প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: সবকিছু ঠিক থাকলে বুধবার মণিপুর ইস্যুতে লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব বিষয়ক নোটিশ পেশ করতে চলেছে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট শিবির৷ পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামীকাল লোকসভায় মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে মণিপুর ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘মৌনতা’ ভাঙতে সরাসরি দল বেঁধে লোকসভা অধ্যক্ষ ওম বিড়লার কক্ষে হাজির হয়ে এই অনাস্থা প্রস্তাব বিষয়ক নোটিশ পেশ করবেন বিরোধী শীর্ষ নেতৃত্ব৷ মণিপুর ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলে বিরোধীদের এহেন সুপরিকল্পিত অনাস্থা প্রস্তাব বাদল অধিবেশনকে দ্বিগুণ উত্তপ্ত করবে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক মহল।
প্রসঙ্গত, বিরোধীরা চাইছেন সংসদ কক্ষে এসে মণিপুর ইস্যুতে মুখ খুলুন প্রধানমন্ত্রী মোদি৷ কিন্তু মোদি তাতে রাজি নন। বাধ্য হয়েই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই অনাস্থা প্রস্তাব শীর্ষক ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ প্রয়োগ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতারা, যা সোমবারে প্রাথমিকভাবে বিরোধী দলীয় বৈঠকে প্রস্তাব রাখা হয় এবং প্রায় সব দলই তাতে সম্মতিসূচক বার্তা জারি করেছেন। সংসদীয় রীতি অনুযায়ী, ৫০ জনের বেশি বিরোধী সাংসদের স্বাক্ষরিত অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিশ বুধবার তুলে দেওয়া হতে পারে লোকসভা অধ্যক্ষ ওম বিড়লার হাতে৷ এই নোটিশ সংসদে গৃহীত হলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকসভায় মণিপুর ইস্যুতে বক্তব্য রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে, এমনটাই মনে করছে বিরোধী জোট। এই প্রসঙ্গেই মঙ্গলবার কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সম্মিলিত উদ্যোগে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর দিয়েছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র সদস্য অন্যান্য রাজনৈতিক দল, দাবি বিরোধী শিবির সূত্রে। লোকসভায় নিয়ম অনুযায়ী অনাস্থা সংক্রান্ত নোটিশ পেশের দশদিনের মধ্যে তা গ্রহণ বা বর্জন করা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে লোকসভার অধ্যক্ষকে৷ এই ক্ষেত্রে লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা দেখার পরই পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করবে ‘ইন্ডিয়া’৷
অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বিরোধী রণনীতি চূড়ান্ত করতে মঙ্গলবার সকালে বিরোধী দলনেতা এবং কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের সংসদীয় কক্ষে বৈঠকে বসে বিরোধী শিবির৷ সূত্রের খবর, এই বৈঠকেই কংগ্রেসের তরফে জয়রাম রমেশ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বিরোধী শিবিরের অন্যান্য সদস্যদের সামনে পুরো রণকৌশল ব্যাখ্যা করেন৷ তাঁদের যুক্তি ছিল, লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে সরকারপক্ষ অনায়াসে অনাস্থা প্রস্তাবকে খারিজ করতে পারে৷ কিন্তু সে ক্ষেত্রে মণিপুর ইস্যুতে সরাসরি লোকসভায় দাঁড়িয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হবেন প্রধানমন্ত্রী৷ বলাবাহুল্য, অগ্নিগর্ভ মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেনজির ব্যর্থতার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে কাঠগড়ায় তোলা আরও অনেক সহজ হবে বিরোধীদের জন্য৷ সূত্রের খবর, কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের এই পরিকল্পনাতে সিলমোহর দিয়েছে গোটা বিরোধী শিবির৷ সেখানেই স্থির হয়েছে আগামীকাল লোকসভায় পেশ করা হতে পারে অনাস্থা প্রস্তাব সংক্রান্ত নোটিশ৷ বিরোধী শিবির সূত্রে খবর, এই নোটিশে স্বাক্ষর করতে পারেন ৫৫ জন বা তারও বেশি সাংসদ৷ অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিশ গৃহীত হলে বিরোধী শিবিরের তরফে প্রথম বক্তব্য পেশ করতে পারেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস সাংসদ, আইনজীবী মনীশ তিওয়ারি৷ একইরকমভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে বক্তব্য রাখতে পারেন লোকসভায় দলের ডেপুটি লিডার কাকলি ঘোষ দস্তিদার এবং মুখ্য সচেতক-আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সম্প্রতি তাঁরা মণিপুর সফরেও গিয়েছিলেন।
এদিকে, বিরোধী শিবির সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে আন্দাজ করে ‘বিকল্প’ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকারপক্ষ৷ মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সংসদীয় দুই দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং অধীর চৌধুরীকে চিঠি লিখে মণিপুর ইস্যুতে সংসদে সুষ্ঠু আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন৷ যদিও এই প্রস্তাবে কোথাও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আশ্বাস প্রদান করা হয়নি৷ উলটে অমিত শা’র দাবি বিরোধীদের কথামতো সরকার মণিপুর ইস্যুতে সংসদে আলোচনার জন্য প্রস্তুত, তবে এই ক্ষেত্রে সব বিরোধী দলকে সহযোগিতা করতে হবে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা এবং মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে৷ সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী শিবির৷ মণিপুর ইস্যুতে বিরোধী শিবির কতটা আগ্রাসী এদিন তার পরিচয় মেলে সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশনে যখন মণিপুর ইস্যুতে প্রবল বিরোধী বিক্ষোভের মুখে বারবার ভেস্তে যায় অধিবেশনের কাজ৷ প্রবল হইহট্টগোল ও বিশৃঙ্খলার মাঝে লোকসভায় ‘কো অপারেটিভ (সমবায়) বিল’ পেশ করতে গিয়ে হিমসিম খান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শা। ঠিক তখনই অন্যদিকে রাজ্যসভায় মণিপুর ইস্যুতে প্রবল বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং শাসক দলনেতা পীযুষ গোয়েল। বিরোধী বিক্ষোভের জেরে এদিনও পণ্ড হয়েছে অধিবেশনের কাজ।
অথচ একদিকে যখন মণিপুর ইস্যুতে বিরোধী শিবিরকে পাশে পাওয়ার জন্য ব্যতিক্রমী পন্থায় বিরোধী দলনেতাদের উদ্দেশ্যে সহমর্মিতা এবং সর্বোপরি সহযোগিতার বার্তা পাঠিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শা, ঠিক তখনই কেন্দ্রীয় শাসক দলের একটা বড় অংশ বিরোধীদের ‘অনাস্থা’ পরিকল্পনার প্রতি খোলা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে৷ মঙ্গলবার এই ইস্যুতে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক বলেন, ‘এর আগেও বিরোধীরা সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল৷ তার পরিণতি সবাই দেখেছে৷ এর পরেও আবার বিরোধীরা অনাস্থা আনলে প্রমাণ হবে বিরোধীরা এক দশক পিছিয়ে গেল৷’
প্রবীণ বিজেপি সাংসদ রবিশঙ্কর প্রসাদের দাবি, ‘বিরোধীরা যত খুশি অনাস্থা প্রস্তাব আনুক৷ আগেও জিতেছি, আবারও জিতব৷’ বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবের কটাক্ষ, ‘বিরোধী শিবিরে অনেক পন্ডিত ব্যক্তি আছেন৷ তাঁরা সংখ্যাতত্ত্ব খুব ভালো বোঝেন৷ তারপরেও অনাস্থা আনার অর্থ হল নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারা৷’ কিন্তু সে সবের ঊর্ধ্বে বিরোধী শিবির ‘যেন তেন প্রকারেণ’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সংসদীয় কক্ষে টেনে আনার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন৷
এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক মহলে পুনরায় চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে অনাস্থা প্রস্তাব এবং তার সার্বিক ইতিহাস। সংসদীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকে এযাবৎ মোট ২৭ বার লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে৷ সব থেকে বেশি ১৫ বার অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে প্রাক্তন কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির বিরুদ্ধে, যদিও প্রতিবারই তিনি জয়ী হয়েছেন৷ অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হয়েছেন পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, মোরারজি দেশাই, রাজীব গান্ধি, নরসিমহা রাও, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ ২৪ ঘন্টা ৩৪ মিনিট বিতর্ক হয়েছিল যা আজও রেকর্ড। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং এনডিএ সরকারের বিরুদ্ধেও আনা হয়েছিল প্রথমবার অনাস্থা প্রস্তাব৷ সেই সময়ে সরকারের পক্ষে ভোট পড়েছিল ৩৩০টি, বিপক্ষে ১৩৫টি৷ বুধবার সকালে লোকসভা অধ্যক্ষ ওম বিড়লার হাতে নোটিশ তুলে দেওয়ার পরই এবারের অনাস্থা প্রস্তাবে কী ফলাফল দাঁড়ায় সে নিয়েই তুমুল জল্পনা শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় মহলে।