- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
দুটো খবর এল এক সপ্তাহের মধ্যে। দুটোই ভূখণ্ডের খবর। দুটোই দখলদারির খবর। দুটোর মধ্যেই ভারত জড়িয়ে। বিদেশও।
অথচ, কী বিস্ময়জাগানিয়া ব্যাপার- দুটো ঘটনায় সরকারি প্রতিক্রিয়ায় ফারাক বিস্তর। একটা ইস্যু একেবারে টাটকা। আর একটা কার্যত বহু প্রাচীন সিন্দুক থেকে বের করে আনা।
প্রথম খবর- চিন আমাদের অরুণাচলের তিরিশটি জায়গার অন্য নাম দিয়ে ফেলেছে। চিনা বা তিব্বতি নাম দেওয়া মানে কিন্তু একরকম দখলদারি নিয়ে ফেলা। চার চারবার এমন হল। এসব শোনার পর চিনকে পালটা হুমকি দিয়েছে ভারত। ভবি ভোলার নয়। তিরিশটির মধ্যে ১২ পর্বত রয়েছে, ১১টি গ্রাম, ৪ নদী রয়েছে, একটি লেক, এক টুকরো জমি, একটি গিরিপথ।
দ্বিতীয় খবর- ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাঝের একটা জনমানবশূন্য ১.৬ কিলোমিটার লম্বা দ্বীপ কেন ইন্দিরা গান্ধির সময় শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দিয়েছিল ভারত, এই প্রশ্ন কয়েক যুগ পর তুলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রথমে তামিলনাডু বিজেপি তুলেছিল প্রশ্নটা। তারপর মোদি নিজেই। নিজের পছন্দের কাগজের রিপোর্ট তুলে ধরে কংগ্রেস ও ডিএমকে-কে গেঁথেছেন নমো।
ভোট এলে অনেক নাটক আমরা দেখে থাকি। ধরে নিতে পারেন, এ দুটোও বড় ধরনের নাটক। যে কোনও রাজনৈতিক ডামাডোলে দেখা যায় পাড়ার তত্ত্ব কাজ করছে। দাদাদের কাছে আমরা সবাই চুপ। যত চোখরাঙানো ছোটদের দিকে। এখানেও তাই।
একটা আমরা দিতে চাই না, একটা আবার নিতে চাই। চিনের বিরুদ্ধে ভারতের সুর যত উচ্চগ্রামে, শ্রীলঙ্কার দ্বীপ নিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি স্কেলে। তবে এ খেলা বড় ভয়ংকর খেলা। হিন্দু-মুসলিমদের ভাগ করে ভোট পাওয়ার মতোই ভয়ংকর হল তামিলদের আবেগ নিয়ে খেলা। পুরোনো আমলের লোকেরা এ কথাটা জানেন ভালো করে।
অরুণাচলের গল্পটা এতদিনেই সবারই অল্পবিস্তর জানা। কতদিন ধরে পড়ছি, উপগ্রহের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের অঞ্চলে চিনা সেনারা দিব্যি ঘোরাঘুরি করছে। এত চর্চিত, সেটা নিয়ে বেশি কিছু লিখতে চাই না। শুধু একটা কথা বলা দরকার। চিন সরকারের বিরুদ্ধে একটা সময় মোদি সরকার পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছিল। চিনের কোনও জিনিস কেনা হবে না, এই হুমকি দেশজুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর তো এখন অনেক মল বা অনেক বাজারে দেখি, মেড ইন চায়না মার্কা জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। কত নিঃশব্দে আমাদের যাবতীয় বিপ্লব একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার কাটচাহিভু দ্বীপ নিয়ে নাটক একেবারে সদ্য। ভোটের সঙ্গে ইদানীং প্রতিবেশীদের জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় ভারতে। গতবার হয়েছিল পুলওয়ামাকে নিয়ে। ব্যাপারটা এত রহস্যজনক, তার থই পাওয়া কঠিন। পুলওয়ামাতে গিয়েও সেই ব্রিজের চারপাশের মানুষজন, দোকানদারদের নানা সংশয় প্রকাশ করতে দেখেছি।
শ্রীলঙ্কার ছোট্ট দ্বীপকে নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলার প্রধান কারণ তামিলনাডু ভোটে কংগ্রেসের শরিক ডিএমকে সরকারকে বিপদে ফেলা। তামিল আবেগ কাজে লাগিয়ে ভোট বাড়ানো। এই ইস্যুকে আরও আবেগ জড়ানোর জন্য, ভাবতে পারেন এখানে এনে ফেলা হচ্ছে আমাদের জলপাইগুড়ির ছোট্ট গ্রাম বেরুবাড়িকে। জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিধানচন্দ্র রায়কে। প্রথমে এই প্রশ্ন তুলেছিল তামিলনাডুর বিজেপি। পরে নরেন্দ্র মোদি ব্যাপারটা নিয়ে টুইট করে একেবারে বড় রাস্তায় এনে ফেলেছেন। ভিলেন করা হচ্ছে নেহরু ও ইন্দিরাকে। মোদির প্রিয় বিষয় তো!
ইতিহাস বলার সুযোগ পেয়ে গেলে কে ছাড়ে? এই সুযোগে পক প্রণালী ও রামেশ্বরমের মধ্যবর্তী ওই ক্ষুদ্র দ্বীপটির কথা বলি। দ্বীপটি ১৯২১ সাল থেকে সিংহলের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ভারতের হাতে কোনওদিনই ছিল না। তবু এটা নিয়ে একটা বিতর্ক থেকেই গিয়েছিল। কেননা প্রথমে এ দ্বীপ ছিল রামনাথপুরম রামেশ্বরমের রামনাদ রাজাদের। ১৯২০ সালে সিংহল সরকার দ্বীপের দাবি জানালে ভারতের ব্রিটিশরা তা মেনে নেন। এটা নিয়ে স্বাধীনতার পর বিতর্ক চলছিলই। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধি ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ভারত-শ্রীলঙ্কার সরকারি চুক্তি হয়। শ্রীলঙ্কাতেও তখন মহিলা প্রধানমন্ত্রী- সিরিমাভো বন্দরনায়েকে। চুক্তি অনুযায়ী ভারত শ্রীলঙ্কার দ্বীপের ওপর অধিকার মেনে নেয়।
দু’বছর পর আবার একটা চুক্তিতে বলা হয়, দু’দেশের মৎস্যজীবীরা সেই দ্বীপে মাছ ধরতে পারবেন। দ্বীপে একটা ক্যাথলিক চার্চ রয়েছে-সেন্ট অ্যান্টনি চার্চ। দু’দেশের মৎস্যজীবীদের সেখানে গিয়ে উৎসব পালনের অধিকার ছিল। আরও বড় ব্যাপার, শ্রীলঙ্কার আওতায় থাকা ওয়াজ ব্যাঙ্ক নামে একটি জায়গা ভারত নিয়ে নেয়। কন্যাকুমারীর দক্ষিণে ওটা মৎস্যজীবীদের স্বর্গরাজ্য। কাটচাহিভু নিয়েই বরং তাঁদের মাথাব্যথা কম। ওখানে মাছ কমে গিয়েছে। তাতে কী? রাজনীতি তো আছে।
ইন্দিরা বা সিরিমাভো, দুই জাঁদরেল নেত্রী কেউ আন্দাজ করতে পারেননি, প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে এই দ্বীপ নিয়ে আবার জলঘোলা হবে। মোদি নিজেও কি এই বিতর্ক উসকে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন? ২০১৪ সালে ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি আরএম লোধাকে বলেছিলেন, ‘যদি আপনি কাটচাহিভু দ্বীপপুঞ্জ ফেরত নিতে চান, তা হলে আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে।’ রোহতগি কিন্তু মোদিরই বসানো লোক। শ্রীলঙ্কার দুই মন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, ভারতে নির্বাচন হচ্ছে বলেই আবার খোঁড়াখুঁড়ি করে আনা হচ্ছে বহু যুগ আগে মিটে যাওয়া এক ইস্যু।
অবধারিত প্রশ্ন করবেন, শ্রীলঙ্কার দ্বীপের সঙ্গে জলপাইগুড়ির বেরুবাড়ির সম্পর্ক কী?
ঘটনা হল, দ্বীপপুঞ্জ শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দেওয়ার সময় ইন্দিরা সরকার তামিলনাডু সরকার বা সুপ্রিম কোর্টের কাছে লিখিত অনুমতি নেয়নি। তখন জমানা এখনকার মতো জটিল ছিল না। তামিল নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইন্দিরা। মোদি সরকার এই আবেগটাকে কাজে লাগিয়েই এতদিনে বলছে, কংগ্রেস বা ডিএমকে কোনও পক্ষ তখন তামিলদের কথা ভাবেনি।
বেরুবাড়ির ক্ষেত্রে ১৯৬০ সালে বিধানচন্দ্র রায় যা করতে পেরেছিলেন, তা তামিল নেতারা করতে পারেননি কেন, সেই প্রশ্নটা উঠছে। বেরুবাড়িতে পাঁচের দশকে ছিল ১২ হাজার লোকের বাস। ৯ স্কোয়ার মাইলের জায়গাটা জওহরলাল নেহরু চেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানকে তুলে দিতে। পাকিস্তান চাপ দিচ্ছিল। জায়গাটা ছিল বিতর্কিত। বিধান রায় প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘এই জায়গাটার উন্নয়নে আমরা প্রচুর খরচ করেছি। রাস্তা, ব্রিজ বানিয়েছি। উদ্বাস্তুদের এনে জায়গা দিয়েছি। আমরা এ জায়গা ছাড়ব না।’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন ফিরোজ খান নুন। ১৯৫৮ সালে নেহরু-নুন চুক্তিতে মোটামুটি ঠিক হয়ে গিয়েছিল, বেরুবাড়িকে দু’ভাগ করা হবে। এক ভাগ যাবে পাকিস্তানে, এক ভাগ থাকবে ভারতে। নেহরুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হলেও বিধানচন্দ্র ওই চুক্তি মানতে নারাজ হন। তিনি যুক্তি দেন, ‘বেরুবাড়িকে অন্য দেশের হাতে দিতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান মানলে নিজের দেশের একটা অংশও ছাড়া যায় না।’ সুপ্রিম কোর্ট সেই যুক্তি মেনে নেয়। বাতিল হয়ে যায় নেহরু-নুন চুক্তি। বেরুবাড়ি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাংলার অনেক বিশিষ্ট নেতা। তখন পার্টি আলাদা হলেও এক হয়ে কাজ করার সৌজন্য ছিল নেতাদের। তাই বেরুবাড়ি হয়ে উঠেছে ভারতীয় আইনজগতে এক ইতিহাসের মাইলফলক।
ভারতকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দেখিয়েছিল বেরুবাড়ির আন্দোলন। ১) সংবিধানের ব্যাপক ক্ষমতা ও গুরুত্ব। ২) সংবিধানের বিশালত্ব। ৩) সংসদ ও সুপ্রিম কোর্টের সম্পর্ক কত চমৎকার হতে পারে। ৪) রাজ্যের স্বার্থে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এক হতে পারে রাজ্যের সব দল। কেন্দ্রে নিজেদের সরকারকেও রেওয়াত করে না রাজ্যের শাসকদল। তাৎপর্যপূর্ণ হল, এই জিনিসগুলো এখন আর দেখা যাবে না। একেবারে উলটো হবে সব। সংবিধানকেই পালটে ফেলার কথা চলছে তো কী আর হবে।
পক প্রণালীর এই দ্বীপ নিয়ে তামিল নেতাদের প্রথম দিকে অত খেয়াল ছিল না। খাবার জল নেই। মানুষ থাকতে পারে না। ওটা নিয়ে ভেবে কী লাভ? ঝামেলা শুরু হয় তামিল গেরিলা এলটিটিই’র সঙ্গে শ্রীলঙ্কা সরকারের যুদ্ধের সময়। সমুদ্রে তারপর তামিল সেনার টহল বাড়ে। অনেক তামিল মৎস্যজীবী ওখানে মাছ ধরতে গিয়ে বিপদে পড়েন। ২০১১ সালে জয়ললিতা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে বলেন, ভারত-শ্রীলঙ্কার হয়ে ইন্দিরা-সিরিমাভো চুক্তি অসাংবিধানিক। সেখানেই বাংলার বেরুবাড়ির কথা ওঠে। তখন সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, এমন করতে হলে আগে সংবিধান সংশোধন দরকার। জয়ললিতাদের বক্তব্য ছিল, শ্রীলঙ্কার দ্বীপের ক্ষেত্রে এ নিয়ম কেন মানা হবে না? ডিএমকে-কে সমস্যায় ফেলতে শেষদিকে জয়ললিতা এই দ্বীপকে ইস্যু করতেন ভোটে। এখন যা মোদি করছেন। তাঁর তো আবার দুই শত্রুকে এক অস্ত্রে ঘায়েল করার সুযোগ।
বেরুবাড়ি, বেরুবাড়ির নাম উচ্চারণ হচ্ছে তামিলনাডুর সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলে। আমরা কেউ কি খোঁজ রেখেছি, এত আন্দোলন, এত আইনের কচকচি দিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে রাখা জায়গাটা কেমন আছে? জলপাইগুড়ি থেকে হলদিবাড়ি যেতে সীমান্তের দিকে গেলে পড়ে বেরুবাড়ি। ওপারে ওই বাংলার পঞ্চগড় জেলা। চুরি-ডাকাতি সামলাতে ওখানে বেরুবাড়িতে পুলিশ ক্যাম্প আছে ঠিকই, তবে বড় অঘটন ঘটলে যেতে হবে ১৫ কিলোমিটার দূরের জলপাইগুড়ির কোতোয়ালি থানায়। রাতে হাসপাতাল যাওয়া মারাত্মক সমস্যার। পড়াশোনাও সমস্যা। দ্বীপ না হয়েও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে রয়েছে ৬৪ বছর পর।
আমরা জায়গাটা নিয়ে রেখেছি। অথচ সামগ্রিক উন্নয়নের চেষ্টা কিছুই হয়নি। অরুণাচলের পাহাড়ি গ্রামগুলোর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। পক প্রণালীর কাটচাহিভু দ্বীপও আমাদের হাতে থাকলে চোখধাঁধানো কোনও উন্নয়ন হত কি আদৌ?
মনে তো হয় না।