Monday, April 29, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়বিবেকানন্দ যখন বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা

বিবেকানন্দ যখন বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা

  • সিদ্ধার্থ মাইতি

১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর। সাবেক রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দায় ইউরোপীয় পোশাকে তিন বাঙালি যুবককে দেখা গিয়েছিল। তাঁরা তৎকালীন ইনস্পেকটর জেনারেল অফ প্রিজন অত্যাচারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল এনএস সিম্পসনকে গুলি চালিয়ে হত্যা করলেন। তারপর ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় তাঁদের! আহত হয়েছিলেন তিন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার!

বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত-এই তিন অসম সাহসী যুবককে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন হেমচন্দ্র ঘোষ। এই মহান বিপ্লবী আকাশবাণী কলকাতায় চাঞ্চল্যকর এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর তা শোনা যায়। সেখানে বিনয়-বাদলের গুরু বলেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি দেখা করলে বিবেকানন্দ বলেন, ‘ব্রিটিশদের কি অধিকার আছে এ দেশ শাসনের? আমাদের মাতৃভূমি এই দেশ থেকে খেদাও। সেটাই এখন ধর্ম!’ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

হেমচন্দ্রের কাছে জানা যায়, আরও একটি তথ্য। তৎকালীন গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থার প্রধান নেতাদের কাছে একদিকে যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ পাঠ্য ছিল, আবার বিবেকানন্দের রচনাও তাঁদের অনুপ্রাণিত করত বলে জানা যায়! হেমচন্দ্র এও বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রথম প্রয়োজন ছিল স্বাধীনতা। একটি যোগ্য নেতৃত্ব, একটি সংঘবদ্ধ দল তা পারত। রাজনৈতিক স্বাধীনতাই একমাত্র স্বাধীনতা!’

রাজস্থানের খেত্রির মহারাজা অজিত সিংয়ের সান্নিধ্যে আসার পরে তাঁর পরামর্শেই স্বামী সচ্চিদানন্দ থেকে হয়ে উঠলেন স্বামী বিবেকানন্দ! রাজস্থানের ভয়ংকর তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে অজিত সিং যে পাগড়ি পরার কথা বললেন, পরে তাই-ই হয়ে উঠল অনিবার্য। তাঁর পরবর্তী জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ আবার ওই গেরুয়া আলখাল্লা পরে অজিত সিংয়ের আগ্রহে স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালে ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোর ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদান করলেন।

সে কথা আমরা জানলেও শঙ্করীপ্রসাদ বসুর গবেষণা এবং ভূপেন দত্তের জবানিতে বিবেকানন্দ সম্পর্কে যে তথ্য বিস্মিত করে, তা হল, তিনি সশস্ত্র আন্দোলনের আয়োজনে মগ্ন ছিলেন। এমনকি দুই বিদেশিনীর অর্থসাহায্যে জাহাজ ভর্তি অস্ত্র আমদানি করতে চেয়েছিলেন এবং সে জাহাজ চন্দননগরে প্রবেশের আগেই আটকে যায়! তিনি সারা ভারতের প্রাদেশিক রাজন্যবর্গের সাক্ষাৎকারে বুঝেছিলেন এঁরা ব্রিটিশ শাসনে করদ রাজা হিসেবে তোফা আছেন! শাসক হওয়ার হ্যাপা আবার কেন!

মহারাজা অজিত সিংয়ের কথায় হিন্দু ধর্মের সারাৎসার আন্তর্জাতিক ধর্ম সম্মেলনে বক্তৃতায় যে উদ্দীপনার সঞ্চার হল, তাতে স্বামীজি নতুনভাবে উপলব্ধি করলেন, ভারতের অন্তরাত্মার বুকে সংস্কার ও জীবন দর্শন সুপ্রোথিত এবং উদার হিন্দু ধর্মই পারে এ দেশকে এক অখণ্ড চেতনার শরিক করে তুলতে! ১৮৯৭ সালের ১ মে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। আর ১৮৯৭-র ১৫ মে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের কাছে কেদারমাটি মহুলা ও ভাবতা এলাকায় চূড়ান্ত দুর্ভিক্ষের মাঝে বিবেকানন্দের গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দ নিজে ১৮ জন দুঃস্থকে চাল বিতরণ করলেন। শুরু হয়ে গেল রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম সেবাকার্য! বিবেকানন্দ আগেই চিঠি মারফত এর আয়োজনের খবর পেয়ে দেড়শো টাকা পাঠালেন, লিখলেন ‘সাবাস বাহাদুর! ওয়া গুরুজি কী ফতে! কাজ করে যাও, যত টাকা লাগে আমি দেব!’

হ্যাঁ, এই আশ্বাসেই অখণ্ডানন্দ সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশন, প্রথম শাখা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন! এই আশ্রমে একবার দুটি ইসলাম ধর্মাবলম্বী শিশুর আশ্রয় জোটে। তাদেরকে পাঠিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের কালেক্টর। জনা ছয়েক ডাকাতকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করলে তাদের সঙ্গী ছিল ওই দুটি শিশু! বিবেকানন্দের অনুমতি নিয়েই চালু হল ‘অনাথ আশ্রম’!  শিশুদের বয়স বাড়লে অখণ্ডানন্দ তাদের ধর্মীয় রীতি ও আচার পালনের বিষয়ে উপদেশ চাইলেন তাঁর গুরুভাই বিবেকানন্দের কাছে! স্বামীজি যথাধর্ম রীতি পালন করতে বললেন এবং নিয়ম মোতাবেক নমাজ পাঠের নির্দিষ্ট জায়গার ব্যবস্থায় যেন ত্রুটি না হয় সেদিকেও নজর রাখতে বললেন!

সারগাছির কাছেই বহরমপুর। সেখানকার ছানাবড়া বিখ্যাত। অখণ্ডানন্দ গুরুভাইয়ের খাদ্যরসিক রূপ জানতেন। কয়েক মন ওজনের এক-একটা ছানাবড়া নৌকোয় পৌঁছে যেত রসনাতৃপ্তির জন্য! ভারতের সাধক নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করতে বসেন, মনে হয় এক ও একমাত্র বিবেকানন্দকেই পাবেন, যিনি ইউরোপ ভ্রমণকালে আইসক্রিম না পেলে জমাট বরফকে গুঁড়ো করে তার মধ্যে চিনি মিশিয়ে দিতেন। আয়েশ করে খেতে খেতে তারই তারিফ করতেন। বাছবিচারহীন খাদ্যাভ্যাস তাঁর।

কয়েক কিলো মাংসের পরে জামবাটি ভর্তি ক্ষীর সাঁটিয়ে দিয়ে গুরুভাই শিষ্যদের হতবাক করে দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার! আবার ওই যে প্রিয় গুরুভাইকে –‘গ্যাঞ্জেস’ বলে ডাকের মেজাজ, অখণ্ডানন্দের প্রাক সন্ন্যাস নাম ছিল যে গঙ্গাধর, তাঁকে যে স্ফূর্তিতে ‘সাবাস’ বলেন, সেই মেজাজের স্বাদ পাওয়া যায় তাঁর কলমে।

১৮৯৮ থেকে ১৯০২ পর্যন্ত উদ্বোধন পত্রিকায় লেখাগুলো খেয়াল করা যাক। তখন সাহিত্য এবং ধর্ম সংক্রান্ত লেখালেখির পত্রিকা ছিল উদ্বোধন। সেখানে প্রথমেই লিখেছেন, ‘ভট্টাচার্যগিরি করলে চলবে না, মানুষকে আকর্ষণ করতে হবে তাদের ভাষায়।’ তিনি প্যারিচাঁদ মিত্রের অনুসারী হয়তো! বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের গদ্য চলন তিনি সচেতনভাবে বর্জন করছেন! অতি তৎসম শব্দে প্রকাশিত বঙ্কিম বা শান্তিপুরি বাংলার সংস্কৃত সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের ললিত ভাষাচর্চার বাইরে বিবেকানন্দ ওজস্বী সুতীব্র পৌরুষে উদ্দীপিত ভাষায় প্রায় একক। অথচ তিনিই রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীতে মগ্ন। তাঁর ভাবনার উত্তরাধিকারী হয়তো কাজী নজরুল ইসলাম!

রবীন্দ্রনাথই স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে লিখেছেন, বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে যেসব দুঃসাহসিক অধ্যবসায়ের পরিচয় পাই তার মূলে আছে বিবেকানন্দের সেই বাণী, যা মানুষের আত্মাকে ডেকেছে, আঙুলকে নয়! স্বদেশি আন্দোলন চলাকালীন জোড়াসাঁকোর বাড়ির বারান্দা থেকে তিনি দেখেছেন স্বদেশির নামে চড়কা কাটার নিদান দিয়ে আন্দোলনকারীরা কীভাবে দরিদ্র মানুষের কাছে সহজলভ্য বিদেশি কাপড় পুড়িয়ে দিচ্ছে। সমস্যায় পড়ছেন গরিবরাই।

এহেন বিবেকানন্দের জীবন নিয়ে কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি অভিনেতা চন্দন সেন একটি নাটক করেন। সেই ‘যুগনায়ক’ নাটকের শুরুতে কয়েকটি তরুণ-তরুণী সূত্রধরের মতো বলেছিল, ‘আমরা এমন একজন মানুষের গল্প বলব, যে সময়ের যন্ত্রণায় বিদীর্ণ। বিলে!’

বিলে সিমলে পাড়ার কাপ্তেন। অসম্ভব জেদি আর মেজাজি অথচ অত্যন্ত বন্ধুবৎসল! পাড়ার ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন, বক্সিংয়ে মেডেল পায়, কুস্তির আখড়ায় প্রিয় শিষ্য। তরোয়াল আর লাঠিখেলায় ওস্তাদ! যেমন রাঁধে তেমনই খাইয়ে! নস্যিও চলে! আমরা জেনেছি আবার উকিল বাবার বৈঠকখানায় সম্প্রদায় ভেদে আলাদা আলাদা হুঁকোয় তামাক টেনে পরীক্ষা করে জাত রইল কি না! একবার পড়েই সে বুঝে নেয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দর্শনের দুরূহ সব বই। গণিত থেকে সংস্কৃত-ইংরেজি-বাংলা সাহিত্য নরেন বা বিলে সবাইকে চমকে দিতেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত যে বিপুল কর্মকাণ্ডে আসমুদ্রহিমাচলে কর্মযোগের জোয়ার এনেছিলেন, সেটা নতুন করে সাধনার সময় হয়তো আজ!

তাঁর বাণী ‘Education is the manifestation of the perfection already in man. Religion is the manifestation of the Divinity already in man. Therefore the only duty of the teacher in both cases is to remove all obstructions from the way’…

আদর্শ না ঐতিহ্য তিনি? না, আসলে দুটোই তিনি। স্বামী বিবেকানন্দ আজকের এই ভারতে নতুন করে প্রতিদিন চর্চায়। তাঁর দিশা মিলে যেতেই পারে।

(লেখক আকাশবাণীর প্রা‌ক্তন অফিসার, প্রবন্ধকার)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

ISL | মধুর প্রতিশোধ যুবভারতীতে, ২-০ গোলে ওডিশাকে হারিয়ে আইএসএল ফাইনালে মোহনবাগান

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: টানটান উত্তেজনার ম্যাচে ওডিশাকে ২-০ গোলে হারিয়ে আইএসএলের ফাইনালে পৌঁছে গেল মোহনবাগান। ইনজুরি টাইমে জয়সূচক গোলটি করেন আব্দুল সাহাল। মোহনবাগানের...

AAP | আপের হয়ে দিল্লিতে প্রচারে অরবিন্দ পত্নী, ভিড় জমালেন মহিলারা

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ‘যার স্বামী জেলে আছে, তাঁকে তো বাইরে আসতেই হবে’ কথাগুলি ৫২ বছরের কমলেশ জৈনের। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের স্ত্রী সুনীতা...

Titanic | নিলাম হল টাইটানিকের ধনকুবের যাত্রীর সোনার পকেটঘড়ির, দাম উঠল  ১০ কোটি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ডুবে গেলেও আজও জীবিত আছে মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায়। ১১০ বছরেরও বেশি জলের তলায় রয়েছে বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক। টাইটানিককে নিয়ে রয়েছে...

Siliguri | মাটিগাড়ায় হামলা, আক্রান্ত বিজেপির বুথ সভাপতি সহ ৬

0
শিলিগুড়ি: মাটিগাড়ার কলাইবক্তরি এলাকায় রবিবার সন্ধ্যায় একদল দুষ্কৃতী বিজেপির স্থানীয় বুথ সভাপতি নন্দকিশোর ঠাকুর সহ কয়েকজন বিজেপি কর্মকর্তার বাড়িতে হামলা চালায়। যার জেরে দু’জন...

Migrant Worker | রমরমিয়ে চলা মাছের ব্যবসাই হল কাল, কেরালায় খুন হলেন মানিকচকের পরিযায়ী...

0
মানিকচকঃ কেরালায় গিয়ে মাছের ব্যবসায় ব্যাপক পসার জমিয়েছিলেন মালদার মানিকচক নাজিরপুরের একটি ছোট্ট গ্রাম লস্করপুরের যুবক প্রকাশ। স্বল্প লাভে মাছ বিক্রি করায় অল্প দিনের...

Most Popular