- বিশ্বনাথ বসু
যদিও বিশ্বায়নের পরের থেকেই বাঙালি জাতি তার স্বকীয়তা অনেকাংশেই ঝেরেঝুরে ফেলেছে। অন্যের আদবকায়দা খানাপিনা বলন চলনের প্রতি টান তাদের চিরকালের। পাড়ায় পঞ্চাশ দশকের অধিক কাল ধরে বসবাসকারী রিকশা কাকার সঙ্গে অদ্ভুত হিন্দিতে কথা বলে তার নিজের ভাষা ভুলিয়ে ছেড়েছেন বহু বঙ্গসন্তান। আমি হলফ করে বলতে পারি, চাইনিজ, মোগলাই ও দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের দোকান, এই বাংলার শহর, মফসসলজুড়ে যেভাবে গজিয়ে উঠেছে তা তাদের নিজভূমে আছে কি না সন্দেহ। পোশাকের দিক থেকেও বাঙালি জাতি অনুষ্ঠানের উদযাপন ছাড়া সকল সময় সাগরপারে পড়ে আছে। শুধু কিছু বিষয়ে তাদের বাঙালিত্বের নাড়ি বহু গভীরে শক্তপোক্তভাবে রয়েছে, হাজার নড়নচড়নেও তাকে নড়ানো যাবে না। বছরের প্রথমে নিয়ম করে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ফেবুতে ছবি দেওয়া, দুপুরে ভাত, ডাল, চিংড়ি-এঁচোড় খেতে রেস্টুরেন্টের ওয়েটিং লিস্টিতে নাম লেখানো। দুর্গাপুজোর কেনাকাটার হিড়িক দূরের মানুষকে কাছে টেনে নেয়, বাড়ির পরিচারিকার মেয়েটিও নতুন বস্ত্র পায়। ভাইফোঁটার ফোঁটার অনেকটাই ট্যাব, ল্যাপটপের আওতায়। বারোমাসের তেরোপার্বণ কোথাও জ্বলজ্বলে আবার কোথাও টিমটিমে, তবে সব ছাপিয়ে বাঙালি জীবনে নেমে এসেছে থার্টিফার্স্টের রাত থেকে হ্যাপি নিউ ইয়ারের সকাল, যা চলতেই থাকে। ভিন্নদেশি প্রভাব প্রভাবশালী হয়ে বঙ্গজীবনে ছায়াপাত করলেও, একটি বিশ্বাসের ওপর ছায়ার বিন্দুমাত্র ছায়াপাত পড়েনি। আর তা হল উত্তম… সারাদেশে ও দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের নাম উত্তমকুমার। তাই হাজার ঘোমটার আবডালে থাকা এই বঙ্গের বুড়ি থেকে বালিকা ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছেছিল। কী তার চাহনি, কী তার হাঁটা, কী তার মাতৃভক্তি, কী তার প্রেমিক শ্রেষ্ঠ আদর মাখা সংলাপ আবার খলনায়ক হিসাবে বাঘবন্দি খেলায় তিনি একাই একশো। তবে আমার মতো বাংলা সিনেমার লিলিপুট কমেডিয়ানের কাছে তার রসবোধ কালজয়ী।
ছোটবেলায় যখন বাবার হাত ধরে আস্তে আস্তে বাংলা সিনেমার গুণগ্রাহী হয়ে উঠছি, সেইসময় আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল বাংলা অভিনেতাদের রসবোধ। আর সেখানে উত্তম-সুচিত্রা, উত্তম-সুপ্রিয়া, উত্তম-সাবিত্রী, উত্তম-মাধবীর পাশে রয়েছেন তুলসী চক্কোত্তি, ভানু বাঁড়ুজ্জে, জহর রায়, হরিধন, নৃপতি, নবদ্বীপ, মলিনা দেবী রাজলক্ষ্মী দেবী আরও বাঘা বাঘারা। এদিক থেকে ওদিক হয়েছে কী একেবারে হাতে হ্যারিকেন তাতে আবার তেল নেই অবস্থা হয়ে যাবে। তবে না, গুরু আমার সে জিনিস নয় কারণ বাঙালি আর যাই পারুক না পারুক শিল্পীর শিল্পত্ব বিচারে একেবারে চোখে ঠুলি ও ন্যায়দণ্ড হাতে। সেই বাঙালির রসবোধের চাওয়াপাওয়ার হিসাব সর্বকালের সেরা নায়ক মিটিয়েছেন যত্ন সহকারে।
চাওয়া পাওয়ায় যখন ধনী ঘরের দুলালি সুচিত্রা সেন, রাতের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠে বলে ওঠেন শুনছেন?
ঘুমন্ত উত্তমের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না তা জায়গা পাবার নামান্তর।
বলে ওঠেন শুনলেও কি সরার জায়গা আছে। নায়িকার আসন্ন কষ্টের রাতকে ছাপিয়ে দর্শকের মুখ ফিক করে ওঠে।
শুন বরনারী সিনেমায় পকেটমারি হয়ে যাওয়া সুপ্রিয়ার সঙ্গে জুড়ে যান নায়ক, সেখানে ভাড়া মিটিয়ে দিতে গেলে আশপাশের সকলের টিপ্পনীর জবাব একটু অন্যধারায় বইলেও, সহজ সাধারণ বলা কথাগুলো দর্শকমনকে খিলখিলিয়ে তোলে।
অগ্নীশ্বর সিনেমায় যখন প্রেসক্রাইব করা ডাক্তারের ডোজ পূর্বের ডাক্তার কমিয়ে দেন, তখন অগ্নীশ্বররূপী মহানায়ক বলে ওঠেন, আপনাকে যদি ঠাসঠাস করে চারটি চড় মারার দরকার হয়, সেখানে কি দুটো মারলে চলবে।
নায়িকা সংবাদ সিনেমায় নৃপতি চট্টোপাধ্যায় লুকিয়ে পাঁচিল টপকে অঞ্জনা ভৌমিককে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই নায়ক উত্তমকুমার তাঁকে তাঁরই ছাতা দিয়ে খোঁচা দেন। প্রত্যুত্তরে নৃপতি বলেন আপনি কি আমায় মারবেন।
রসনায়ক বলে ওঠেন ঠিক করিনি তবে ভাবছি…
শরত্চন্দ্রের পথের দাবী অবলম্বনে সব্যসাচী সিনেমাটি মহানায়কের জীবনে অন্যতম সিরিয়াস ছবি কিন্তু গিরিশ মহাপাত্র ছদ্মবেশী মানুষটি যখন বলেন, তিনি নিজে গাঁজা না খেলেও অন্যের যদি লাগে তাই তিনি নিজের কাছে কলকেখানি রেখে দেন। তখন গম্ভীররসও একটু শিথিল হয়।
শুধু একটি বছর ছবিতে বিবাহকালের মধ্যিখানের একটা বছরের অধিকাংশ সময় এক সদ্য বিবাহিত রসবান পুরুষের ন্যায় হাসি মশকরা করে কাটিয়ে দেন আমাদের নায়ক। তাঁর হৃদয়ে যে বিচ্ছেদের ছেঁকা লাগছিল না তা নয়, তবে তা তাঁর উচ্ছলতার দমকা হাওয়ায় ঢাকা ছিল। অনাবিল আনন্দধারার পাশে থাকার পরিণতি বিচ্ছেদের আসন্ন সময়ে ব্যথার আগুনে নায়িকার অন্তর জ্বলে ওঠে।
যদিও সকল সংলাপ, চিত্রনাট্যকারের কারসাজি, পরিচালকের সুনির্দেশনার বুনন তবু্ও তার সঙ্গে মহান অভিনেতার রসবোধ যদি মিলেমিশে না যেত, তাহলে আজ অর্ধশতাব্দী পরেও আমাদের মনে সদাভাস্বর হয়ে থাকত না।
নায়ক সিনেমায় শর্মিলা ঠাকুরকে ডেকে পাঠানোর সময় ব্লাউজে পেনের অবস্থান দু’বারে বোঝাতে গিয়ে যে সন্তর্পণ অবলম্বন করেছেন তাতে শিক্ষিত সমাজের ঠোঁটের কোনায় সর্বসমক্ষে চিড় না ধরলেও মন মস্তিষ্কে হাস্যরস বিরাজ করে।
দেয়া নেয়া চলচ্চিত্রে, যখন পাহাড়ি সান্যালের সামনে এবং তাঁর একমাত্র সুন্দরী নাতনির সামনে নিজের নাম গৌরহরি ও তাঁর দুই সন্তানের নাম ট্যাঁপাটেপি এবং তাঁর স্ত্রীর নাম ট্যাঁপাটেপির মা বলেন, তখন দর্শকের চেয়ার না নড়ে উঠে পারে না। বন্ধু তরুণকুমার, বন্ধুর স্ত্রী লিলি চক্রবর্তীর সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়ার মুহূর্তে সংগীতশিল্পী জয়ন্ত অনুরাগী সুন্দরী তনুজা উপস্থিত হয়, মহানায়কের তাত্ক্ষণিক শারীরিক অভিনয় কে বা ভুলতে পারে।
তবে আমার ব্যক্তি পছন্দের সবচেয়ে প্রিয় হাসির ছবি ছদ্মবেশী, তবে এরজন্য অবশ্যই গল্পখানা সিংহভাগ দায়ী। তবে উত্তমকুমারের রসের রিখটার স্কেল সর্বোচ্চ মাত্রা ছোঁয়। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছ? রাশভারী বিকাশ রায় প্রশ্ন করেন। উত্তর আসে,
আজ্ঞে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু করিনি, আমি এসে এসে দাঁড়িয়েছি।
বিকালে মাধবী ও তাঁর ভাগ্নীকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় মাধবীর নিকটে আসার ইচ্ছায়, বাংলা চলচ্চিত্রের বড়বাবু বলে ওঠেন বাচ্চা মেয়েটির উদ্দেশ্য- উহারা অতিশয় চতুর… সঙ্গে আরও কিছু কথা। যা মনে পড়লে গোমড়া মুখেরও হাসি ফুটবে।
আমি কোন পথে যে চলি কোন কথা যে বলি গানে অনবদ্য স্বকীয়তা আমাদের রসভাণ্ডারকে পূর্ণতা দেয়।
গানের কথাই যখন উঠল তখন সপ্তপদীর এবার কালী তোমায় খাবোর সঙ্গে ইংরেজি গানের যুগলবন্দি শ্রীখোল সহযোগে এবং জয়লাভ এক মধুর রসের মেলবন্ধন। আর হঠাৎ ওথেলো চরিত্র পাওয়া নিপাট বোমকে যাওয়া উত্তমকুমারকে রীনা ব্রাউন বলে ওঠে ও আমাকে টাচ করতে
পারবে না। সাধারণ বাঙালি ঘরের সচরাচর নারীর স্পর্শ না পাওয়া, মুখে ভুসোকালি মাখা কৃষ্ণেন্দু অসহায়ভাবে বলে ওঠে না ছুঁলে পাঠ করব কী করে? সেই মুখ রসসিক্ত করেছে কাল কাল ধরে।
দুই ভাই ছবিতে বেশ হালকা রসের ছোঁয়া রয়েছে, বিশেষত পায়রা নিয়ে গানখানার মধ্যে।
চাঁপাডাঙ্গার বৌ সিনেমার মধ্যে উত্তমের তারুণ্য রসখানি বেশ জাজ্বল্যমান।
আর আপাদমস্তক হাসির ছবির মধ্যে মৌচাক, ধন্যি মেয়ে সর্বজনীন। ধন্যি মেয়েতে গোল বলে নিজের ঘুমন্ত স্ত্রীর পায়ে শট মারার দৃশ্যে আপামর বাঙালি খানখান। এমনকি অভিনয় জীবনের শেষের দিকে অমানুষ ছবি সিরিয়াস সিনেমা হলেও বঞ্চিত জমিদার মদ্যপ মধু চৌধুরীর বেশ কিছু মজার দৃশ্য রয়েছে।
আর জীবনের সাঁঝেরবেলার ওগো বধূ সুন্দরীতে স্ত্রীর সঙ্গে খুনশুটি মাখা অভিনয় আমাদের কাছ থেকে তাঁকে সশরীরে সরালেও অনুপস্থিত করতে পারেনি। দু’পাত্র মুখে ঢালতেই রসিক বাঙালি গেয়ে ওঠে- এই তো জীবন, যাক না যেদিকে যেতে চায় প্রাণ কিংবা হালকা কোন ক্ষণে বৌ বা বান্ধবীর চিবুক ধরে আজও কেউ গেয়ে ওঠে- লোলা লুলু কেন তোমার বয়স হয় না ষোলো/ আমার নাইন্টিন।
বাঙালির বাঙালিত্বের মাপকাঠি যতই এদিক ওদিক হোক বা ভিনদেশি প্রলেপ পড়ুক, বাঙালি রসগোল্লার রসে টইটুম্বুর ছিল আছে থাকবে। যেমনটি বাংলা সিনেমা উত্তম-রসে রসোত্তম ছিল আছে থাকবে…।