- বিমল দেবনাথ
পার্ব্বতী বরুয়ার (উনি নাম ও পদবীর এই বানান লেখেন) পদ্মশ্রী পাওয়ার খবরটা ২৫ জানুয়ারি রাতে জানার পর ছটফট করছিলাম ফোন করার জন্য। কিন্তু করিনি। উনি বলতেন, ‘হাতি থানে গেলে মুইও শিথানে যাও’।
ওঁর সঙ্গে আমার সাড়ে তিন দশকের সম্পর্ক। ওঁর কথার সঙ্গে কাজের হুবহু মিল। বিরক্ত করিনি। ২৬ জানুয়ারি সকালে ফোন করি। হ্যালো… বলে কিছু বলার আগেই অপর প্রান্ত থেকে উচ্ছল হাসি। বোঝার উপায় নেই তিনি সাত দশক উত্তীর্ণ। সহজসরল গ্রাম্য বালিকা যেন খেলতে খেলতে হাসছে। কোনও অলংকার নেই, কোনও অহংকার নেই, কোনও ক্ষোভ নেই। শুধু তরঙ্গাভিঘাত হচ্ছিল প্রাণের … হাসির রেশ টেনে বলেন, ‘… ভাই রাখলাম, আর একটা ফোন আসছে বার বার…’।
কাউকে নিরাশ করতে চান না বিশ্বের একমাত্র মহিলা ফান্দি মাহুত- “দ্য ক্যুইন অফ এলিফ্যান্ট”।
আশির দশকের মাঝামাঝি আমি প্রথম দেখি পার্ব্বতী বরুয়াকে। বাবার সঙ্গে হাতি নিয়ে ক্যাম্প করছিলেন বামনপুকরিতে। ওঁর বাবার ডাকনাম লালজি। লালজির মতো সুদর্শন পুরুষ আমি এখনও দেখিনি। দিদির কাছে শোনা, ওঁর বাবার এমন দুধ-আলতা রং ছিল যে ডাকনাম হয়ে যায় লাল। দিদির রূপ? লক্ষ্মী-সরস্বতীর মিশ্রণ। ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, নেপালি, সাদরি ইত্যাদি কত ভাষায় যে কথা বলতে পারেন! হাতির শুঁড়ে পা দিয়ে দু-কান ধরে লাফ দিয়ে হাতির পিঠে উঠে কী সব কথা বলেন। নয় ফুট উঁচু হাতি যন্ত্রের মতো কাজ করে।
তখন কি আর মাইল, চেই, ধাত ইত্যাদি জানতাম? পরে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলে বলেছিলেন, জানো তো সবাই বলে আমি নাকি আমার বাবার মতো। বললাম- আপনি বাবার থেকেও সুন্দর। তিনি হাসতে হাসতে গেয়ে ওঠেন- আই ছাড়িলুং বাই ছাড়িলুং, ছাড়িলুং সোনার পুরী। বিয়াও করিয়া ছাড়িয়া আসিলং অল্প বয়সের নারী। … । ওঁর মুখ দেখে মনে হল নারী-পুরুষ সমার্থক। সংসার না করে হাতির সঙ্গে যাপন করছেন দিব্যি।
জিজ্ঞাসা করলাম- আপনার কত সুন্দর সুর, কী সুন্দর নাচতে পারেন। দিদি প্রতিমা বরুয়া বিখ্যাত সংগীতশিল্পী। কেন এই কষ্টের জীবন বেছে নিলেন। হাসতে হাসতে বললেন- বাড়িতে অনেক পুতুল আসত। রাজার বাড়ি বলে কথা! আমার প্রাণহীন পুতুল ভালো লাগত না। বাবার সঙ্গে চলে যেতাম হাতিধুরায়। বাচ্চা হাতির সঙ্গে খেলতাম…
সে খেলা এখনও চলছে। হাতির ডাক আসলে ছুটে যাচ্ছেন দেশবিদেশ। হাতি ও বন সংরক্ষণ নিয়ে কথা বলছেন। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন হাতি ও মাহুতদের। জংলি হাতি ও ষাট শতাংশ জংলি স্বভাবের কুনকি হাতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত খেলছেন জীবন নিয়ে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম- দিদি পদ্মশ্রী পেয়ে কেমন লাগছে। সহজ উত্তর- ‘এতদিন যেমন লাগত ঠিক তেমন। তবে ভালো লাগছে আমার মাহুতভাইদের জন্য, প্রকৃতি নিয়ে কাজ করে তাদের জন্য। এই পুরস্কার শুধু আমার নয় তাঁদের সবার।’
অভিভাবক না হলে কি এইভাবে আনন্দ ভাগ করা যায়?
(লেখক প্রাক্তন বনকর্তা)