- মৈনাক ভট্টাচার্য
সামাজিক মাধ্যম নির্ভর এই সভ্যতার দৌড় এখন ‘রেডি টু কুক’। চিত্র-ভাস্কর্যের মূল্যায়নে কে কত বড় শিল্পী সেটাও তাই ঠিক করে দিচ্ছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের লাইক-কমেন্ট। চুলোয় যাক নান্দনিকতার মূল্যবোধ, হিসেবের বখরা বরাবর- ‘তুমি আমায় লাইক দিচ্ছ না, আমিও তোমার সঙ্গে নেই।’ মেধার চেয়েও এগিয়ে এদের চটকদারির রমরমা, ভুঁইফোঁড় শিল্পীরাও তাই অনেকে স্বঘোষিত সেলেব্রিটি। মূলধন বলতে অন্য খাতের অন্য কিছু পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। উত্তরবঙ্গের শহরগুলিও একই ভাইরাসে আক্রান্ত।
ভালো স্কুল অবশ্যই আছে, তবে এখন পাড়ায় পাড়ায় শিল্পী তৈরির ফ্যাক্টরির অবয়বে আঁকার স্কুল। একটা সময় ছিল যখন শিল্পীরা এমন ফ্যাক্টরিজাত ছিল না, প্রতিভা নিয়েই জন্মাতে হত। আঁকার স্কুলগুলি তখন শুধু বিকশিত করত স্বশিক্ষার মেধা। ছাত্রদের নিয়ম মেনে প্রথমে স্কেচে হাত পাকলে তবেই পর্যায়ক্রমে ক্রেয়ন, জলরং ইত্যাদি। মৌলিক ভাবনা তৈরি করতে হত ছবি নিয়ে, ল্যান্ডস্কেপের স্টাডিওয়ার্ক ঘরে বসে নয় প্রকৃতির রংয়ের ঘ্রাণ নিয়ে করতে হত আউটডোরে গিয়ে। ব্যাকরণ ধরে ধরে শেখানোই ছিল দস্তুর। চিত্র-ভাস্কর্যের শিক্ষকেরা জেনে গিয়েছেন আউটডোরের হ্যাপা অনেক। মৌলিক ভাবনায় সময়, মেধা দুইই চাই। তার চেয়ে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাও, চটজলদি বাজিমাত হাতের অ্যানড্রয়েডে ‘সিঁধুজ্যাঠা’-ইউটিউব যুগ যুগ জিও।
ইতিহাস বলে, এক সময় সমালোচনার নাগপাশ থেকে পার পাননি গণেশ পাইনের মতো শিল্পীরাও। তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘কৃষ্ণার্জুন’- মাথা নীচু করে রথে বসে অর্জুন, সারথি কৃষ্ণকে রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ কালো টোনের ভেতর। সমালোচকেরা এই কাজের মৌলিকতায় খুঁজে বের করলেন ডাচ শিল্পী রেমব্রাঁর আলোছায়ার সঙ্গে কালো টোনের ছায়াপাত। পাশে দাঁড়ানোর সমালোচকও ছিল। সরু সরু লাইন আর টেক্সচারের ভাষার সঙ্গে রংয়ের প্রয়োগ ভাবনায় আসাধারণ ভারসাম্যের যুক্তিতে বুঝিয়ে দিলেন, ‘টেম্পারা বা গুয়াসের এই কাজে শিল্পী গণেশ পাইন কিন্তু রেমব্রাঁ থেকে শুধুমাত্র ঘরানাটুকুই নিয়েছেন। এখানেই একজন শিল্পী তাঁর নিজস্বতায় স্বকীয়।’
সমালোচকের হাতে শিল্পের এমন কাটাছেঁড়া না হলে শিল্পের এই সারবত্তা দর্শকের অগোচরে অনন্তকাল হয়তো চিলেকোঠা আগলেই থেকে যায়।
আগের তুলনায় শিল্পশিক্ষায় মেধা প্রদর্শনের সুযোগ এখন অনেক বিস্তৃত। এই পরিস্থিতির বেনোজলে আবার আকছার আয়োজিতও হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার চিত্র-ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। ‘ঠগ বাছতে গা উজাড়,’ এতেই জালিয়াতির ফাঁদ পেতে দিচ্ছেন কিছু আগমার্কা সংগঠক থেকে শিল্পশিক্ষক। রেজিস্ট্রেশনের নামে ছবি পিছু বড় অঙ্কের টাকা। প্রচারের চাকচিক্যে অভিভাবকেরা কিছুদিন দিশেহারা। আর্থিক সামর্থ্য না থাকলেও তাঁদের বাচ্চাদের স্মারক, শংসাপত্র দিয়ে রাতারাতি বড় শিল্পী বানিয়ে দেওয়ার প্রলোভনে জেরবার কিছু অভিভাবক। নিটফল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’। এমন পরিস্থিতির চাপে ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা চিত্র-ভাস্কর্যের ছাত্র-অভিভাবকদের।
এখানেও দরকার কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’-র একজন সেই শিশুকে। যে দাঁড়িয়ে অকপটে প্রশ্ন তুলে দিতে পারে-‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’
(লেখক শিলিগুড়ির ভাস্কর এবং সাহিত্যিক)