শিল্পপতি তাঁর কর্মসূচিগুলিতে উদার হাতে অর্থসাহায্য করতেন। মোদিও একইভাবে দেশের বেশ কিছু শিল্পপতিকে তাঁর বন্ধু হিসাবে দাবি করেন। ফলে, তাঁদের বাড়িতে বা বাইরে নানা অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন। তাঁদের সঙ্গে ছবি তোলার অনুমতি দিতেও মোদি লজ্জা বোধ করেন না।

এটি ঐতিহাসিক সত্য, মহাত্মা গান্ধি কংগ্রেসে থেকেও সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতেন না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু। যাইহোক, ওই ব্যবসায়ীদের কাছে গান্ধির কৃতজ্ঞ হওয়ার নানা কারণ ছিল। মূল কারণ, দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন ওই ব্যবসায়ীরা তাঁকে অর্থসাহায্য করেছিলেন। গান্ধি যদিও মোদির মতো দেশের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন না। ‘নকল খাদি’ ও ‘নকল স্বদেশি’ ইস্যুতে টেক্সটাইল মিল মালিকদের সঙ্গে তাঁর মতভেদ হয়েছিল। স্বদেশির প্রচারে গান্ধিজি খাদির কাপড়কে জনপ্রিয় করার আবেদন জানিয়ে ছিলেন। মেশিনে তৈরি খাদি সেসময় বাজার ছেয়ে গিয়েছিল। ওই খাদিকে মহাত্মা ‘নকল’ খাদি বলেছিলেন। গান্ধি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বন্ধুদের নীতিবান হতে পরামর্শ দিতেন। একইসঙ্গে দরিদ্রদের শোষণ না করার বিষয়েও তিনি একাধিক প্রবন্ধ ও চিঠিতে লিখেও ছিলেন। ‘নকল খাদি’ ইস্যুতে তিনি হাতে বা তাঁতে তৈরি এবং গ্রামীণ পদ্ধতিতে বানানো খাদি কাপড়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। তাই, মহাত্মা ও মোদি কখনও এক সারিতে থাকতে পারেন না।

২০০৩ সালে, অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের এক মন্ত্রী দিলীপ সিং দেও ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েন। মিডিয়ার প্রশ্নের উত্তরে ওই মন্ত্রী নির্লজ্জ যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁর ঘুষ নেওয়া অনেকটা বিড়লার কাছ থেকে গান্ধির আর্থিক সাহায্য নেওয়ার স্বীকৃতির মতো। রাজনৈতিক দানের ক্ষেত্রে আদানপ্রদানের বিষয়টি মুখ্য। এই বিষয়টি-ই এই সম্পর্কের ভিত্তি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রের সঙ্গে অনুদান গ্রহণ সংযুক্ত। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের অনুদান গ্রহণ রুখতে আইন আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন অনুদানে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার প্রয়োজন। যাতে কোন সংস্থা কোন দলকে অনুদান দিচ্ছে, বিশেষ করে যদি সংশ্লিষ্ট দলটি ক্ষমতায় থাকে, বিনিময়ে তারা কী পাচ্ছে এসব প্রকাশ্যে আসা দরকার। বেশিরভাগ গণতন্ত্র বিদেশি হস্তক্ষেপের ভ্রূকুটি করে। রাজনৈতিক দলগুলি বিদেশি অনুদানকে উৎসাহ দেয় না। যদিও বিজেপি সরকার পাঁচ বছর আগে সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ স্কিমটিকে শুধুমাত্র সংসদের মাধ্যমে গুঁড়িয়েই দেয়নি, বরং সুপ্রিম কোর্টে একে জোরালোভাবে রক্ষা করছে। সেখানে আশ্চর্যজনক যুক্তি ছিল, স্কিমটি শুধু সম্পূর্ণ স্বচ্ছই নয়, ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে নোংরা ব্ল্যাক মানি নাকি সমাজ থেকে দূর করেছে। মানে কেউ যদি ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা তুলে তা কোনও রাজনৈতিক দলকে দান করে, তবে তা কালো টাকা বলে ধরা হবে। একই ব্যক্তি যদি এক কোটি টাকার একটি ইলেক্টোরাল বন্ড কিনে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি নোট দিয়ে ওই একই দলকে দেন, তাহলে সরকার তাকে সাদা টাকা বলে গণ্য করবে। বন্ড ক্রয়কারী সংস্থার কর্তারা জানতে পারবেন কোন রাজনৈতিক দলকে কেন বন্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংস্থার শেয়ারহোল্ডাররা জানবেন না।

এই সরকার রাজনৈতিক দলগুলির কর্পোরেট অনুদানের উপর সব বিধিনিষেধ তুলে দিয়েছে। বিদেশি সংস্থাগুলিকেও ইলেক্টোরাল বন্ড কেনার অনুমতি দিয়েছে। এমনকি, রাতে কাজ করা কোম্পানি, সহ ক্ষতিকারক সংস্থাগুলিকেও অনুদান দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। আশ্চর্য, এরপরই ৯৫ শতাংশ বন্ড বিজেপির তহবিলে জমা পড়ে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলি বিরোধী দলগুলিকে অনুদান দিতে উৎসাহী নয়। তারা এখন অনুদানের বিনিময়ে সরকারের সঙ্গে লেনদেন করতে পারে। ইলেক্টোরাল বন্ড কেনা কোম্পানির পরিচয় গোপন রাখতে পারে ব্যাংক।

এক্ষেত্রে কংগ্রেসের ‘ক্রাউড ফান্ডিং’-এর মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহের প্রচেষ্টা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ১৯৩৮ সালে ‘দ্য ন্যাশনাল হেরাল্ড’ খবরের কাগজটিকে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে সহায়তা করা হয়েছিল। কংগ্রেস এখন সাধারণ মানুষের কাছে ১৩৮ টাকা নেওয়ার মাধ্যমে অর্থসংগ্রহ করছে। দলের বয়স ১৩৮ বলে। ব্যাপারটা মহাত্মা গান্ধির ১০৩ বছরের পুরোনো পদক্ষেপে অনুপ্রাণিত। গান্ধি ‘তিলক স্বরাজ তহবিল’-এ জনতাকে অনুদান দিতে বলেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী বাল গঙ্গাধর তিলকের স্মরণে ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে নাগপুর অধিবেশনে এর সূচনা হয়। তহবিলটি গড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বরাজের নিরাপদ স্বশাসনের জন্য অসহযোগ আন্দোলনকে অর্থসাহায্য করা। সেসময় গান্ধি শান্তিনিকেতন সফরে এক অটোগ্রাফ-শিকারির কাছে স্বরাজ তহবিলের জন্য অনুদান চেয়েছিলেন।

এক শতাব্দীরও বেশি সময় পর ক্রাউড ফান্ডিং-এ ফিরে যাওয়া দলগুলির কাছে বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে ভারতীয়রা বিরোধী দলগুলিকে অনুদান দিতে উৎসাহী নন। কংগ্রেস তাই ক্রনি ক্যাপিটালিজম ও বিজেপি সরকারের অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে ক্রমশ সোচ্চার হয়েছে।
গত ১০ বছরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অনুদান অনেকটা অপরিবর্তিতই রয়েছে। ২০১৩-’১৪ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭৬৭ কোটি টাকা। ২০১৯-’২০ সালে তা বেড়েছে ৯২৯ কোটি টাকায়। আর ২০২১-’২২ সালে হয়েছে ৮০৬ কোটি টাকা। একই সময়ে বিজেপির অনুদান ২০১৩-’১৪ সালে ৭৮১ কোটি টাকা থেকে ২০২১-’২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬০৪৭ কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে বিক্রি হওয়া ১৬ হাজার কোটি টাকার বন্ডের আনুমানিক ৯৫ শতাংশ বিজেপির তহবিলে জমা পড়েছে। একইসঙ্গে নির্বাচনি বন্ডগুলি বিজেপিকে প্রচুর ফায়দা দিয়েছে। ক্রাউড ফান্ডিং বিজেপির সম্পদ সংগ্রহের অন্যতম সফল রাস্তা। একে অনুসরণ করার একটাই কারণ। এটি একটি ভিন্ন ধরনের রাজনীতির পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের জড়িয়ে রাজনৈতিক অর্থায়নের নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। বিজেপির কাছে যাওয়া এক কোটি টাকার বন্ডের বিপরীতে ছোট অনুদানও দলটিকে মানুষের কাছে আরও দায়বদ্ধ করে তুলবে। ছোট অর্থের বন্ডদাতারা সেই অনুদান কীভাবে খরচ হয়েছে তা জানতে চাইতে পারেন। গত ২ নভেম্বর নির্বাচনি বন্ড স্কিমের চ্যালেঞ্জগুলির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় সংরক্ষিত রয়েছে। তবুও ক্রাউড ফান্ডিং বিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে দেশের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও অসাম্য আটকাতে ক্রাউড ফান্ডিং স্বাস্থ্যকর অর্থের উৎস হতে পারে।

(লেখক টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন রেসিডেন্ট এডিটর)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

ISL | মধুর প্রতিশোধ যুবভারতীতে, ২-০ গোলে ওডিশাকে হারিয়ে আইএসএল ফাইনালে মোহনবাগান

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: টানটান উত্তেজনার ম্যাচে ওডিশাকে ২-০ গোলে হারিয়ে আইএসএলের ফাইনালে পৌঁছে গেল মোহনবাগান। ইনজুরি টাইমে জয়সূচক গোলটি করেন আব্দুল সাহাল। মোহনবাগানের...

AAP | আপের হয়ে দিল্লিতে প্রচারে অরবিন্দ পত্নী, ভিড় জমালেন মহিলারা

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ‘যার স্বামী জেলে আছে, তাঁকে তো বাইরে আসতেই হবে’ কথাগুলি ৫২ বছরের কমলেশ জৈনের। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের স্ত্রী সুনীতা...

Titanic | নিলাম হল টাইটানিকের ধনকুবের যাত্রীর সোনার পকেটঘড়ির, দাম উঠল  ১০ কোটি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ডুবে গেলেও আজও জীবিত আছে মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায়। ১১০ বছরেরও বেশি জলের তলায় রয়েছে বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক। টাইটানিককে নিয়ে রয়েছে...

Siliguri | মাটিগাড়ায় হামলা, আক্রান্ত বিজেপির বুথ সভাপতি সহ ৬

0
শিলিগুড়ি: মাটিগাড়ার কলাইবক্তরি এলাকায় রবিবার সন্ধ্যায় একদল দুষ্কৃতী বিজেপির স্থানীয় বুথ সভাপতি নন্দকিশোর ঠাকুর সহ কয়েকজন বিজেপি কর্মকর্তার বাড়িতে হামলা চালায়। যার জেরে দু’জন...

Migrant Worker | রমরমিয়ে চলা মাছের ব্যবসাই হল কাল, কেরালায় খুন হলেন মানিকচকের পরিযায়ী...

0
মানিকচকঃ কেরালায় গিয়ে মাছের ব্যবসায় ব্যাপক পসার জমিয়েছিলেন মালদার মানিকচক নাজিরপুরের একটি ছোট্ট গ্রাম লস্করপুরের যুবক প্রকাশ। স্বল্প লাভে মাছ বিক্রি করায় অল্প দিনের...

Most Popular