- সুমন ভট্টাচার্য
১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশের পর সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক, প্রয়াত অনিল বিশ্বাস একবার আমাকে বলেছিলেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল মূলত গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক শক্তি। তার কারণ সেবারের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল যে ৭ আসন জিতেছিল, সেই সবক’টিই জিতেছিল গঙ্গার এপাশে-ওপাশে গড়ে ওঠা জনপদগুলিতে।
তারপরে গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের বয়স ২৫ পেরিয়েছে, আর গত ১৩ বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায়। আর পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতা পেতে গেলে দক্ষিণবঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেই হয়। কারণ দক্ষিণবঙ্গে প্রায় ২৪০টির মতো বিধানসভার আসন, লোকসভা নিরিখেও দক্ষিণবঙ্গ ৩৪ জনকে ভারতের সংসদে পাঠায়। তাই দক্ষিণবঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপন না করতে পারলে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা ধরে রাখা যায় না। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও উত্তরবঙ্গে সাফ হয়ে গেলেও তৃণমূল যে শেষপর্যন্ত রাজ্যে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল, তার কারণ ছিল দক্ষিণবঙ্গ। অর্থাৎ দক্ষিণবঙ্গের ৩৪টি আসনের মধ্যে ২২টি আসন পেয়েই তৃণমূল এই রাজ্য থেকে সবচেয়ে বেশি সাংসদ পাঠাতে পেরেছিল।
একইসঙ্গে এটাও সত্যি, উত্তরবঙ্গের চমকপ্রদ সাফল্যের পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গেও বামেদের মুছে দিয়ে প্রধানতম বিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল গেরুয়া শিবির। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে, অর্থাৎ বর্ধমান থেকে শুরু করে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে বিজেপির সাফল্য ছিল চমকে দেওয়ার মতো। কিন্তু ২০১৯-এর রাজনৈতিক সাফল্যকে পরবর্তীকালে বিজেপি ধরে রাখতে পারেনি। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে দেখা গিয়েছিল রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তের জেলাগুলিতে, অর্থাৎ দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং ঝাড়গ্রামে আবার প্রবলভাবে ফিরে এসেছে ঘাসফুল শিবির।
সামনের লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে, তাই সকলেই হিসেব কষছে, এবার কী হবে? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, যিনি গত পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই রামের কাছে চলে যাওয়া বামেদের ভোট ফেরাতে তৎপর, তিনি যেমন দাবি করছেন, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন সবাইকে চমকে দিতে পারে। একথা অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই যে ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখিয়েছে রাজ্যে বিরোধী পরিসরে গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে সমানে সমানে যুঝছে সেলিম-অধীর এবং নৌশাদ সিদ্দিকীর জোট। অর্থাৎ বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ যথেষ্ট শক্তি বাড়িয়ে বিজেপির সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছে। কিন্তু লড়াইটা যেখানে লোকসভা নির্বাচনের, যেখানে নরেন্দ্র মোদি ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করবে, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়ার নির্বাচন, সেখানে ‘নমো’ ক্যারিশমা-কে মোকাবিলা করতে পারবে বাম-কংগ্রেস জোট?
২০১৯-এর নির্বাচনে বামেদের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ভোট বিজেপির দিকে গিয়ে যাবতীয় রাজনৈতিক সমীকরণকে উলটে দিয়ে গেরুয়া শিবিরকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাফল্য দিয়েছিল। তাই বামেরা চাঙ্গা হলে বিজেপির ভোটবাক্সে টান পড়বেই। সেই কারণেই বোধহয় রাহুল গান্ধির ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রায় মুর্শিদাবাদে বাম নেতৃত্ব যোগ দিয়েছে। আর এই সমীকরণকে আক্রমণ করতে গিয়ে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী রাহুলকে একেবারে গাল দিয়ে শালীনতার সীমাকে লঙ্ঘন করে গিয়েছেন।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় দক্ষিণবঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। প্রথমত পূর্ব মেদিনীপুরে ঘাসফুল শিবিরের সেনাপতি শুভেন্দু দল ছেড়ে গেরুয়া ঝান্ডা হাতে তুলে নিয়েছেন। স্বভাবতই পূর্ব মেদিনীপুরের দুটি লোকসভা আসন, অর্থাৎ কাঁথি এবং তমলুক, যেখান থেকে গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে অন্য দুই অধিকারী জিতেছিলেন, সেখানে এবার অ্যাডভান্টেজ গেরুয়া শিবির। আবার পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার ব্যারাকপুর বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে। আসানসোল থেকে নির্বাচিত সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় ইস্তফা দিয়ে পদ্মফুল ছেড়ে ঘাসফুলের প্রার্থী হয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্য মন্ত্রীসভার সদস্য। আর ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং গেরুয়া শিবির ছেড়ে আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে ফিরে গিয়েছেন। তাহলে পাটিগণিত অনুযায়ী দক্ষিণবঙ্গের সমীকরণে তৃণমূল এবং বিজেপি, দুই শিবিরই ২টি করে আসন বদলাবদলি করে নিয়েছে।
দুই বর্ধমান, যা গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে যথেষ্টই হতাশ করেছিল, সেখানে হারানো জমি পুনরুদ্ধারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথেষ্টই মরিয়া। সেই কারণেই তৃণমূল সুপ্রিমো রেড রোডের ধর্না মঞ্চে বসেও দুই বর্ধমানের দলের নেতাদের ডেকে বৈঠক সেরে নিয়েছেন। বুদ্ধিমান রাজনীতিক হিসেবে মমতা জানেন তিনি শত্রুঘ্ন সিনহাকে প্রার্থী করে যেমন আসানসোল পুনরুদ্ধার করেছেন, তেমনই বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনও এবার ফেরত পেতে পারেন বিজেপির সাংসদ সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়ার বিরুদ্ধে অনুপস্থিতির অভিযোগে শান দিয়ে।
আবার বীরভূমকে পাখির চোখ করে রাখা বিজেপি নেতৃত্ব যদি আশাবাদী হয় যে, অনুব্রত মণ্ডলের অনুপস্থিতি এবং সীমান্তের ওপাশের ঝাড়খণ্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ তারা পাবে, তাহলে মমতাও তৎপর এবং বামেরাও লাল মাটিতে লাল পতাকার পুনরুজ্জীবন ঘটাতে ঝাঁপ দিয়েছে। দক্ষিণবঙ্গে বিজেপির সাফল্যের রেসিপিতে যদি পুরোনো তাস মতুয়া ভোট থাকে, তাহলে নতুন ইয়র্কার অবশ্যই রাম মন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা!
গেরুয়া শিবির মনে করে যে, রাম লহর দিয়ে ঝাড়খণ্ড, বিহারের লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা আসনগুলিতে তারা আবার পদ্মফুল ফোটাতে পারবে। ঠিক যেমনই বিজেপি এবার আশাবাদী যে, উত্তর ২৪ পরগনায় যদি মতুয়া ভোট তাদের ডিভিডেন্ড দেয়, তাহলে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় জয়নগর বা মথুরাপুরে জাতপাতের রাজনীতি এবং রামলহর ভিকট্রি স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেবে এবং এই ধরনের নতুন আসন যোগ করতে পারলেই গেরুয়া শিবির অমিত শা’র দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলবে। এর বিপরীতে রাহুলের ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রার সাফল্যে উজ্জীবিত কংগ্রেস নেতারা অবশ্য বিজেপির এইসব হিসেবনিকেশের পিছনে ‘সেটিং তত্ত্ব’কেই সামনে আনছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী তো ধারাবাহিকভাবে তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গোপন সমঝোতার কথা বলেই যাচ্ছেন আর তাঁর দলের দক্ষিণবঙ্গের নেতারা, যেমন সৌম্য আইচ রায়রা বলছেন তৃণমূল সেটিংয়ে না গেলে উত্তর কিংবা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় বিজেপির পক্ষে আসন পাওয়া মুশকিল।
গত লোকসভা নির্বাচনের সময় কলকাতায় অমিত শা’র রোড শো-র দিন কলেজ স্ট্রিটের বিদ্যাসাগরমূর্তি ভাঙার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক অনেক হিসেবকে উলটেপালটে দিয়েছিল। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পরে পশ্চিমবঙ্গের যে ক’টি আসনে লোকসভা ভোট হয়েছিল, সবক’টিতে বিজেপি হেরেছিল। অনেকেই মনে করেন বামেদের ভোট রামে গিয়ে গেরুয়া শিবিরকে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসার যে সুযোগ করে দিচ্ছিল, সেই বাম ভোট বা শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি আর বিজেপির সঙ্গে নিজেদের একাত্মতাকে অনুভব করতে পারেনি। দমদমের মতো আসনে শমীক ভট্টাচার্যের মতো বিজেপির সুবক্তা প্রার্থী যে শেষপর্যন্ত সৌগত রায়ের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তার কারণ এই হিন্দু বাঙালির মোহভঙ্গ হওয়া এবং বামেদের দিকে ফিরে যাওয়া!
২০২৪-এ কি আবার দক্ষিণবঙ্গে, বিশেষত গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে সেইরকম কিছুর পুনরাবৃত্তি হতে পারে? তৃণমূল শিবিরও জানে যে হুগলি, দুই ২৪ পরগনা, নদিয়ায় বামেরা যদি নিজেদের শক্তি ফেরত পায়, তাহলে বিজেপির বিপদ আর ঘাসফুলের সুবিধা!
যাঁরা মনে করেন যে দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূল টিকে রয়েছে শুধুমাত্র সংখ্যালঘু ভোটের সমর্থনে, তাঁরা ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলকে বিশ্লেষণ করলেই দেখতে পাবেন- উত্তর ২৪ পরগনা, হুগলি কিংবা নদিয়ায় তৃণমূলের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন হয়েছিল আসলে হিন্দু ভোটের উপর ভর করেই। গ্যাসের দাম থেকে মূল্যবৃদ্ধি, মমতা আমজনতার হৃদয়ের কথা বলে বিজেপিকে কিস্তিমাত করে দিয়েছিলেন। এবারের ২০২৪-এর নির্বাচনে কি মোদি বিরোধী শক্তিগুলি, সেই কৌশলকে আবার প্রয়োগ করতে পারবে? অর্থাৎ বিজেপি যদি রামের ছবি দিয়ে প্রচারকে এগিয়ে রাখে, বামেরা চাকরির অভাবকে হাতিয়ার করে কতটা সেই লহরকে ভোঁতা করে দিতে পারবে, তার উপরই দক্ষিণবঙ্গের রাজনীতি নির্ভর করে আছে।
(লেখক সাংবাদিক)