- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
যাঁরা নিয়মিত ইন্টারনেট দেখেন, তাঁদের কাছে হেমিল অশ্বিনভাই মঙ্গুকিয়া নামটা অতি পরিচিত। যতবার তাঁর মৃত্যুর খবর পড়ি, এক বিষণ্ণতা গ্রাস করে বারবার।
গুজরাটের সুরাটের কাছে গ্রামের ছেলে হেমিল। ইউটিউবে এখন অজস্র রিক্রুটমেন্ট ভিডিও পোস্ট করেন অনেক এজেন্ট। সেটা দেখে, ভালোভাবে খোঁজ না নিয়েই ভারতের অনেক ছেলে টাকা দিয়ে বিদেশে চাকরি করতে যান। ভাবেন, এখন টাকা খরচ হয় হোক। পরে প্রচুর কামাই করে তুলে নেওয়া যাবে। যেভাবে পশ্চিমবঙ্গ সহ অধিকাংশ রাজ্যে লোকে ঘুষ দিয়ে চাকরির খোঁজে থাকে।
এইভাবে রাশিয়ায় চাকরির খোঁজ পেয়েছিলেন হেমিলও। ভেবেছিলেন সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পেয়েছেন। রাশিয়া পৌঁছে অনেক পরে বুঝলেন, এক জালিয়াতি চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। রাশিয়ান মিলিটারি তাঁর পাসপোর্ট নিয়ে রাশিয়ান ভাষায় লেখা কাগজে সইসাবুদ করিয়ে, সোজা এক আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার কাজ করতে হয়। বন্দুক বইতে হয়।
এই করতে করতে তাঁকে একদিন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হল। উপায় নেই। বলা হয়েছিল, কথা না শুনলে রাশিয়ান জেলে পচতে হবে। বাড়িতে ফোন করতেন মাঝে মাঝে। একদিন হঠাৎ তা বন্ধ হয়ে গেল। বেশ কয়েকদিন পরে খবর এল, ইউক্রেনে যুদ্ধে গিয়ে মিসাইল আক্রমণে মারা গিয়েছেন হেমিল।
মারা যাওয়ার আগে গুজরাটি ছেলেটি অসাধারণ সম্প্রীতির মহাকাব্য তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর পিছু পিছু ওইভাবে ফাঁদে পড়ে যান বছর চব্বিশের তাহির মহম্মদ। হেমিল তাঁকে ফোনে সাবধান করে দেন, কোনওভাবেই যুদ্ধে না যেতে। বারবার বলেন, তুমি দেরি না করে যে কোনওভাবে দেশে ফিরে যাও। তাহির ফিরে আসেন। বেঁচে যান।
সবার এমন ভাগ্য হয়নি।
পঞ্জাবের সাত তরুণের গল্প আরও ভয়ংকর। তাঁরা নববর্ষে ঘুরতে গিয়েছিলেন রাশিয়া। তারপর? গগনদীপ সিং নামে এক তরুণ ভিডিওতে বলেছেন, ‘ওখান থেকে একজন এজেন্ট আমাদের বেলারুশ নিয়ে যায়। আটকে রেখে তুলে দেওয়া হয় বেলারুশ পুলিশের কাছে। তারা আবার আমাদের দেয় রাশিয়ান অফিসারদের হাতে। যারা আমাদের কাগজপত্রে সই করায়। বাধ্য করে যুদ্ধে যেতে।’ কাশ্মীরের আজাদ ইউসুফ কুমার ৩ লক্ষ টাকা দিয়ে দুবাই গিয়েছিলেন। সেই একই পথে। ইউটিউব দেখে এজেন্টের ফাঁদে পা। বাড়িতে তিনি বলে গিয়েছিলেন, দুবাইয়ে গৃহপরিচারকের চাকরি পাচ্ছেন। ওখানে গিয়ে শোনেন তাঁকে রাশিয়ায় পাঠানো হচ্ছে।
এইসব ভারতীয়র গল্প শুনতে শুনতে মনে হবে, পরিযায়ী শ্রমিক হওয়ার তাগিদ আমাদের দেশে সব রাজ্যেই রয়েছে এখনও। এক-একজনের চাহিদা এক-একরকম। যাঁর বাড়িতে কিছু টাকা আছে, তিনি ঝাঁপান বাঁকা পথে বিদেশি এজেন্ট ধরে বিদেশে যেতে। যাঁদের টাকা নেই, তাঁরা ছুটবেন নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরু, কলকাতা, মুম্বই।
নরেন্দ্র মোদি সরকার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর দু’দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সামলাচ্ছে চমৎকার। ভারসাম্যের খেলায় একটু এদিক ওদিক হলেই পপাত চ, মমার চ। কিন্তু দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তো! একেবারে মতি নন্দীর চিরন্তন উপন্যাস স্টপারের চিরন্তনী সংলাপের মতো। কোচ পল্টু মুখার্জি মৃত্যুশয্যায় শুয়ে যেখানে নায়ক কমলকে বলছেন, ‘ব্যালান্স, কমল ব্যালান্স কখনও হারাসনি। আমি ব্যালান্স রাখতে পারিনি তাই কিছু রেখে যেতে পারছি না, একমাত্র তোকে ছাড়া। এই পৃথিবীটা ঘুরছে ব্যালান্সের ওপর। মানুষ হাঁটে ব্যালান্সে, দৌড়োয়, ড্রিবল করে, এমনকি মানুষের মনও রয়েছে ব্যালান্সের ওপর। চালচলনে, ব্যবহারে ও চিন্তাধারায় কখনও ব্যালান্স হারাসনি।’ ব্যালেন্সের এই মোক্ষম জায়গায় এসে ভারত কেন রুশ সেনার আগ্রাসী মনোভাব পুরোপুরি বন্ধ করতে ব্যর্থ, এটা প্রশ্ন।
মোদি-বন্ধু পুতিনকে প্রশ্নটা করা দরকার, এভাবে বেআইনিভাবে লোক নিয়ে সেনার হয়ে খাটানো যায়? রাশিয়া বেআইনি কাজ আটকাচ্ছে না কেন? বেআইনি এজেন্টরা এ কাজ করতেই পারে। টাকার লোভে লোকে কত কী করে! বড় রহস্য হল, রাশিয়া সরকার এটা মানছে কেন? সরকার ও স্মাগলার যোগাযোগ কেনই বা থাকছে? ওদেশে এত তরুণ সবাই যুদ্ধবিমুখ হয়ে গেলেন তা হলে?
ভারতীয়দের থেকেও খারাপ অবস্থা নেপালিদের। বড় মাইনের টোপ এবং নাগরিকত্বের লোভ দেখিয়ে অনেকদিন ধরে হাজার পনেরো নেপালি তরুণকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাশিয়ায়। তাঁদের প্রত্যেকের মর্মান্তিক কাহিনীর সঙ্গে গুজরাটের হেমিল, পঞ্জাবের গগনদীপ, কাশ্মীরের আজাদ ইউসুফদের গল্পের অনেক মিল। ভারত বড় দেশ। মোদি-পুতিন সম্পর্ক ভালো। সেখানেই হতভাগ্য ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে তীব্র সমস্যা। অনেক ছোট দেশ নেপালের কথা রাশিয়া শুনবে কেন? রাশিয়ার হয়ে লড়তে নেমে অনেক নেপালি ইউক্রেনের হাতে বন্দি। ইউক্রেনও নেপালের কথা শুনছে না।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল ওরফে প্রচণ্ড বৃহস্পতিবারই সে দেশের হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে যা বলেছেন, তাতে তাঁর অসহায় মনোভাব স্পষ্ট। এক বছরের বেশি হয়ে গিয়েছে নেপালিদের রাশিয়ায় হেনস্তার কথা। গোটা বিশ্ব জানে। তবু এখনও নাকি কথা চলছে! এতদিনে বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ে কথা শুরু হয়েছে। ভাবুন, আটকে থাকা নেপালিদের মা-বাবার মনের পরিস্থিতি এখন কী।
একটা কথা জেনে রাখা ভালো, রাশিয়াই কিন্তু প্রথম দেশ নয়, যারা বিদেশিদের যুদ্ধে নামাচ্ছে। এই নেপালের কথাই ধরুন। তাদের তরুণরা সরকারিভাবেই ভারত এবং ব্রিটেনে সেনাবাহিনীতে কাজ করতে পারে। এমন ত্রিপাক্ষিক চুক্তি রয়েছে দুটো দেশের। এবং সেটা ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। এমন কোনও চুক্তি রাশিয়ার সঙ্গে নেই।
অবশ্যই এমন ভাবার কারণ নেই, সব নেপালি যুদ্ধে নামার কথা না জেনে ও দেশে চলে গিয়েছেন। উপযুক্ত ভিসা, সরকারি কাগজ ছাড়া যে কোনও দেশে ঢোকা কঠিন। এই তরুণরা যে অনেকে যুদ্ধ করতেই গিয়েছিলেন চাকরি হিসেবে, এই যুক্তিও অনেকের। রাশিয়ান সেনার সঙ্গে নেপালিদের হাসিমুখে ভিডিও প্রমাণ দিচ্ছে, অনেকে শুধু টাকার জন্য চলে গিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। রীতিমতো পোজ দিয়ে ছবি তুলেছেন।
হাজার পনেরো তরুণ স্রেফ স্মাগলারদের হাত ধরে রাশিয়ায় চলে গেলেন কিছু না জেনে, এটা সত্যি বিশ্বাস করা শক্ত। রাশিয়া যে এতদিন ধরে ভারতীয়-নেপালি তরুণদের আটকে রাখল আন্তর্জাতিক চাপ অগ্রাহ্য করে, তার একটা কারণ থাকতে পারে। সব দেশেই সেনাদের নিয়ে মারাত্মক গোপনীয়তা। একজন সেখানে যোগ দিল আর হঠাৎ তাকে ছেড়ে দেওয়া হল, এমন হতে পারে না।
বিশিষ্ট সাংবাদিক শেখর গুপ্তের একটা ইন্টারভিউ শুনছিলাম। সেখানে তাঁর একটা পর্যবেক্ষণ অন্য গভীরতা যোগ করল এই সেনা বিতর্কে। শেখর বলছিলেন, ইদানীংকালে ভারতের গোর্খা রেজিমেন্টে যোগ দেওয়ার প্রবণতা কমে গিয়েছে নেপালিদের তরফে। ভারতের অগ্নিপথ নীতিতে নেপাল সরকারই সেনা পাঠাতে নারাজ। ২০০ বছরের গোর্খা রেজিমেন্টের ৪০ ব্যাটালিয়নকে পূর্ণ শক্তিতে রাখাই আজ বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতের তুলনায় রাশিয়ান সেনার মাইনে অনেক বেশি বলেই কি এই ব্যাপারটা সম্ভব হচ্ছে? ভাড়াটে সৈন্য বিতর্কে এই প্রশ্নটা নতুন এক দিকচিহ্ন যোগ করে দেয় কিন্তু।
আরও একটা দিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সেটাও বেশ তাৎপর্যময়। বলা হচ্ছে, পুরো বিতর্কে নেপাল এবং ভারতের সুর কিন্তু সম্পূর্ণ দু’রকম। নেপালই বরং আক্রমণাত্মক বেশি। নেপাল সরকারের ঘোষণা, ইউক্রেন ও রাশিয়ায় চাকরি করতে যাওয়া বন্ধ। ভারতই এখনও তেমন কিছু বলেনি। এর একটা কারণ হয়তো, ভারতীয়রা অজস্র পেশার সঙ্গে যুক্ত। প্রচুর তরুণকে এখনও দুটো যুদ্ধরত দেশের সংস্থার হয়ে কাজ করতে হয়। নেপালিদের সেই ব্যাপারটা নেই, ঝুঁকিও নেই।
প্রশ্ন হল, নেপালি প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডর কথা পুতিন মানতেই বা যাবেন কেন? যতই তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হোন, প্রচণ্ড কমিউনিস্ট পার্টি মাওবাদীর নেতা। পুতিনের অল রাশিয়া পিপলস ফ্রন্টের আদর্শগত তত্ত্বে পুতিনিজম রয়েছে, স্ট্যাটিজম রয়েছে, রাশিয়ান ন্যাশনালিজম, রাশিয়ান কনজারভেটিজম রয়েছে। কমিউনিজম নেই। স্তালিনের পর সবচেয়ে বেশি দিন রাশিয়ান প্রধান নেতা থাকা পুতিনের আমলে কমিউনিজম প্রায় বিলুপ্ত।
মস্কোর মালি সুখারভস্কি স্ট্রিটের তিন নম্বর বাড়িটার কথা মনে পড়ছে। এক সকালে সেখানে গিয়ে দেখি, লম্বা রডের বিশাল গেট ভিতর থেকে বন্ধ। বাইরে থেকে ডাকলেও কেউ আসছে না। চারদিক নিঃস্তব্ধ। ছোট লনে লেনিনের বিশাল ভাস্কর্য। পাশে তিনটে লাল পতাকা স্ট্যান্ডে লাগানো।
এটাই রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির প্রধান অফিস। পাশে কেএফসির আউটলেট জমজমাট। শুধু সিপিআরএফ মানে কমিউনিস্ট পার্টি অফ রাশিয়ান ফেডারেশনের সেন্ট্রাল কমিটির অফিসে লোক ছিল না। কমিউনিজম পুতিনের দেশে পরিত্যক্ত প্রায়। প্রচণ্ডের আর্তি এত সহজে শুনবেন কেন পুতিন?