আলিপুরদুয়ার: কাজী নজরুল ইসলামের কথায়, ‘মাতৃভাষা আমার অস্তিত্বের প্রমাণ, মাতৃভাষা আমার জীবনের অহংকার।’ এ কথা আমরা সবাই জানলেও মানি ক’জন। তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়েও বহু ভাষাই ব্রাত্য হয়ে থাকে। মায়ের শেখানো বুলি প্রাণখুলে আওড়াতে পারেন ক’জন? তবে বৈপরীত্য সবেতেই বিদ্যমান। মাতৃভাষাকে সবার মাঝে স্বীকৃতি আদায়ের এক অভিনব লড়াইয়ে শামিল দুই আদিবাসী কবি মালা খাড়িয়া এবং দুলিকা খাড়িয়া।
‘সাদরি গইত মে মোয়/ পরথম মায়কে আয়ো/ কাহিকে বলালো।’
মালার লেখায় ফুটে উঠেছে ভাষার সঙ্গে আমাদের সেই নাড়ির টান, আদিমতম যোগসূত্র, ‘সাদরি ভাষায় আমি আমার মাকে প্রথম মা বলে ডেকেছি।’
অন্যদিকে, দুলিকার লেখায় স্পষ্ট শিক্ষার হাত ধরে অন্ধকার থেকে আলোর পথের যাত্রী হওয়ার আহ্বান, ‘নিকেলকে আওয়া নিকেলকে আওয়া/ আন্ধার ছপরি সে আন্ধার ডহার সে’। বুধবার তাঁদের প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হল। আলিপুরদুয়ার সংলগ্ন মাঝেরডাবরি চা বাগান এলাকায় ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হল সাদরি ভাষায় লেখা বই দুটি। দুজনই ছোটবেলা থেকে লেখালেখি করতেন। পরবর্তীতে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরে লেখালেখির কাজ আরও মনোযোগ দিয়ে করেছেন। আজকের দিনে বই প্রকাশিত হওয়ায় দুজনেই আনন্দিত।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মালা খাড়িয়া বলেন, ‘কৃষক পরিবারে জন্ম। তাই খুব কষ্ট করেই জীবনে এগিয়েছি। লেখালেখির শুরুর দিকে বাংলা ভাষায় লিখতাম। পরবর্তীকালে যত বড় হয়েছি তত সাদরি ভাষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। সেই সময় দেখতাম প্রত্যেকে নিজের নিজের মাতৃভাষায় লিখত। সেই থেকেই সাদরি ভাষায় লেখা শুরু করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মূলত ২০১৯ থেকে শুরু। ওই ভাষায় অনেক পত্রপত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে। সাদরি ভাষায় ৪০-৪৫িট কবিতা, ১২-১৩টা গল্প, দুটি নাটকের পাশাপাশি গানও লিখেছি। তবে কবিতাই বেশি লিখি। আজ সাদরি ভাষায় ‘মানজার সাদরি কবিতা সংকলন’ প্রকাশ পেল। সেখানে ২৭-২৮টি কবিতা রয়েছে। বইটি মূলত আদিবাসী সমাজ এবং ডুয়ার্সের গ্রাম ও পাহাড় নিয়ে লেখা।’ অন্যদিকে, ফালাকাটার দেওগাঁওয়ের দুলিকা রাঙ্গালিবাজনা মোহন সিং হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষিকা। তিনিও দারিদ্র্যের মধ্যেই বড় হয়েছেন। আদিবাসীরা যাতে সমাজে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র তিনি শেখাচ্ছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে। এখনও পর্যন্ত ৪০-৪৫টি সাদরি কবিতা, ৪-৫টি গল্প লিখেছেন তিনি। এদিন তাঁর ‘সাদরি কবিতা সংকলন’ প্রকাশিত হল। সেখানে ১৭-১৮টি কবিতা রয়েছে।
দুলিকার কথায়, ‘আমাদের ভাষায় লেখক, কবি থাকলেও বেশ কম। তাই আজকের দিনে বই প্রকাশিত হওয়ায় ভালো লাগছে।’ আয়োজকদের তরফে পার্থ সাহা বলেন, ‘আজ দুই মহিলা আদিবাসী কবির বই প্রকাশ পেল। সংসার, জীবিকা সামলে তাঁরা সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত। এটি সত্যিই প্রশংসনীয় বিষয়।’