Sunday, April 28, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ইউনেসকোর ‘হেরিটেজ সাইট’ হতে পারে    

ইউনেসকোর ‘হেরিটেজ সাইট’ হতে পারে    

 

  • বিমল দেবনাথ

উদ্যান কথাটার মধ্যে একটা ফুরফুরে বাতাস থাকে। জাতীয় উদ্যান সেরকম নয়। এই উদ্যান প্রকৃতির লীলাভূমি। এখানে মানুষের অধিকার থাকে না। নেওড়া ভ্যালি কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে এক রোমাঞ্চকর দুর্গম বনভূমি। অনেকে ভাবেন এখানে এখনও আদিম মানুষ আছে। আদিম এই বনভূমির অনেক অংশের মাটিতে আলো পড়ে না। উত্তর অংশ সিকিমের পাঙ্গোলাখা অভয়ারণ্য ও উত্তর-পূর্ব কোণ ভুটানের স্ট্রিক্ট রিজার্ভ ফরেস্টের আদিম বনের সঙ্গে মিশে রয়েছে। দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে মিশে রয়েছে কালিম্পং জেলার বনভমির সঙ্গে। কিছু দূরে পশ্চিমে চেল, পূর্বে জলঢাকা নদী। বুক চিড়ে বেরিয়ে এসেছে নেওড়া নদী। কোনও হিমবাহ না থাকলেও সারা বছর কুলকুল করে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জল। জল নয় যেন মায়ের দুধ, জীবন। পান করে বেঁচে আছে কালিম্পং আবাদের মানুষ।

অ্যাংলো-ভুটান যুদ্ধের (১৮৬৫) পর কালিম্পং মহকুমার সঙ্গে এই বনাঞ্চলও চলে আসে ব্রিটিশ-ভারতে। কলকাতা বোটানিকাল গার্ডেনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ডঃ এন্ডার্সনের সুপারিশে বহু যুগ আগে এই বনকে রিজার্ভ ফরেস্ট করা হয়। ভূমির গড়নও বিচিত্র। হঠাৎ উঁচু, হঠাৎ নীচু। পাহাড়ের পাদদেশ হালকা ঢালু বা সমতল। উচ্চতা ১৮৩ মিটার থেকে ৩২০০ মিটার। সর্বোচ্চ স্থান রেচেলা ডান্ডা।

নেওড়া নদীর ডান ও বাম পাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য ঝোরা, ইংরাজি ভি অক্ষরের মতো। এই ধরনের ভি গঠনের জন্য সৃষ্টি হয়েছে বিচিত্র সব হ্যাবিট্যাট। শৈলশিরা ছাড়া হাঁটা খুব কষ্টকর। ওঠানামাও খুব কঠিন। তবু এই রোমাঞ্চকর বন মানুষকে ডাকে। সেই অদম্য ডাক প্রকৃতিপ্রেমী মানুষকে পাগল করে। সবুজ এই বন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এটা সম্ভব হয়েছে অল্প পরিসরে দুটো জীবাঞ্চল থাকার জন্য।

এখনও পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, ৬৮০ প্রজাতির গুপ্তবীজী উদ্ভিদ, ২৩ প্রজাতির টেরিডোফাইট, ৫ প্রজাতির ব্যক্তবীজী উদ্ভিদ। কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে আছে ৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩০৮ প্রজাতির পাখি, ২৭৬ প্রজাতির পতঙ্গ, ৩৮ প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণী, ৬ প্রজাতির জোঁক। এখানে কিছু অর্কিড আছে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। আবিষ্কৃত মোট প্রজাতির ২০ শতাংশ খুব বিরল। সম্প্রতি আরও কয়েকবার অন্বেষণ করা হয়েছে। সেখানেও আবিষ্কার হয়েছে আরও নতুন প্রজাতি। এখনও অনেক প্রজাতি আছে অনাবিষ্কৃত।

এখানকার পরজীবী গুপ্তবীজী উদ্ভিদ ব্যালানোফোরা নিউরেন্সিস বিপুপ্তির পথে। এখানে আছে ক্যানসারের ঔষধি ট্যাক্সাস ব্যাকাটা। বেঁচে থাকে ৪০০-৬০০ বছর। দুটো স্থানীয় পাখি সহ এখানে পাওয়া যায় বিশ্বব্যাপী বিপন্ন সাত প্রজাতির পাখি- যেমন ব্ল্যাক লোরেড টিট, রোফাস সিবিয়া ইত্যাদি। আছে বহু বিরল প্রজাতির পাখি যেমন- ওয়ার্ড ট্রোগন, সত্যির ট্রাগোপান ইত্যাদি। পূর্ব হিমালয়ে স্থানীয় পাখি রাস্ট্রি বেলিড শর্টউইংকে এখানে দেখা যায় সহজে।

আদুরে ‘রেড পান্ডা’ ছাড়া বাস করে। সঙ্গে থাকে চিতাবাঘ, জঙ্গল ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, লেপার্ড ক্যাট, মার্বেল ক্যাট, মেঘলা চিতা, বুনো কুকুর, খ্যালশিয়াল, শিয়াল, হিমালয়ান ব্ল্যাক বেয়ার, সম্বর হরিণ, কাঁকর হরিণ, গৌর, গোরাল, সেরু ইত্যাদি বহু প্রাণী। সঠিক সংরক্ষণের জন্য এই বনাঞ্চলকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয় ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে। এলাকা ৮৮ বর্গ কিমি। কিন্তু মানুষের চাহিদা পূরণ করতে তখনও পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণের লাগোয়া বনে চলতে থাকে বৃক্ষচ্ছেদন। গোচারণ, শিকার সহ অন্যান্য অপকর্মের ঢেউ যে নেওড়া ভ্যালিতে লাগছিল না, তা বলা যাবে না। ১৯৯৮-তে প্রথম দেখা যায় বাঘ। নড়েচড়ে ওঠে সরকার। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব তুলে ধরে এই জাতীয় উদ্যানকে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়। অন্তর্ভুক্ত হয় ইউনেসকোর সম্ভাব্য তালিকায়।

দীর্ঘ প্রক্রিযার পর ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে কালিম্পং বনের আরও প্রায় ৭২ বর্গ কিমি যুক্ত করা হয়। বর্তমান আয়তন প্রায় ১৬০ বর্গ কিমি। নেওড়া ভ্যালি নর্থ, সাউথ, ইস্ট এবং ওয়েস্ট রেঞ্জে বিভক্ত। রেঞ্জগুলোকে ভাগ করা হয়েছে ১৩টা বিটে। বিটের অধীনে আছে কিছু ক্যাম্প। নর্থ রেঞ্জের অবস্থান লাভাতে, সাউথ রেঞ্জ সামসিং-এ। ওয়েস্ট রেঞ্জ হওয়ার কথা কুয়াপানিতে এবং ইস্ট রেঞ্জ তাংতায়। সেগুলো এখনও গড়ে ওঠেনি।

শোনা যায়, ১৩ বিটের ৭টাতেই বিট অফিসার নেই। নেই পর্যাপ্ত তৃণমূল স্তরের কর্মী। অস্ত্রশস্ত্রও মান্ধাতার আমলের। জাতীয় উদ্যানের চারপাশে রয়েছে সতেরোটা গ্রাম। জনসংখ্যা প্রায় দশ হাজার। প্রধান পেশা কৃষিকাজ ও পশুপালন। এই দুই পেশায় একটা পরিবার কি সচ্ছল থাকতে পারে? অগোচরে জীববৈচিত্র্যের কী ক্ষতি হচ্ছে? সংরক্ষণ সঠিক করতে হলে চাই নিবিড় নিরীক্ষণ। বর্তমান পরিকাঠামোয় এই বিশাল পাহাড়ি বনাঞ্চলে নিশ্ছিদ্র নিরীক্ষণ কতটা সম্ভব সেটাই বড় প্রশ্ন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতি পর্যটন।

নেওড়া ভ্যালির নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার একমাত্র উপায় ট্রেকিং। ট্রেকিং-ই একমাত্র ইকো টু্রিজম কর্মকাণ্ড। অনুমতিপত্র পাওয়া যায় নর্থ রেঞ্জ এবং সাউথ রেঞ্জ থেকে। লাভা-নর্থ রেঞ্জ থেকে ট্রেকিং করা যায় লাভা ফরেস্ট চেকপোস্ট থেকে চৌদ্দফেরি, জিরো পয়েন্ট, পিএইচই, জড়িবুটি, আলুবাড়ি, হাতিচেরা, জোরপুখরি (রেচেলা ডান্ডা), রুকা, তাংতা ও তোদে পর্যন্ত। চৌদ্দফেরি, পিএইচই, আলুবাড়ি ও রুকাতে রাত্রিবাস করতে হবে। মোট পাঁচদিন লাগবে।

আর একটা রুট হল চৌদ্দফেরি, পিএইচই, আলুবাড়ি, হাতিচেরা ও মূলখাগড়া পর্যন্ত। এই রুটে চৌদ্দফেরি, পিএইচই, আলুবাড়িতে রাত্রিবাস করতে হবে। লাভা থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত গাড়িতেও যাওয়া যায়। ভাড়া কমবেশি ১৬০০ টাকা। গাইড চার্জ ১২০০ ও পোর্টার চার্জ ১০০০ টাকা প্রতিদিন হিসেবে।

সামসিং সাউথ রেঞ্জ থেকে অনুমতি মেলে তোদে থেকে লাভা যাবার পথে এবং সামসিং থেকে ভোটেখারকা ক্যাম্প পর্যন্ত। তোদে থেকে লাভা যাবার গাইড চার্জ ও পোর্টার চার্জ লাভার সমান। সামসিং থেকে মৌচকি গাড়িতে যাওয়া যাইয়। ভাড়া কমবেশি ১৫০০ টাকা। গাইড চার্জ ৩৫০ টাকা। মৌচকি থেকে হেঁটে ভোটেখারকা। এই ট্রেকিং একদিনে করা যায়। সব ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতিপত্রের মূল্য ১২০০ টাকা প্রতিজন প্রতিদিন হিসেবে।

ট্রেকিং করার ভালো সময় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি। খাদ্যসামগ্রী, প্রযোজনীয় পোশাক ছাড়া সঙ্গে রাখতে হয় জলের বোতল, স্লিপিং ব্যাগ, রুকস্যাক, লাঠি, ব্যাকপ্যাক টেন্ট, প্রোফাইল, সোলার এলইডি লণ্ঠন, ফ্লাস্ক, রেইন কোট, প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ, বাইনোকুলার, টর্চলাইট ইত্যাদি। সঙ্গে অনুমতিপত্র না থাকলে চূড়ান্ত বিপদ হতে পারে। অনিবার্য হতে পারে জেল যাত্রা। তাই গজিয়ে ওঠা হোমস্টের খপ্পরে না পড়া ভালো।

প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ, গাছের পাতার সরসর শব্দ আর জল ঝরার টিপটিপ ছন্দ, পাখির কূজন, কীটপতঙ্গের গুঞ্জন, নদীর কলকল কথায় মানুষ মোহিত হয়ে হাঁটছে। হাঁটবে। কিন্তু কতদিন? পরিকাঠামোর সর্বোত্তম উন্নয়ন এবং বন সন্নিহিত মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি না হলে কে রক্ষা করবে এই জীববৈচিত্র্য। এই জন্য চাই অর্থ। অর্থ আসে গণদাবি থাকলে। সে দাবি কোথায়? সঠিক সংরক্ষণ হলে একদিন নেওড়া ভ্যালি হয়ে উঠবে ইউনেসকোর ওযার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। সে ক্ষমতা আছে নেওড়া ভ্যালির।

(লেখক অবসরপ্রাপ্ত বনকর্তা)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

TMC Conflict | গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জের! তৃণমূলকর্মীকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ বাগুইআটিতে

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: তৃণমূলকর্মীকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ উঠল খাস কলকাতায়। শনিবার গভীর রাতে ঘটনাটি ঘটেছে বাগুইআটির অর্জুনপুর এলাকার পশ্চিমপাড়ায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে,...

Archery World Cup | তিরন্দাজি বিশ্বকাপে বাজিমাত ভারতের, কোরিয়াকে হারিয়ে সোনা জয় পুরুষ রিকার্ভ...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখল ভারত (India)। শনিবারের পর রবিবারও তিরন্দাজি বিশ্বকাপে (Archery World Cup) জয়জয়কার ভারতীয় তিরন্দাজদের। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ দক্ষিণ...

জেইই মেইন-এ দার্জিলিং জেলায় সম্ভাব্য প্রথম শিলিগুড়ির আদিত্য

0
শিলিগুড়ি: ডিজিটাল মিউজিক তৈরি করা তার শখ। তবে পেশায় বিজ্ঞানী হতে চায় জেইই (মেইন)-তে দার্জিলিং জেলার সম্ভাব্য প্রথম আদিত্য বশিষ্ঠ। তাই এখন থেকেই জোরকদমে...

জঙ্গলে ঘুরে রিপোর্ট তৈরি, ইকো ট্যুরিজম স্পটের খোঁজে সমীক্ষা বন দপ্তরের

0
শিলিগুড়ি: পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে ইকো ট্যুরিজম স্পটের খোঁজ শুরু করেছে বন দপ্তর। পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ‘ঐরাবত’-এর সঙ্গে যৌথভাবে কার্সিয়াং ও দার্জিলিং পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায়...

Manipur Repolling | ভোট বাতিল ৬ বুথে, পুনর্নির্বাচনের ঘোষণা মণিপুরে

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: দ্বিতীয় দফার ভোটেও (Lok Sabha election 2024) অশান্ত ছিল মণিপুর। আর এবার একটা গোটা লোকসভা কেন্দ্রও নয়, ভোট ছিল আউটার...

Most Popular