- অজন্তা সিনহা
‘এবার তো তাহলে তোমায় গাড়ির পারমিট এমনভাবে বানাতে হবে, যাতে নাথু লা পর্যন্ত যেতে পারো! এতদিন চুইখিম-বাগ্রাকোট-ওদলাবাড়ি ট্রিপ করেছ, গ্রামের লোকজন আর মালপত্র নিয়ে। এবার ট্যুরিস্ট নিয়ে এদিক ওদিক, যেখানে খুশি…!’ আমার কথায় ম্লান হেসে গ্রামের চেনা তরুণ ড্রাইভারের জবাব, ‘কী যে বলেন, আমাদের কী সেই ভাগ্য? এসব পারমিট নিতে গেলে, অনেক টাকার ব্যাপার। আমাদের কি অত টাকা আছে?’ প্রসঙ্গ উত্তরবঙ্গে বহু আলোচিত জাতীয় সড়ক ৭১৭ এ ৭১৭ বি-এর নির্মাণকর্ম। যে হাইওয়ে গিয়েছে বাগ্রাকোট থেকে ভারত-চিন সীমান্তে নাথু লা পাস পর্যন্ত।
আমার শিলিগুড়ি থেকে চুইখিম যাওয়া-আসা এই পথ ধরেই। পরিচিত ড্রাইভার বরাবর বাগ্রাকোট থেকে আমায় পিকআপ করতেন। শিলিগুড়ি থেকে বাগ্রাকোট যাওয়া ফেরা সেভাবেই, ওই ভেঙে ভেঙে। কারণ, ওই গাড়ির পারমিট– ওদের ভাষায় গাড়ির কাগজ। যা কাছাকাছি পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রামে যাতায়াতের পক্ষে যথেষ্ট হলেও সমতলে চুইখিম-বাগ্রাকোট-ওদলাবাড়ি রুটের বেশি যাওয়ার অনুমতি দেয় না। এলাকার অধিকাংশ গাড়ি এভাবেই চলাচল করে এই দিকটায়। নাহ, চলাচল করে নয়, করত। জাতীয় সড়ক চালু হওয়ার পর তো এভাবে গাড়ি চালানো সম্ভব হবে না ওদের পক্ষে।
যে সড়ক নিয়ে এত মাতামাতি, তাকে কেন্দ্র করে কোনও নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু কিছু সত্য সামনে আনা একান্ত জরুরি। এই বছরের মধ্যে ঋষি পর্যন্ত নতুন জাতীয় সড়ক চালু হয়ে যাবে। ঋষি নদী মানে বাংলা-সিকিম বর্ডার। মধ্যবর্তী অগণিত গ্রামের জনজীবন যে অনেকটাই বদলে যাবে এই হাইফাই হাইওয়ে খুলে গেলে, তা সত্যি। গাড়িচালকদের পরিস্থিতিটা শুরুতেই বললাম। এবার হাইওয়ের পাশে দোকানপাট অর্থাৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা। এক্ষেত্রেও প্রশ্নটা পুঁজির। দিন আনা দিন খাওয়া, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত গ্রামের সরল, ছাপোষা মানুষ জাতীয় সড়ক পার্শ্ববর্তী ঝাঁ চকচকে দোকানপাট বা শপিং মলে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবেন, এমন রূপকথা আর যাই হোক, জীবনে লেখা হয় না। বড় জোর পাহাড়ের তরুণ প্রজন্ম কিছুটা তৈরি হয়ে শোরুমের চাকরি জোগাড় করে ফেলবেন। সিকিউরিটির কাজও হয়তো পাবেন কেউ কেউ। তবে, একাজ তো তাঁরা ইতিমধ্যেই শিলিগুড়ি, কালিম্পং, গ্যাংটক শহরে করে চলেছেন।
অনেকেই উত্তরবঙ্গ-সিকিমের পর্যটন ব্যবসার ফুলেফেঁপে ওঠা চেহারাটা ভাবছেন এই হাইওয়েকে কেন্দ্র করে। প্রশ্ন তোলা যায়, ঠিক কাদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠবে? এলাকার ছোট ছোট হোমস্টেগুলি কী থাকবে, যা গ্রামের লোকজনই নিজেদের যাবতীয় পুঁজি একত্র করে একদা শুরু করেছিল? নাকি হাইওয়ে ধরে টাকার কুমিররা চলে আসবে, বিশাল লগ্নির উপাচার নিয়ে। গড়ে উঠবে হোটেল, রিসর্ট, ফার্ম হাউস। একদা হোমস্টের মালিকরা হয়ে যাবেন এইসব বিশাল কর্মকাণ্ডের কর্মচারী! এইসব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবের মধ্যেই অবশ্য সেনাবাহিনীর অসাধারণ তৎপরতায় প্রস্তুত এই জাতীয় সড়ক নির্মাণে কাটা পড়েছে জঙ্গলের অগণিত গাছ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বিষয়ে পরিবেশবিদদের আপত্তি টেকেনি। টেকে না কখনোই। উন্নয়নে এমন কত গাছ মরে, কত ঘর ভাঙে, কে তার খবর রাখে?
(লেখক সাংবাদিক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)