শুভঙ্কর চক্রবর্তী, মালদা: হিজলের ফুল ফোটার সময় হয়েছে। বৈশাখকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হচ্ছে মালদার (Malda) টিলাসন। কিছুদিনের মধ্যেই লাল, গোলাপি ঝুমকোলতায় সাজবে দেশের সব থেকে বড় হিজল বন। কিন্তু সে খবর রাখেন না খগেন মুর্মু (Khagen Murmu)।
মালদা উত্তরের সাংসদ ব্যস্ত ভোট প্রচারে। গলায় গেরুয়া উত্তরীয় ঝুলিয়ে এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে জোড়হাত করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। না, গত পাঁচ বছরেও হিজল বনের খোঁজ নেননি তিনি। দিল্লি-হিল্লি অনেক করেছেন, কিন্তু বাড়ির পাশে টিলাসনে নজর পড়েনি তাঁর। তবে পড়া উচিত ছিল। পড়লে এলাকার আর্থসামাজিক ছবিটা বদলে যেত। দেশের সব থেকে বড় হিজল বনকে সাজিয়ে গুছিয়ে পর্যটনের মানচিত্রে ঢোকাতে পারলে তা খগেনের সাফল্যের খতিয়ানে মাইলস্টোন হয়ে থাকত। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ এনে প্রায় পাঁচশো হেক্টরের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে পরিকল্পনামাফিক অনেক কাজই করতে পারতেন সাংসদ। তৈরি হতে পারত প্রকৃতি পর্যটনকেন্দ্র। এলাকার বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হত। তবে সুযোগ পেয়েও কিছুই করতে পারেননি খগেন।
রাজনৈতিকভাবে উত্তর মালদার ক্ষমতা গনি পরিবারের হাত থেকে কেড়ে নিতে সফল হলেও কাজের নিরিখে সাংসদ হিসাবে কোনও ছাপই ফেলতে পারেননি তিনি। সাংসদ কোটার টাকায় অন্য সব সাংসদের মতো খগেনও সোলার লাইট বসানো, অ্যাম্বুল্যান্স কিনে দেওয়া ইত্যাদি কিছু কাজকর্ম করেছেন। তবে ওইটুকুই।
২০১৯-এর ভোট প্রচারে বা সাংসদ হওয়ার পর যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলির প্রায় কোনওটিই বাস্তবায়িত হয়নি। উত্তর মালদার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের সব থেকে বড় আতঙ্কের কারণ নদীভাঙন। রতুয়ার মহানন্দাটোলা, বিলাইমারি, হরিশ্চন্দ্রপুরের ভাকুরিয়া, ভালুকা সহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি, বসতবাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে গঙ্গা, ফুলহার, মহানন্দায়। সবহারানো সাধারণ মানুষের হাহাকার, চোখের জল মোছাতে ভাষণ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি সাংসদ।
কথা দিয়েছিলেন, জিতলে সামসী রেলগেট এলাকায় রেল ওভারব্রিজ (আরওবি) তৈরি করবেন। সামসী রেলগেট ওই এলাকার মানুষের ভোগান্তির সব থেকে বড় কারণ। কয়েক দশকের ওই সমস্যা মেটাতে বহু দরবার করেছেন স্থানীয়রা। হয়েছে আন্দোলন। কিন্তু কথা রাখতে পারেননি খগেন।
আরওবি ছাড়ুন, ৫১২ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে গাজোল রেলস্টেশন পর্যন্ত মাত্র ৩০০ মিটার রাস্তা মেরামত করার জন্য বহুবার এলাকাবাসী সাংসদকে অনুরোধ করেছিলেন। ওই রাস্তার বেহাল পরিস্থিতিতে স্টেশনে যাতায়াতে গাজোলের বাসিন্দাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। সেই কাজটুকুও হয়নি।
পাঁচ বছরে ডজনখানেকেরও বেশি সেতু তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মালদা উত্তরের সাংসদ। চাঁচল-২’এর খানপুরঘাট, মাধাইহাটঘাট, রতুয়া-২’এর চাতরঘাট, এলাহাবাদঘাট, গাজোলের চাকনগড়, পিরগঞ্জঘাট, কোথাও সেতুর জন্য একটা ইটও গাঁথা হয়নি। সাংসদ হওয়ার পর বড়মুখ করে রেলওয়ে স্টেডিয়াম তৈরির কথা শুনিয়েছিলেন। তবে এক কোদাল মাটিও ফেলতে পারেননি।
জিতলে এইমস বা এইমসের সুবিধাযুক্ত হাসপাতাল তৈরির কথা জোরগলায় বলেছিলেন খগেন। সেসব যে শুধুই ভোট পাওয়ার জন্য তা এতদিনে ভালোভাবে বুঝে গিয়েছেন সবাই। কেন্দ্রীয় বরাদ্দে নবোদয় বিদ্যালয়, পর্যটনের উন্নয়ন- হয়নি কিছুই। মালদার বিখ্যাত আম নিয়েও দিশা দেখাতে পারেননি তিনি। বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে এনে আম প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগে কার্যত কোনও পদক্ষেপ করেননি।
মালদা বিমানবন্দর চালুর জন্য দু’-একবার লোকসভায় সরব হয়েছিলেন ঠিকই, তবে জট কাটাতে পারেননি। খগেন কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকদলের সাংসদ। ফলে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আদায়ের ক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ ছিল তাঁর হাতে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। মালদার পাট নিয়েও হেলদোল ছিল না তাঁর। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন, প্রশিক্ষণ, বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে বলেই জানিয়েছিলেন। তবে বাস্তবে কিছুই হয়নি।
তাঁর দলের অন্য সাংসদরা যেখানে রেলের নানা প্রকল্প এনে নিজেদের এলাকার মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দিতে পেরেছেন সেখানেও পিছিয়ে খগেন। তথ্য বলছে, একসময় মালদা কোর্ট থেকে সিঙ্গাবাদ হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন চলত। পরবর্তীতে বাংলাদেশে যাতায়াত বন্ধ হলেও এক বগির একটি ট্রেন মালদা টাউন থেকে সিঙ্গাবাদের মধ্যে চলাচল করত। সেই ট্রেনটিও বহু আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
সিঙ্গাবাদ হয়ে ভারত-বাংলাদেশ ট্রেন লাইন চালু আছে। মাঝেমধ্যে মালগাড়ি দু’দেশের মধ্যে যাতায়াত করে। ওই রুটে ফের যাত্রীবাহী ট্রেন চালুর দাবি দীর্ঘদিনের। ট্রেন চালু হলে এবং সিঙ্গাবাদে স্টপ হলে হিজল বন দেখতেও পর্যটকদের ঢল নামত। সিঙ্গাবাদের পাশেই টিলাসন। ফলে মালদা শহর থেকেও ট্রেনে সহজেই পৌঁছানো যেত হিজল বনে। ট্রেন চালুর ব্যাপারে গা করেননি সাংসদ। মহদিপুরের মতো সিঙ্গাবাদেও স্থলবন্দর তৈরির সম্ভাবনা ছিল। সেটা হলে এলাকার আর্থসামাজিক ছবিটাও বদলে যেত। ওই বিষয়েও উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি সাংসদের মুখে।
কাজকর্মে লবডঙ্কা খগেন বিপদে-আপদেও মানুষের পাশেও সেভাবে দাঁড়াতে পারেননি। কোভিডেও সেভাবে তাঁর দেখা পাননি এলাকাবাসী। তবে তাঁর একটা গুণের প্রশংসা করেছেন সকলেই। সাংসদ হলেও সহজেই মিশে যেতে পারতেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। হাসিমুখে কথা বলতেন সকলের সঙ্গেই। জনপ্রতিনিধি হিসাবে সেটাই তাঁর টিআরপি।
রং দেখে সবসময় আম চেনা যায় না। বাইরে থেকে দেখে পাকা মনে হলেও অনেক সময়ই সেই আম খেতে টক হয়। আদতে মালদা উত্তরের মানুষও রং দেখেই টক আম বেছে নিয়েছিলেন।