প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লিঃ জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে এই মুহূর্তে দিল্লি অর্ডিন্যান্স বিলকে ভিন্ন নজরে দেখতে চাইছে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট। সংসদে শাসক দল বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দিল্লি অর্ডিন্যান্স বিলের ভবিষ্যৎ যখন অনেকটাই পূর্ব নির্ধারিত, ঠিক সে মুহূর্তে বিল দ্বৈরথে হার-জিৎ অপেক্ষা ভোটাভুটিতে মনস্থির করতে চাইছেন বিরোধী শিবিরের নেতারা৷ যদিও পর্যবেক্ষক মহলের একাংশ মনে করছেন, দিল্লি অর্ডিন্যান্স বিল নিয়ে হয়তো ভোটাভুটির পথেই হাঁটতে চাইবে না কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। সরাসরি ধ্বনিভোটের মাধ্যমে বিল পাস করিয়ে নিতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন তাঁরা। কিন্তু বিরোধীরা একজোট হয়ে পরিকল্পনা নিয়েছে, ফলাফল যাই হোক, সংসদের উভয় কক্ষে যেভাবেই হোক সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে, ভোটাভুটির মাধ্যমে নিজেদের শক্তির পরিমাপ করে নিতে চান তাঁরা। এই প্রসঙ্গে শুক্রবার তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন জানান, ‘ভোটাভুটির উপরেই জোর দেব আমরা। এর ফলে বুঝে নেব কারা সংবিধানের পক্ষে, আর কারাই বা তার বিরুদ্ধে।’
প্রসঙ্গত আগামী সপ্তাহে সংসদে আসতে চলেছে বিতর্কিত দিল্লি অর্ডিন্যান্স বিল। রাজ্যসভা নাকি লোকসভা, কোথায় প্রথম আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে বিতর্কিত এই বিলটি, তা নিয়ে জল্পনা চরমে উঠেছে। বিরোধী শিবির সূত্রে দাবি করা হয়, রাজ্যসভাতেই বিলটি প্রথম আলোর মুখ দেখবে৷ সম্প্রতি সেই পরিকল্পনায় বদল এসেছে বলে জানা গেছে। আগামী সোমবার, রাজ্যসভার বদলে লোকসভায় বিলটির পেশ হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শাসক দলীয় সাংসদ অন্তত সে রকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন যার নেপথ্যে রয়েছে প্রচ্ছন্ন মনস্তাত্ত্বিক কৌশল যার ফলে রাজ্যসভা অপেক্ষা সংসদের নিম্নকক্ষ বা লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে বিল পাশ করিয়ে নিতে পারলে সরকার পক্ষের মনোবল তুঙ্গে থাকবে। রাজ্যসভার যুদ্ধ তখন অনেকটাই সহজ হবে। কিন্তু বিরোধীরা তৈরি থাকছেন, লোকিসভা হোক বা রাজ্যসভায় যখনই বিল পেশ করা হোক না-কেন, সেটিকে রোখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে। আর সেখানেই উঠে এসেছে সংখ্যাতত্ত্বের এই সরল সমীকরণ, যেখানে ভোটাভুটির মাধ্যমেই হারজিৎ, জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে দেশের প্রকৃত হিতবাদী কারা, কারা সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ আর কারাই বা সংবিধানের অমর্যাদাকারী; তাঁদের চিহ্নিত করতে চাইছে সমমনোভাবাপন্ন বিরোধী জোট।
অবশ্য ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে চাঞ্চল্যকর রদবদলের ইঙ্গিত, যখন দক্ষিণের জগন রেড্ডির দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস অর্ডিন্যান্স বিল ইস্যুতে মোদী সরকারকেই সমর্থন করবে বলে দাবি করেছে। এর ফলে রাজ্যসভায় এই বিল পাশ করাতে আর সমস্যা হবে না বিজেপি সরকারের। কিন্তু এই অধ্যাদেশ, যা বিরোধীদের পাটনা সম্মেলনেও শুধুমাত্র ছিল আপ-এর সঙ্কটের বিষয়, এখন এই মুহূর্তে ক্রমশ ইন্ডিয়া জোটের ‘সারভাইভাল ফাইট’ হয়ে দাঁড়াল। এই অস্তিত্ব রক্ষা শুধু কাগজে কলমে বা সংখ্যাতত্ত্বে নয়; দার্শনিক চিন্তাধারাতেও। আর সেই জন্য যে মুহূর্তে বিরোধী শিবির তাদের সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরেছেন, সাথেসাথেই বদল নিয়ে এসেছেন দ্বৈরথের দিগদর্শনে, যেখানে প্রতিষ্ঠা পেল ভোটাভুটির তত্ত্ব। সে নিয়ে শুরু হয়েছে চূড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতিও৷ শেষ মুহূর্তে বেশি অসুস্থ না হলে এই বিল নিয়ে ভোটাভুটির দিনে সংসদে দীর্ঘদিন বাদে হাজির থাকতে পারেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, শিবু সোরেন, কপিল সিব্বলের মতো বর্ষীয়ান সাংসদরা। অনেককে অ্যাম্বুলেন্সে আর বহুজনকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে আসা হবে সংসদে। প্রবীণ ও বর্ষীয়ানদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, তার জন্য তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন সম্প্রতি রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দিয়ে দাবি করেন, সকলের সুবিধার্থে অন্তত একদিন আগে ঘরোয়া ভাবে নোটিস দিয়ে দিলে তাঁদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা সুবিধা হয়।
তবে ওয়াইএসআর-এর সমর্থন খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। এই বিল পাশের ক্ষেত্রে লোকসভায় কেন্দ্র সরকারের কোনও সমস্যা না থাকলেও, জট ছিল রাজ্যসভায়। কারণে সেখানে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। রাজ্যসভার সমীকরণ বলছে, অধ্যাদেশ আটকাতে গেলে নবীন পট্টনায়েকের বিজু জনতা দল এবং ওয়াই এস জগন্মোহন রেড্ডির দলেরও সমর্থন প্রয়োজন। জগন রেড্ডির দলের সমর্থন পেয়ে অনেকটাই আগ্রাসী কেন্দ্রীয় শিবির৷ অন্যদিকে, ওড়িশার বিজু জনতা দল এই বিতর্কে না জড়িয়ে ভোটাভুটি থেকে বিরত থাকতে ‘ওয়াক আউট’ করতে পারে। এর ফলে, সবদিক থেকে হার সুনিশ্চিত জানার পরেই নিজেদের ‘স্ট্র্যাটেজি’তে বদল এনেছে বিরোধীরা হারজিতের ঊর্ধ্বে সাংবিধানিক আনুগত্যকে দেওয়া হচ্ছে প্রাধান্য। ভোটাভুটিতে বিজেপি সহ যে সব দল সরকারের পক্ষে ভোট দেবে, তাদের ‘গণতন্ত্র এবং সংবিধান বিরোধী’ বলে চিহ্নিত করে পালটা প্রচার চালাবে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট। এই প্রসঙ্গেই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, ‘আমরা খুব ভালো ভাবেই বিলটির পরিণতি সম্পর্কে অবহিত৷ এও জানি সংসদে উত্থাপিত প্রতিটি বিলই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনে দিল্লি অর্ডিন্যান্স বিল টির গুরুত্ব অসীম, এবং আমরা ভোটাভুটির মাধ্যমেই এর নিস্পত্তি চাইব।’ তবে বিরোধীদের এই ‘সংবিধান রক্ষাকারী দল’গুলির ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে কেন্দ্র সরকারের উপরেই৷ সরকার চাইলে ভোটাভুটি অগ্রাহ্য করে ধ্বনিভোটেই কিস্তিমাত করতে পারে৷ দেখার বিষয়, শেষমেশ সরকার কী নীতি নির্ধারণ করে দিল্লি অর্ডিন্যান্স বিল নিয়ে।