প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান: কিছু পুতুল নিয়ে গান বাজনার মধ্য দিয়ে লোক সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা। যা পুতুল নাচের আসর নামেই প্রসিদ্ধ। একদা এই বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতা থেকে শুরু করে শিশুদের কাছেও বিনোদনের মাধ্যম ছিল পুতুল নাচ। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তির যুগে পুতুল নাচ ও বাধাই গান যেন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। তবে আজও এই বাংলায় এমনও কিছু সংস্কৃতিবান মানুষ আছেন যাঁরা ইন্টারনেট কানেকশন যুক্ত অ্যান্ড্রয়েড ফোন হাতে নিয়ে ঘুরলেও পুতুল নাচ ও বাধাই গানকে ভুলতে চান না। তেমনই কিছু মানুষের উদ্যোগে আজও পূর্ব বর্ধমান জেলার পুটশুড়ির মেলায় সমাদর পেয়ে আসছে বাধাই গান ও পুতুল নাচের আসর। শুধুমাত্র এইসব প্রাচীন লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার টানে পুতুল নাচ ও বাধাই গানের আসরে ভিড় জমান বহু সংস্কৃতিবান মানুষ। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য, বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাচীন এই লোকশিল্পকে কোনওভাবেই হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।
রাজ্যের শস্যগোলা হিসাবে পরিচিত পূর্ব বর্ধমান জেলা। জমির পাকা ধান গোলায় তোলার কাজ অগ্রহায়ণেই সেরে ফেলেছেন এই জেলার চাষিরা। তারপর নবান্ন উৎসব কাটিয়ে এখন জেলার চাষি পরিবারগুলি মাতোয়ারা পৌষ পার্বণে। আর এই উৎসব মরশুমকে সামনে রেখেই প্রতিবছর পয়লা পৌষ থেকে জেলার মন্তেশ্বরের পুটশুড়ি গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় মেলা। মেলা সাতদিন ধরে চলে। মেলার মূল উদ্দেশ্য হল হারিয়ে যেতে বসা বাংলার লোকশিল্প ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। সেইমতোই পুতুল নাচ ও বাধাই গানের শিল্পীরাই এই মেলায় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন।
মেলা কমিটির সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত জানান, ২৩ বছর ধরে পুটশুড়ি গ্রামে এই মেলা হয়ে আসছে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সচেতনতার বিষয়গুলিকে এই মেলায় তুলে ধরা হয়। তার সঙ্গে প্রাধান্য দেওয়া হয় হারিয়ে যেতে বসা বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প ও সংস্কৃতিকে। তাই প্রতিবছর এই মেলায় পুতুল নাচ ও বাধাই গানের শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারা তাঁদের শিল্পকলা পরিবেশন করেন। সত্যেন্দ্রনাথবাবুর কথায়, মেলার কটাদিন পুটশুড়ি কার্যত হয়ে ওঠে বাংলায় প্রাচীন লোকশিল্প ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব জানান দেওয়ার কেন্দ্রস্থল।
এই মেলায় অংশ নেন নদিয়ার পুতুল নাচের ১০ জনের শিল্পী দল। বুধবার সন্ধ্যায় তাঁরা মেলার মঞ্চে পরিবেশন করেন সামাজিক পালা ‘মুশকিল আসান’। পুতুল নাচের এই পালায় লোক শিক্ষার কোন বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে? উত্তরে পুতুল নাচ দলের এক শিল্পী নিখিল সরকার বলেন, ‘সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে সঠিক ও ন্যায়ের পথ কি সেটাই পুতুল নাচের এই পালাগানের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে।’ পুতুল নাচের পালাগান কি এখন আগের মহিমায় ফিরছে? উত্তরে নিখিলবাবু আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুতুল নাচ এখন একপ্রকার বিলুপ্তির পথে। তবুও আমরা কয়েকজন প্রাচীন এই শিল্পকলাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এর থেকে রোজগার তেমন কিছুই হয় না। শুধুমাত্র আগামী প্রজন্মের কাছে পুতুল নাচের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমরা এখনও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে পুতুল নাচের পালাগান করে যাচ্ছি। এছাড়াও গ্রামেগঞ্জে এখনও কিছু শিল্পানুরাগী মানুষ আছেন, যাঁরা বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চান।’ তাই পুতুল নাচ এখনও অস্তিত্ব জানান দিতে পারছে বলে নিখিল সরকার দাবি করেন। সরকারি কোনও সহযোগিতা কি পান? এর উত্তরে নিখিলবাবু জানান, আগে কিছুই মিলত না। এখন পুতুল নাচের শিল্পী হিসাবে মাসে ১ হাজার টাকা সাম্মানিক মিলছে। একইভাবে বাধাই গানের শিল্পীরাও তাঁদের শিল্পের দুরাবস্থা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করছেন।
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধীপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার বলেন, ‘আমাদের সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। আগে তো কোনও সরকারই বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের পাশে দাঁড়ায়নি। আমাদের সরকার এই শিল্পীদের স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি সামান্য হলেও তাঁদের জন্য সরকার থেকে শিল্পীভাতাও দেওয়া হচ্ছে। পুতুল নাচ, বাধাই গান, এসবের প্রতি গ্রামের মানুষজনের এখনও একটা আলাদা টান রয়েছে।’ তাই এই শিল্প কখনও বিলুপ্ত হওয়ার নয় বলে সভাধীপতি মন্তব্য করেছেন।