- সুমন ভট্টাচার্য
শিলিগুড়িতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভা আর কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জনগর্জন’ ব্রিগেড আসলে আমাদের কী শেখাল? রাজনীতিতে আদর্শ এবং তত্ত্বকথা শুধুমাত্র ইস্তাহার প্রকাশের দিন বলতে হয়, বাস্তবে চলতে হয় প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাট চালানোর কৌশল দিয়ে?
মোদি তাই যেমন কংগ্রেস ভাঙিয়ে আনা নেতাদের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী করে ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’কেই সর্বদা দুষে যান আর তৃণমূল নেত্রী বহিরাগত বর্জনের ডাক দিয়ে গুজরাট-বিহার থেকে লোক নিয়ে আসেন বাংলার ভোটে ঘাসফুলের প্রতীকে দাঁড় করানোর জন্য। মোদি এবং মমতার যদি স্লোগানকে ভুলে রাজনীতি করাতে মিল থাকে, তাহলে তৃণমূল নেত্রীও প্রধানমন্ত্রীর মতো রাজনীতিতে ‘প্যাকেজিং’-এর চমক আনতে চাইছেন।
কংগ্রেস, ‘ইন্ডিয়া’ জোট, পরিবারবাদ এবং দুর্নীতি, এইসব শব্দকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের আক্রমণ করাটাই আজকাল প্রধানমন্ত্রীর দস্তুর এবং একথাও অনস্বীকার্য গত দুই দশক ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি যে দাপট দেখাতে পেরেছেন, তার অন্যতম কারণ ‘কমিউনিকেট’ করার দক্ষতা। ঠিক কোনখানে তিনি থামবেন, কোথায় যতিচিহ্ন টেনে তিনি সামনের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দেবেন, আবার কখন তিনি নিজের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা তুলে আনবেন, এসবই যেন অমিতাভ বচ্চনের কোনও হিট সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো নির্দিষ্ট করা থাকে।
কিন্তু উত্তরবঙ্গে, বাংলার যে প্রান্ত গত লোকসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের ঝুলি ভরে দিয়েছিল, সেখানে এসে প্রথম ভোট প্রচারে ‘মোদি-ক্যারিশমা’ কি একটু ফিকে দেখাল?
এই প্রশ্ন তোলার কারণ শনিবার অসম, অরুণাচলপ্রদেশ এবং শিলিগুড়িতে তিনটি সভায় মোদি বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি বা তাঁর রিসার্চ টিমের কি খেয়াল ছিল না যে অসম এবং অরুণাচলে বিজেপির যে দুই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন, তাঁরা দুজনে আসলে কংগ্রেসেরই ‘দলবদলু’। পেমা খান্দুর বাবা দোরজি খান্দু তো আবার অরুণাচলেরই কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সেই সময় উত্তর-পূর্বের ওই সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্যের বিজেপির নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে কেন্দ্রের থেকে আসা বরাদ্দ অর্থ লুটপাটের অভিযোগ তুলতেন! নাকি মোদি-অমিত শা জুটি অন্য দল থেকে লোক ভাঙিয়ে আয়তনে এবং রাজনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে বিজেপিকে উত্তুঙ্গ উচ্চতায় নিয়ে যেতে যেতে আর খেয়ালই রাখছেন না যে, মঞ্চে কংগ্রেস থেকে আসা অথবা বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকারীরা কতজন থাকছেন!
শিলিগুড়ির সভা থেকে প্রধানমন্ত্রী তৃণমূল সরকারকে সন্দেশখালি নিয়ে বিঁধেছেন, পরিবারতন্ত্র নিয়ে কংগ্রেসকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। এসবকে মদত দেওয়ার জন্য ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের সদস্য বামেদের নিয়ে উপহাস করেছেন। কিন্তু মোদি কি জানতেন না মঞ্চে উপস্থিত গেরুয়া শিবিরের কোনও জনপ্রতিনিধি লম্বা পাঞ্জাবি তাঁর হাতের চে গুয়েভেরার উল্কিকে ঢেকে দিতে পারে, কিন্তু বামপন্থী অতীতকে ভোলাতে পারে না! আর বামের ভোট রামে এসেছে বলে, বা তীব্র মমতা বিরোধিতায় একদা শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব আওড়ানো মানুষজন রাম মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠায় ‘জয় শ্রীরাম’ বলছেন বলেই তো উত্তরবঙ্গেও গেরুয়া শিবিরকে শক্তিশালী দেখাচ্ছে।
তাহলে কোনও ঝাড়াই-বাছাই না করে কংগ্রেস থেকে বাম, সবার থেকে নেতা-কর্মীদের এনে আজকের বিজেপি যখন পুষ্ট হয়ে উঠছে, তখন পাশে শুভেন্দু অধিকারীকে বসিয়ে রেখে ‘পরিবারবাদ’ বা দুর্নীতি নিয়ে চর্বিত চর্বন করলে নরেন্দ্র মোদির ‘কমিউনিকেট’ করার দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে না?
তাহলে কি আমরা ধরে নেব, আরএসএসের অন্যতম তাত্ত্বিক, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম ‘পোস্টার বয়’ সুব্রহ্মণিয়াম স্বামী যেটা বলেছেন সেটাই সত্যি? গান্ধি পরিবারের বিরুদ্ধে ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ সংক্রান্ত মামলার অন্যতম হোতা থেকে বহু বিষয় সংঘের হয়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সুর বেঁধে দেওয়া স্বামী সম্প্রতি বলেছেন, আগামী নির্বাচনে বিজেপি ৩৭০টি আসনে জিততেই পারে, কিন্তু তার পিছনে কোনও ‘মোদি-ম্যাজিক’ কাজ করছে না। তা বিজেপি পেতেই পারে হিন্দুত্বের ঢেউতে ভর করে। কিন্তু গেরুয়া শিবিরের সেই অবিস্মরণীয় লক্ষ্য পূরণে নরেন্দ্র মোদির ‘ক্যারিশমা’র কোনও ভূমিকা নেই।
রবিবার দুপুরে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশ দেখতে দেখতে অবশ্য মনে হল চিরকালের ‘স্ট্রিট ফাইটার’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একটু রক্ষণাত্মক। তা না হলে সভার শুরুতে এতবার করে আদিবাসী এবং রাজবংশীদের কথা মনে করানো কি সন্দেশখালির ‘ক্ষত’কে ঢাকা দেওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টা নয়? যে রাজনৈতিক দর্শন এবং স্লোগানকে আঁকড়ে ধরে তৃণমূল বিজেপিকে কোণঠাসা করতে চাইছে, সেই ‘বহিরাগত’ তত্ত্বও তো ঢিলে হয়ে গেল যখন তিনি বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রে কীর্তি আজাদ আর বহরমপুরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর বিরুদ্ধে গুজরাট থেকে উড়িয়ে এনে ইউসুফ পাঠানকে প্রার্থী করেন! অনেক রাজনীতিকের মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তো এই ধরনের ভুল বিশ্বাস থাকা উচিত নয় যে, মুর্শিদাবাদের বাংলাভাষী মুসলিমরা হিন্দিভাষী পাঠানের সঙ্গে নিজেদের ‘আইডেন্টিফাই’ করতে পারবেন।
২০২১-এর নির্বাচনে ভোটকুশলী পিকে ওরফে প্রশান্ত কিশোরের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ ছিল ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’, এই ক্যাচ লাইন। পিকে যে ‘স্ট্রোক’-এ গেরুয়া শিবিরকে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে পাঠিয়ে দিতে পেরেছিলেন, তৃণমূলের প্রার্থীতালিকার দুই ক্রিকেটার একই রকম ‘স্ট্রোক প্লে’ করতে পারবেন না। তৃণমূলের এবারের ‘বহিরাগত বর্জন’-এ নিজেরাই হিট দ্য উইকেট হয়ে যাবেন! রবিবার রাজ্যের বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে এবং ব্রিগেডের মঞ্চে ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশন দিয়ে রাজ্যের শাসকদল বিজেপিকে যে ‘বহিরাগত জমিদার’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলার মানুষের আবেগ এবং ভালোবাসাকে কাছে টানার চেষ্টায় নেমেছিল, কীর্তি আজাদ-ইউসুফ পাঠান আর শত্রুঘ্ন সিনহার উপস্থিতি তো তার উলটো কথাই বলে।
রবিবারের ব্রিগেডে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাম্পে আভূমি নত হয়ে প্রণাম যদি সংসদ ভবনে ঢোকার সময় নরেন্দ্র মোদির সাষ্টাঙ্গে নমস্কারকে মনে করায়, তাহলে প্রশ্ন জাগবেই, তৃণমূলও কি বিজেপির মতো প্রচারের টেকনিকালিটির ওপর বেশি জোর দিচ্ছে? তা না হলে রাম্প, পিছনের ইলেক্ট্রনিক বোর্ডে নতুন প্রার্থীদের নাম ঘোষণা নিয়ে এত মাতামাতি থাকবে কেন! এটা ঠিক যুগটা এআইয়ের। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মোদি হয়তো এবারের প্রচারে এআই ব্যবহার করে নতুন কোনও চমক দেখিয়ে দেবেন। কিন্তু মমতা তো অন্য ধারার রাজনীতিক। এত দিন যাঁর প্রধান ফিক্সড ডিপোজিট ছিল মানুষের আবেগ আর দীর্ঘদিনের মাটিকে চেনা ছিল ‘টার্ম ডিপোজিট’, তিনিও কি যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বা নবীন প্রজন্মের সঙ্গে ‘সমঝোতা’-র রাস্তায় হেঁটে যান্ত্রিক কলাকৌশলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন!
মমতার ডাকা ব্রিগেড মানে ভিড় উপচে পড়বে, এটা তো জানা কথাই। একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে, তিনি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার প্রসঙ্গ তুলে মোদির সরকার এবং কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপিকে বিঁধবেন। ৩৪ বছরের বাম শাসনে শেষের দশ বছরকে বাদ দিলে যেমন সিপিএম নেতারা কেন্দ্রীয় বঞ্চনাকেই প্রচারের মূল অস্ত্র করে রাখতেন, তেমনই ২০১৪ থেকে দিল্লির মসনদে মোদি বসার পর থেকেই তৃণমূল নেত্রী ‘দিল্লি বনাম বাংলা’ স্লোগানকে রেখেই রাজনৈতিক কৌশল সাজিয়েছেন। তাই হয়তো মমতা-অনুরাগীরা তাঁকে আজকের ‘নিও-লেফট’ বা ‘নব্য বাম’ বলেন। এর পাশাপাশি মণিপুর থেকে দিলীপ ঘোষের বারমুডা পরার নিদান টেনে যে বিজেপিকে পালটা ‘নারী বিদ্বেষী’ বলে প্রচার করার চেষ্টা থাকবে, তাও সহজেই অনুমেয়। কিন্তু স্বভাবগতভাবে ‘স্ট্রিট ফাইটার’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি একটু রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে বলেই বারবার মনে করালেন, জনতা ভোট দিলেই তৃণমূলের প্রতিনিধিরা ভোটে জিতে রাজ্যের দাবি আদায় করতে পারবেন।
উত্তরবঙ্গে ঝড়ের মুখে পড়ে গিয়ে হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে নামার জন্য পায়ের চোট নয়, দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ, সন্দেশখালি নিয়ে লাগাতার বিরোধীদের নিশানা কি মমতাকে এইরকম ব্যাকফুটে শট নিতে বাধ্য করছে?
(লেখক সাংবাদিক)