- মৈনাক ভট্টাচার্য
প্রচলিত ধারণায় ‘হাতে বাড়তি দু’পয়সা এলেই বাঙালি হয় বেড়াতে বেরোয়, নয়তো বাড়ি বানায়’। বাঙালির এই গৃহপ্রীতি সর্বজনীন, তাই বোধহয় বাঙালি না হয়েও ভারতীয় বংশোদ্ভূত নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক ভিএস নাইপলকে দিয়ে বাঙালি ঠিক এক ফাঁকে লিখিয়ে নিয়েছে তাঁর মোহন বিশ্বাসের বাড়ির গল্প ‘এ হাউস অফ মিস্টার বিশ্বাস’।
গল্পটা ষাটের দশকের। আজও কিন্তু বাঙালি মননে ভালো ‘বাসা’র টান অমলিন। সময়ের সঙ্গে মলিন শুধু যৌথ পরিবার সংস্কৃতি। ট্যাঁকের টান আর স্বপ্নের ‘ভালো’ বাসার ভালোবাসায় মধ্যবিত্ত বাঙালি এখন ফ্ল্যাটের আবেশে মজেছে। আধুনিক ফ্ল্যাটের মোহে চাপা পড়ে যাচ্ছে পারিবারিক স্মৃতি।
পারিবারিক সূত্রে হয়তো এক টুকরো জমি কিংবা পুরোনো বাড়িঘর, অথচ হাতে নুতন করে হাল ফ্যাশনের বাড়ি করার পয়সা নেই। সঙ্গে বোঝার উপর শাকের আঁটি শরিকি মালিকানার মতো নানা সমস্যা। ভেবে যখন কূলকিনারা পাচ্ছেন না, হঠাৎ দেখবেন আপনাকে একটি পয়সাও গ্যাঁটের খরচ করতে হচ্ছে না, অথচ সব সমস্যার সমাধান করে আপনার জন্য লোভনীয় এক স্বপ্নপুরীর ছবি এঁকে মুশকিল আসানের মতো সামনে দাঁড়িয়ে প্রোমোটারের দল। মনে হবে ঠিক যেন সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’। ‘ছিল একটা ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁকপেঁকে হাঁস।’
এখন কোচবিহার থেকে মালদা, সর্বত্র ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির হিসেবনিকেশ চলছেই। হিসেবনিকেশ ঠিকঠাক বুঝে নিতে না পারলে কিন্তু স্বপ্নের ফ্ল্যাটবাড়ি নিয়ে দেখবেন, সমস্ত জীবন নাকানিচোবানি খেতে হচ্ছে। প্রথমেই আসবে আপনার ভাগের পরিমাপ। চুক্তির হাজার স্কোয়ার ফিট হয়তো এসে দাঁড়াবে ছয়শো কিংবা তারও কিছু কম। সুপার বিল্ডআপ আর কার্পেট এরিয়ার ধারণা নেই অনেকেরই। না থাকায় আইনের মারপ্যাঁচে ততক্ষণ আপনি আটকে গিয়েছেন। কেননা প্রোমোটারি হিসেবে সুপার বিল্ডআপ বলতে আপনার ভাগে সিঁড়ি কমন প্যাসেজ সবটাই। সাধারণত ফ্ল্যাটের দাম কিন্তু ধরা হয়ে থাকে সুপার বিল্ডআপ এরিয়ার ওপরেই।
তবে ভালোবাসার ফ্ল্যাটবাড়ির এই সাতকাহন ছাপোষা মধ্যবিত্তকেও এখন শিখে নিতে হয়েছে। নাহলে যে এগ্রিমেন্টে সইসাবুদের পর তাঁদের হাতে হিসেবের বাড়ির আধখানার কিছু বেশিরভাগ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। হিসেবটা তখন অনেকটা যাকে বলে চিংড়ির খোসা ছাড়ালে যেমন অর্ধেক হয়ে যায় মাছের ওজন, ঠিক তেমনই।
একজন মানুষও যেন হিসেবের জালে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন না হয় তার জন্য প্রয়োজন আরও সামাজিক সচেতনতা, ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের দায়বদ্ধতা। কেননা বহু মানুষ সমস্ত জীবন সৎসঞ্চয় বাঁচিয়ে একটা ভালোবাসার ভালো বাসাকে বুকে আগলে বেঁচে থাকে। স্বপ্ন দেখে তাঁর ভালোবাসার বাসাবাড়ি থেকে সকালে চা খেতে খেতে পুবের আকাশে সূর্যোদয় দেখে বাকি কয়টা দিন নির্ঝঞ্ঝাট কাটিয়ে দিতে পারবে।
(লেখক শিলিগুড়ির ভাস্কর এবং বাস্তুকার)