- গৌতম সরকার
কেউ কারও নয় গো মা। সংসারে যে সবই অনিত্য। আধ্যাত্মিক জগতের সে সব কথা যেন রাজনীতিতেও সত্য। কোনও দলে কেউ যেন চিরস্থায়ী নন। আজ যিনি বামে, কাল তিনি ডাইনে। দীর্ঘদিন সবুজ রং গায়ে মেখে রাখার পর কারও কারও অতি ভক্তি হচ্ছে গেরুয়ায়। লালের প্রতি বিশ্বাস জলাঞ্জলি দিয়ে কপালে গেরুয়া তিলক পরার নজিরও কম নয়। ভক্তিভাব আমাদের জিনগত।
কিছুমাত্র উপকার পেলে কোনও কোনও মানুষের ওপর দেবত্ব আরোপ করা আমাদের স্বভাব। অথচ দোষে-গুণে মানুষ। শুধুই গুণের অধিকারী মানুষ হবেন কী করে? হয় ভগবান হবেন নয়তো শয়তান। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হঠাৎ রাজনীতিতে নেমে পড়াটা এইসব সাত-পাঁচ ভাবাচ্ছে। ‘খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে।’ এমনই দেখছি চারপাশ। এখন আবার ভগবান জ্ঞানে ধাক্কা লেগেছে।
প্রাক্তন বিচারপতি মশাইয়ের এতদিনের হিতাকাঙ্ক্ষী, গুণমুগ্ধদের হাহাকার, আক্ষেপে সেটা স্পষ্ট। ভাবটা যেন, এই ছিল তাহলে মনে? রাতারাতি ভিলেন হননি ঠিকই, কিন্তু ভগবানের ভাবগতিকে সন্দেহ জেগেছে। যদিও কেউ কেউ বলছেন, কেউ যদি মনেপ্রাণে সমাজের ভালো করার স্বপ্ন দেখেন, ক্ষতি কী? তাছাড়া আজকাল রাজনীতিতে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, রুচিশীলদের যে অভাব আছে, তা এতে পূরণ হবে।
এ সব কথা যখন ভাবছি, তখন উত্তরবঙ্গ সংবাদে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও তাপস রায়ের পদত্যাগ বিষয়ে প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় পড়ে আমার এক বিদেশবাসী ভাই হোয়াটসঅ্যাপে লিখলেন, এঁরা দুজন অনৈতিকতা, অসততার পর্দাফাঁস করলে তো ভালোই। হক কথা। রাজনীতিতে যখন মতাদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ, জনগণের সেবায় অনুগত মানুষের খুব অভাব, তখন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিত্বদের স্বাগত জানানোই উচিত।
নকশাল আন্দোলনে ছিলেন এক ঝাঁক বুদ্ধিদীপ্ত, নির্লোভ, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা তরুণ-তরুণী। আন্দোলনটা ধাক্কা খাওয়ার পর হয় তাঁদের কেরিয়ারের মোহ চেপে ধরেছে নাহয় তাঁরা লুম্পেনদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। ‘যাঁরা ছিল একদিন প্রেরণার সাথী, তাঁদের অনেকে আজ একান্তে নীড় গড়ে, মদ-মাংস ছড়াছড়ি ফ্লুরোসেন্ট বাতি…’ অথবা ‘একদিন যারা ছিল বুকের নিবিড় কাছে তাদের অনেকে আজ ঘোরে নিয়ে ছুরি…।’
পাণ্ডিত্যে, বৌদ্ধিক ভাবনায় শাণিত নেতা-কর্মীদের বদলে রাজনৈতিক জগৎজুড়ে এখন আয়ারাম-গয়ারামদের খেলা। এ যেন পান্নালাল দাশগুপ্তের সেই বিখ্যাত শ্যামাসংগীত, ‘ভেবে দেখ মন কেউ কারও নয়, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে…।’ এই যে হঠাৎ রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারীর হাতে ঘাসফুলের পতাকা তুলে দিয়ে তৃণমূল ভাবল, তাপস রায়কে ভাঙানোর বদলা নেওয়া গেল। কিন্তু মুকুটের এমন ‘মুকুট’ বদলের পিছনে কিন্তু রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে পদ্মের টিকিট না পাওয়ার আক্ষেপটাই বড় কারণ।
নদিয়ার উন্নয়নের স্বার্থে দলবদলের যুক্তিতে গেরুয়া দলের ভাবনা ত্যাগ দ্বিচারিতা বই কিছু নয়। কমল গুহর ভাবশিষ্য উত্তরবঙ্গের পরেশ অধিকারী নেতাজি সুভাষ প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক ছাড়তে পারেন, স্বপ্নেও কি কেউ ভেবেছিলেন? পরেশের আর কী দোষ? কমল-পুত্র উদয়ন গুহই তো বাবার আজীবন আঁকড়ে রাখা মতাদর্শ হেলায় লাথি মেরেছেন। সিংহলাঞ্ছিত লাল পতাকা ছেড়ে ঘাসফুলের ঝান্ডায় জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে। আনুগত্য, দায়বদ্ধতা, মতাদর্শ শব্দগুলি যেন উবে যাচ্ছে রাজনীতির অভিধান থেকে।
তাপস রায় দল ছাড়বেন শুনে প্রথমে অনেককে অবিশ্বাসী হতে দেখেছি। গান্ধিবাদী মতাদর্শে আজীবন আস্থাশীল মানুষটি ৫৬ বছর কংগ্রেস, তৃণমূলে কাটিয়ে ভিন্ন রাজনীতির জুতোয় পা গলাবেন ভাবতে দ্বিধা হলেও বাস্তবে তাই ঘটল। তিনি তৃণমূলে উপেক্ষিত ছিলেন সন্দেহ নেই। যোগ্য মর্যাদা, পদ পাননি। একদম ঠিক। কিন্তু এজন্য তাঁকে কখনও কেউ উষ্মা প্রকাশ করতে শোনেননি। ভোটের মুখে এসে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাড়িতে ইডি তল্লাশির পর হঠাৎ শুধু মান-অভিমান নয়, বিদ্রোহ করে বসলেন।
যেভাবে বিধায়ক পদ ছেড়ে ভিন্ন দলে হাঁটা দিলেন, তাতে পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ হিসেবে যাঁকে এতদিন সবাই মনে করে এসেছে, তিনি এই নজির তৈরি করলে কোনওকিছুতেই আর অবাক হওয়ার থাকে না। বিজেপির টিকিটে নির্বাচিত কালিয়াগঞ্জের সৌমেন রায় কিছুদিন ঘাসফুল শিবিরে ভিড়ে ফিরে গেলেন পদ্মবনে। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে গেরুয়া ঝান্ডা ধরতে অমিত শা’র পাঠানো চার্টার্ড ফ্লাইটে পড়িমরি দৌড়েছিলেন দিল্লিতে।
ভোটে গো-হারান হেরে তাঁর বোধোদয় হল, দিদি বিনা গীত নেই বঙ্গে। ফলে পুনর্মূষিকো ভব। ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু’ স্রোতে ভেসে থাকার এই প্রবণতায় না আছে মতাদর্শ, না আছে দলের প্রতি আনুগত্য। যাঁর যেখানে স্বার্থসিদ্ধি, তিনি সেখানে যেতে দ্বিধাহীন, বেশরম, কোনও অপরাধ বোধ নেই। সেখানে যদি সত্যিই ধর্মযুদ্ধের ভাবনা নিয়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় রাজনীতিতে আসেন, স্বাগত জানানোই উচিত।
কিন্তু নাছোড় প্রশ্ন মাথায় ঘুরঘুর করে, ধর্মযুদ্ধটা কি বিচারপতির আসনে বসে করা যেত না? সেখানে বরং নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার অবারিত সুযোগ। তিনি যে কট্টর তৃণমূল বিরোধী, বিচারপতির আসনে বসা তাঁর নানা মন্তব্যে অনেকদিন থেকে সেটা স্পষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আইনের ধারার বদলে ‘মাইন্ডসেটে’র ভিত্তিতে বিচার ন্যায্য হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন আসে।
তিনি বামপন্থার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। সেরকম মানুষের শেষ অবধি গেরুয়া রংয়ে আশ্রয় তাই সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকে না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাতাবরণ এ রকম জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে পোড়খাওয়া নেতা তাপস রায়কে ‘যতদিন বাঁচব, বিজেপির দেওয়া দায়িত্ব পালন করব’ বলে কার্যত মুচলেকা দিতে হচ্ছে। তৃণমূল ত্যাগ যে নেহাতই দলে উপেক্ষিত হওয়ার কারণে, তা এখন স্পষ্ট। অর্থাৎ তাঁর ‘ধর্মযুদ্ধ’ মতাদর্শের টানে নয়, শুধুই ব্যক্তিগত কারণে।