- মৈনাক ভট্টাচার্য
পথকুকুর পছন্দ অপছন্দ নিয়ে আমজনতা বরাবরই দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে শহরের মানুষ অতিষ্ঠ কুকুরের যত্রতত্র মলত্যাগ এবং পথচারীকে চোরাগোপ্তা আক্রমণে। অন্যদিকে আবার আবেগমথিতও সাংস্কৃতিক পরিসরের সারমেয় নান্দনিকতার সোমনাথ হোরের ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের মতো নানা শিল্পকলায়। সবচেয়ে টাটকা প্রমাণ সম্প্রতি শিলিগুড়িতে খবরের শিরোনামে উঠে আসা পুর প্রশাসনের পথকুকুর ধরা এবং এক সারমেয় ভক্তের তাকে তৎক্ষণাৎ জোর করে মুক্ত করার খবর।
পথকুকুর নিঃসন্দেহে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের অঙ্গ। এদের সমস্যা হলে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যও নষ্ট হবে। মহাভারতে একলব্যের কুকুরের মুখে বাণ মারা হোক আর পঞ্চপাণ্ডবের মহাপ্রস্থান পর্বই হোক, সেই আদি যুগ থেকে আমাদের যাপনে অনিবার্য হয়ে আছে পথকুকুর। এমনকি গ্রিক মহাকাব্য ওডিসি ঘাঁটলেও পাওয়া যায় ওডিসিয়ার প্রিয় কুকুর আর্গোসকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যে পৃথিবীর আনুমানিক ৯০ কোটি কুকুরের মধ্যে ৭৫-৮৫ শতাংশই পথকুকুর। আজও শালীনতার নেতিবাচক পাঠের উদাহরণে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সম্ভবত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে/কামড় দিয়েছে পায়/তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে/ মানুষের শোভা পায়?’- সে না হয় শোভা পায় না বোঝা গেল। কিন্তু এর দায় কার?
১৯৯৩ সালের পশ্চিমবঙ্গ পুর আইনে পরিষ্কার বলা আছে, ‘একটি নির্দিষ্ট পুরসভার ভৌগোলিক এলাকাতে সমস্ত পথপশু তাদের সম্পত্তি। এছাড়াও ভারত সরকারের পশু জন্মনিয়ন্ত্রণ (কুকুর) বিধি, দুই হাজার এক অনুসারে রাস্তার কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও স্থানীয় পুর কর্তৃপক্ষ দায়বদ্ধ। রাস্তার কুকুরকে জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকা সহ সবরকম নাগরিক নিরাপত্তার দায়ও পুর কর্তৃপক্ষের।
উত্তরবঙ্গের মালদা থেকে কোচবিহার প্রশাসন শুধু নিষ্ক্রিয়ই নয়, কুকুরশুমারির প্রসঙ্গ তুললে অনেক সময় আকাশ থেকেও পড়েন। পথকুকুর টিকাকরণ বা পরিবেশ দূষণ রোধের কোনও পরিকাঠামোই এদের নেই। ন্যূনতম গুরুত্ব না থাকায় উত্তরবঙ্গের কোনও শহরের পুর বাজেটের কোথাও বিন্দুমাত্র অর্থ বরাদ্দের প্রশ্নই ওঠে না। অথচ প্রাকৃতিক নিয়মেই কুকুরের জন্মহার বৃদ্ধি শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দেখা দেয়।
প্রতিকারহীন মানুষকে বাড়ির প্রবেশদ্বার কিংবা চৌহদ্দিতে পথকুকুরের মলত্যাগ রোধে নিরুপায় হয়ে বহু ক্ষেত্রে অদ্ভুত এক নীল জলের বোতল সীমানায় ঝুলিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। যার কোনও বিজ্ঞানভিত্তি নেই, আছে একজনের দেখাদেখি কলোনিয়াল ভাইরাস আক্রান্তের চিকিৎসার মতো নানা বাড়ির প্রবেশদ্বারে এই নীলজল বোতল থেরাপি।
ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে গিয়ে জেনেছি কুকুর পিছু নির্বীজকরণে কমপক্ষে বাৎসরিক হিসেব হাজার থেকে বারোশো টাকা প্রয়োজন। যা একটা মোটা অঙ্ক, আর্থিক দৈন্যে ভুগতে থাকা প্রায় সব পুর প্রশাসনের সাধ্যের বাইরে। সব শহরই তাই পথকুকুর নিয়ে পরিকল্পনার খামতিতে জেরবার।
শুধু প্রশাসনকে দায়বদ্ধ করলে হয় না। সব পশুপ্রেমী সংস্থারও এই বিষয়ে সচেতনতার প্রয়োজন। শুধু একপ্রস্থ খাবার বা রুগ্ন কুকুরের ন্যূনতম চিকিৎসা দিয়ে নিজেদের সারমেয়প্রেমী প্রমাণ করলে হবে না। পরিবেশ ভারসাম্যের স্বার্থ এবং জনস্বাস্থ্য যে এক বৃন্তে দুটি কুসুম এই বোধোদয়টাই আমাদের সবচেয়ে জরুরি।
(লেখক শিলিগুড়ির ভাস্কর এবং সাহিত্যিক)