প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: বৃহস্পতিবার দিল্লির ‘হায়দ্রাবাদ হাউস’এ নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুস্পকমল দহল ‘প্রচণ্ড’-এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, ‘আমরা দু’দেশের সম্পর্ককে হিমালয়ের উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমরা সীমান্ত সম্পর্কিত সমস্যা সহ সমস্ত সমস্যার সমাধান করব।’ কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে সেই পরিকল্পনায় অনেকটাই ফাঁক রয়ে গেল এদিনের বৈঠকে, যখন দু’দেশের রাষ্ট্রনায়কদের আলোচনায় ঠাঁই পেল না ভারত-নেপাল সম্পর্কে চিনের হস্তক্ষেপ, চিনা লাল ফৌজে নেপালি গোর্খাদের নিযুক্তি বা সম্প্রতি চিন থেকে নেপাল সরকারের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আমদানির মতো তথ্যও৷ এদিন বিদেশ মন্ত্রকের সাংবাদিক সম্মেলনে উত্থাপিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের উত্তরে বিদেশ সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা জানান, ‘উল্লিখিত বিষয়ে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে কোনওরকম আলোচনা হয়নি বলে কেন্দ্রীয় সূত্রে খবর।’ তবে নেপাল-ভারত দু’দেশের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের মধ্যে বহুচর্চিত শিলিগুড়ি (ভারত)-ঝাঁপা (নেপাল) পাইপলাইন স্থাপনেও মঞ্জুরি দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন বিদেশ সচিব।
বুধবারই চারদিনের সফরে ভারতে পা রেখেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী। গত ডিসেম্বরে নেপালের ক্ষমতায় এসেছে ‘প্রচণ্ড’ সরকার। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর, প্রথম বিদেশ সফরেই তিনি ভারতে এলেন। ভারতে আসার পর প্রথমেই নেপালের প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেন ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে। এদিন হায়দ্রাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করেন তিনি। নেপাল-ভারতের মিলিত উদ্যোগে একাধিক দ্বিপাক্ষিক পরিকল্পনায় ‘মউ’ সাক্ষরিত হয়। এদিন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকরের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হওয়ার কথা ‘প্রচণ্ড’র। সরকারি দায়িত্বের পাশাপাশি এই সফরে উজ্জয়িন এবং ইন্দোর ভ্রমণও করবেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ভারত সফরকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক মহলে শুরু হয়েছিল তৎপরতা। এর মধ্যে ভারত-নেপাল সম্পর্কে চিনের শি জিনপিং সরকারের অতিরিক্ত ‘নাক গলানো’ এবং ভারতকে বেকায়দায় ফেলতে নেপাল থেকে গোর্খা সেনা নিযুক্তির মতো অতি ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় নিয়েও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। যদিও বিদেশ মন্ত্রকের সূত্রে জানানো হয়েছে, এ নিয়ে প্রত্যক্ষরূপে কোনও আলোচনা হয়নি উভয় রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে।
প্রসঙ্গত, ভারতের হাত থেকে নেপালি গোর্খা সেনা ছিনিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে চিন। শুরু হয়েছে দলে দলে গোর্খা নিযুক্তিও। পিএলএ আর্মির এই অবস্থান নিয়ে বিস্ফোরক রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে, যা কেন্দ্র করে নড়েচড়ে বসেছে দিল্লি। চিন চাইছে নেপালের গোর্খারা এবার লালফৌজে শামিল হোক। প্রশ্ন উঠেছে ভারত কী তা আটকাতে পারবে? নয়তো ঘুরে যেতে পারে গোটা খেলা। প্রাচীন প্রবাদ বলে ‘মরতে ভয় পাই না এই কথা যারা বলে, তারা হয় মিথ্যে বলে, নয়তো তারা গোর্খা।’ চীচিন চাইছে নেপালের গোর্খা এবার যোগ দিক পিএলএ আর্মিতে। রিপোর্ট বলছে তেমনই ভাবনাচিন্তা চলছে বেজিংয়ের অন্দরে। কিন্তু তা সত্যি হলে ভারতের পক্ষে বিপদ৷ ভারতে গোর্খা রেজিমেন্টে আগে নেপালি গোর্খারা নিয়োগ হত৷
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। চিন ঘনিষ্ঠ নেপালের কমিউনিস্ট সরকার একবার চিনকে গোর্খাদের দিতে রাজি হয়ে গেলে, বেজিংকে কীভাবে কোন কৌশলে আটকাবে ভারত? এদিকে তথ্য বলছে গত ২ বছর ধরে নেপালি গোর্খা নিয়োগ হচ্ছে না গোর্খা রেজিমেন্টে, নিয়োগ করা হয়নি ভারতীয় গোর্খাদেরও। নেপাল সরকারের দাবি, নেপালি গোর্খাদের ইন্ডিয়ান আর্মি যেন অগ্নিপথ প্রকল্পের আওতায় না ফেলে। এদিকে ভারতীয় সেনাও জানিয়ে দিয়েছে তারা কোনও ভেদাভেদ করবে না এক্ষেত্রে। ফলত, চিনের প্রলোভনের দিকেই তারা হাত বাড়াবে, তাতে সন্দেহ কী! স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হয়েছিল, প্রচণ্ড-মোদির শীর্ষ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এই বিষয়ে অবশ্যই ইতিবাচক আলোচনা হবে। এমনকি, চিনের কাছ থেকে নেপাল সরকারের অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ কেনাকাটা নিয়েও ‘প্রচণ্ড’কে সতর্ক করা হবে ভারত সরকারের তরফে। কিন্তু এনিয়ে কোনও আলোচনা না হওয়ায় উক্ত বিষয়টি কার্যত রয়ে গেল ‘বিশ বাঁও জলে’৷
এই প্রেক্ষিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনানি ও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা কর্নেল রমেশ আলে জানিয়েছেন, ‘গোর্খা ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়ানোর চক্রান্ত করছে চিন। অথচ এনিয়ে কোনও আলোচনা হল না দুই রাষ্ট্রপ্রধানের এটাই দুর্ভাগ্যজনক।’ আলে এও বলেন, ‘আমরা ভারতীয় গোর্খা, দেশের জন্য দীর্ঘসময় ধরে আত্মোৎসর্গ করে আসছি। অথচ গোর্খাদের আবেগ অনুভূতিকে সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। সময় থাকতে এই নিয়ে দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকেই চিন্তাভাবনা করা উচিত।’ এই প্রসঙ্গে দার্জিলিং সাংসদ রাজু বিস্ট বলেন, ‘আমি ভারতীয় গোর্খাদের প্রতিনিধি। নেপালের গোর্খাদের নয়। তবে এই বিষয়ে কেন্দ্র সরকার যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তারা সময়োচিত পদক্ষেপ নেবে ঠিকই৷ সরকারের বিদেশনীতির ওপর আস্থা রাখা উচিৎ।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য পুস্পকমল দহল ‘প্রচণ্ড’-এর সঙ্গে তাঁর রসায়নকে ‘সুপারহিট’ বলে দাবি করেছেন। সেই ‘সুপারহিট’ ফর্মুলার অধীনে এদিন দিল্লি থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ‘রূপাইডিহা ল্যান্ড পোর্ট’-এর উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এই স্থলবন্দরটি তৈরি করেছে ভারতের ল্যান্ড পোর্ট অথরিটি। রূপাইডিহা স্থলবন্দরটি তৈরি করা হয়েছে ১১৫ একর জমির ওপর, খরচ হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। ভারত-নেপাল আন্তর্জাতিক সীমান্তের দুই পাশেই বেশ কয়েকটি চেক পোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে পণ্যবাহী ট্রাকগুলির আন্তঃসীমান্ত পরিবহণ আরও সহজতর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি শক্তি, যোগাযোগ, বাণিজ্যের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ভারত ও নেপাল দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। অর্থনীতি, সীমান্ত সমস্যা এবং পরিকাঠামোর উন্নয়নের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে। বাণিজ্য ও জ্বালানি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে দুই পক্ষের মধ্যে সাতটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী মোদি জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে দুই দেশের অংশীদারিত্বকে ‘সুপারহিট’ করার জন্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। রূপাইডিহা স্থলবন্দর উদ্বোধনের পাশাপাশি বিহারের বাথনাহা থেকে নেপাল কাস্টম ইয়ার্ড পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেনের যাত্রার সূচনাও করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এরই সঙ্গে নেপালের পূর্বপ্রস্তাবিত উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে নেপালের ঝাঁপা পর্যন্ত ২৮৮ কোটি টাকার ৫২ কিলোমিটার বিস্তৃত পাইপলাইন স্থাপনেও কাঠমান্ডুকে মৌখিক সম্মতি দেওয়া হয়েছে দিল্লির তরফে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলির সঙ্গে নেপাল-ভারত-বাংলাদেশ ত্রিপাক্ষিক চুক্তির নিরিখে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থাপনেরও কথা ভাবনাচিন্তা করছে দিল্লি, জানানো হয়েছে বিদেশ মন্ত্রকের সূত্রে।