সপ্তর্ষি সরকার, ধূপগুড়ি : নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারি বেতন ও ভাতা নিচ্ছেন বলে জলপাইগুড়িতে তৃণমূল কংগ্রেসের তিনজন ও বিজেপির এক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে ময়নাগুড়ির বিধায়ক কৌশিক রায়, ময়নাগুড়ি ও ক্রান্তি পঞ্চায়েত সমিতির দুই সভাপতি শিবম রায়বসুনিয়া ও পঞ্চানন রায় এবং জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ গীতা দাসরাজবংশী রয়েছেন। সব কিছু জানা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন চুপ করে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ জোরালো হয়েছে।
ময়নাগুড়ির বিধায়ক এবং ধূপগুড়ি ৪ নম্বর সার্কেলের বিন্নাগুড়ি টি গার্ডেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক কৌশিক রায় নিয়ম মতো বিধায়ক হিসেবে তাঁর কাজের দস্তাবেজ সহ খতিয়ান জমা না দিয়ে শিক্ষক হিসবে বেতন এবং বিধায়ক ভাতা দুটোই নেন বলে অভিযোগ। নিয়ম অনুসারে বিধায়ক পদ পূর্ণ সময়ের না হওয়ায় অধিবেশন সহ বিভিন্ন কমিটির সভা ও পরিদর্শন বাবদ বিধায়কের কাজের দিনগুলোতে তাঁরা সবেতন ছুটি পান। এক্ষেত্রে তাঁর বিস্তারিত মাসিক কর্মসূচি স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয় যা তাঁর হাজিরা খাতায় জুড়ে রাখা হয়। অন্য দিনগুলোয় নিয়মমতো তাঁদের স্কুলে হাজিরা দেওয়ার কথা। কৌশিকের ক্ষেত্রে স্কুলের তরফে সার্কেল অফিসে জমা দেওয়া হাজিরার রিটার্ন ফর্মে আজ পর্যন্ত কোনও দস্তাবেজ জমা পড়েনি। ফলে তিনি প্রতি মাসে বহালতবিয়তে শিক্ষকতার সম্পূর্ণ বেতন এবং বিধায়ক ভাতা সহ বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসেবে মোটা অঙ্কের ভাতা, দুই-ই গ্রহণ করে চলেছেন। এবিষয়ে বিজেপি বিধায়ক বলেন, তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের মতো সরকারি টাকা লুটের বেআইনি কাজ আমি করি না। যা করছি তা আইন অনুসারেই করছি। সম্পূর্ণ তথ্য আয়কর রিটার্ন এবং বিধানসভায় জমা দেওয়া হয়েছে।
জেলার তিন তৃণমূল নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে অবশ্য আরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আইন অনুসারে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি এবং জেলা পরিষদ কর্মাধ্যক্ষের পদ পূর্ণ সময়ের। নিয়ম অনুসারে এই পদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি স্কুল থেকে লিয়েন নিয়ে একলপ্তে পাঁচ বছর দায়িত্ব সামলাতে পারেন। অথচ ময়নাগুড়ি ও ক্রান্তি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদে আসীন শিবম রায়বসুনিয়া ও পঞ্চানন রায় এবং জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ গীতা দাসরাজবংশী পূর্ণ সময়ের পদে থেকেও নিয়মিত শিক্ষকতার মোটা অঙ্কের বেতন নিচ্ছেন। শিবম ময়নাগুড়ি উত্তর সার্কেলের জল্পেশ এলকে হাই অ্যাটাচ প্রাইমারি স্কুল, পঞ্চানন মালবাজার দক্ষিণ সার্কেলের সিধাবাড়ি এনএ প্রাইমারি স্কুল এবং গীতা সদর উত্তর সার্কেলের পাতকাটা বিএফপি স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
পূর্ণ সময়ের পদে থেকেও শিক্ষকতার বেতন নেওয়ায় শিবম ও পঞ্চাননের জোরালো যুক্তি, তাঁরা পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের নির্দেশিকা অনুসারেই একাজ করছেন। যদিও সেই নির্দেশিকার বিষয়ে দুজনের কেউই বিস্তারিত কিছু বলতে পারেননি। শিবম বলেন, এটা সরকারি পঞ্চায়েত দপ্তরের আইনেই আছে এবং বিডিও সেটা জানেন। পঞ্চানন বললেন, দুটোর মধ্যে যে কোনও একটা বেতন বা ভাতা নেওয়া যাবে বলে পঞ্চায়েত দপ্তরের ওয়েবসাইটেই নির্দেশিকা দেওয়া আছে। তবে সেই নির্দেশিকা আমি খুঁজতে পারব না। গীতার বক্তব্য, আমাকে এসব কিছু বলবেন না। আমি কোনও বক্তব্য রাখতে চাই না।
বিডিও জানেন বলে শিবম দাবি করলেও ময়নাগুড়ির বিডিও শুভ্র নন্দী এমনকি জেলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আধিকারিক জেলা শাসক মৌমিতা গোদারা বসু বিষয়টি শিক্ষা প্রশাসনের আওতায় বলে দায় এড়িয়ে গিয়েছেন। জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শক শ্যামলচন্দ্র রায়ও প্রাথমে দাবি করেন, যে কোনও একটা জায়গা থেকে বেতন বা ভাতা নেওয়া যাবে। তবে লিয়ে নিয়ে পূর্ণ সময়ের জন্যে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বা জেলা পরিষদ কর্মাধ্যক্ষ পদে থেকে কীভাবে সেটা সম্ভব বলে প্রশ্নে শিক্ষা প্রশাসকের সাবধানি বক্তব্য, দেখতে হবে। আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মিটিংয়ে রয়েছি।
পূর্ণসময়ে পদ সামলে স্কুলে অনুপস্থিত থেকে শিক্ষকতার বেতন গ্রহণ সঠিক নয় বলেই আইনজ্ঞদের মত। রাজ্যের অন্যতম আইনজীবী ফিরদৌস সামিম বলেন, নির্বাচিত হতে কোনও বাধা নেই তবে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বা তাঁর সহকারী, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বা সহকারী এবং জেলা পরিষদ কর্মাধ্যক্ষের মতো পূর্ণ সময়ের এগজিকিউটিভ পদে থাকতে গেলে তাঁকে লিয়েন নিতেই হবে। মন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। লিয়েন নিয়ে পঞ্চায়েতে দায়িত্ব সামলানো সত্ত্বেও স্কুল শিক্ষকতার জন্যে গ্রহণ করা বেতন ফেরাতে হলে সরকারি নিয়মে পাঁচ বছর যাবৎ নেওয়া প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা বেতন সুদ সহ জেলার তিন তৃণমূল নেতা-নেত্রীকে ফেরাতে হবে।