Sunday, May 12, 2024
Homeকলামঅফিসাররা দলদাস ভাবলেই লজ্জা, কষ্ট

অফিসাররা দলদাস ভাবলেই লজ্জা, কষ্ট

  • গৌতম সরকার

ভোটে ভয়। না, হেরে যাওয়ার ভয় নয়। এই ভয় তাই প্রার্থীর নয়। কোনও দলেরও নয়। ভয়টা বদলির, ভয়টা শাস্তির। গ্যারাজ পোস্টিংয়ের আশঙ্কায় আতঙ্ক। কাদের ভয় জানেন? শুনলে অবাক লাগে। ভয় পান অফিসাররা। এমনকি আইএএস, আইপিএস’রাও। কোনও এলাকায় হয়তো তিনি প্রশাসন বা পুলিশের শীর্ষকর্তা। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ন্যূনতম সম্পর্ক থাকার কথা নয়। সরকারি নিয়মে তিনি দল নিরপেক্ষ থাকার কথা।

অথচ সেই এলাকায় শাসকদলের হার হলে দায়ী হন তিনি। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় একজন সজ্জন পুলিশ সুপারকে উদ্বিগ্ন হতে শুনেছিলাম। বলেই ফেলেছিলেন, এই জেলায় তৃণমূলের ফল ভালো না হলে তল্পিতল্পা গোটাতে হবে তাঁকে। মানে সরকার তাঁকে বদলি করে দেবে। তবে, এই ভয় মুদ্রার একপিঠ মাত্র। অপর পিঠে থাকে গুছিয়ে নেওয়ার মানসিকতা। ভালো পদ, ভালো পোস্টিংয়ের মোহ। সেজন্য সরকারের, শাসকদলের সুনজরে থাকতে হয়।

তখন শাসক শিবিরের কেউ অনৈতিক কাজ করলেও চোখ বন্ধ করে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। সন্দেশখালিতে শাহজাহান ও তাঁর বাহিনীর বছরের পর বছর নানাবিধ বেআইনি কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার রহস্য এটাই। তিনি মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ, শাসকদলের এলাকার মাথা। তাঁকে ঘাঁটাতে দম লাগে, মেরুদণ্ড লাগে। এই দমের বড় অভাব, মেরুদণ্ডটা প্রায় নেই। দলদাস শব্দটি এই সূত্রে রাজনৈতিক অভিধানে ঠাঁই পেয়ে যাচ্ছে।

দলদাস শব্দটা অপমানের। শব্দটা অমর্যাদার। যাঁদের পিছনে দলদাসের মতো ঘৃণ্য তকমা লেগে যাচ্ছে, তাঁদের কিন্তু লেজুড়বৃত্তি না করলেও হয়। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, পারিবারিক মর্যাদায় অনেক অফিসারের স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য উল্লেখ করার মতো। আমার এক সহপাঠী পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বিডিও মানে বড় দুঃখের অফিসার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যাঁদের তল্পিবহন করতে হয় এই অফিসারদের, শিক্ষা, স্বকীয়তায় তাঁরা ধারেকাছে থাকেন না।

অথচ তাঁদের পদলেহন করে চলার প্রবণতা এখন ‘টপ টু বটম।’ চাকরি জীবনে অনায়াস পদোন্নতি, পছন্দের পোস্টিং ইত্যাদির পাশাপাশি নতুন ঝোঁক অবসরের পর ক্ষমতার কারবারে নাম লেখানো।

এজন্য আগে থেকে পথ প্রশস্ত করে রাখতে দলদাস হতে হয়। কেউ আবার চাকরি থাকতে থাকতে রাজনীতির হাতেখড়ি নিয়ে নেন আরও ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। উদাহরণ একেবারে কম নেই। বাংলার হুমায়ুন কবীর, উত্তরবঙ্গের জেমস কুজুর।

অবসরের পর শাসক শিবিরে নাম লিখিয়ে সুবিধাভোগীও অনেক। উপেন বিশ্বাস, মণীশ গুপ্ত, সুলতান সিং, রচপাল সিং, জহর সরকার। এই মণীশ গুপ্ত বাম আমলের স্বরাষ্ট্রসচিব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যুব কংগ্রেসের মিছিলে গুলিচালনার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি হয়ে গেলেন তৃণমূল জমানার মন্ত্রী। সুলতান, রচপালদের বিরুদ্ধে বাম জমানায় তৃণমূলকে হেনস্তা করার ভূরিভূরি অভিযোগ। তাঁরাও মমতার দাক্ষিণ্যে হয়ে গেলেন মন্ত্রী।

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আস্থাভাজন ছিলেন আদতে উত্তরবঙ্গের মানুষ সুখবিলাস বর্মা। তাঁর গানে গুণমুগ্ধ ছিলেন বুদ্ধদেব। সেই সুখবিলাস অবসরগ্রহণের পর হয়ে গেলেন কংগ্রেস বিধায়ক। সর্বভারতীয় স্তরে অবসরের পর রাজনীতিতে নাম লেখানোর অন্যতম উদাহরণ এখনকার বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর। ক্ষমতার মধুভাণ্ডের সঙ্গে থাকতে পিছিয়ে থাকছেন না বিচারপতিরাও। বড় প্রমাণ সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ।

হঠাৎ ভূমিপুত্রের অবতারে সমাজসেবায় মরিয়া হতে দেখে মনে হচ্ছে, সম্ভবত সেই তালিকায় নাম লেখাতে চলেছেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। সারা দেশে এ রকম আরও কয়েকজন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সচিবকে প্রার্থী করার কথা শোনা যাচ্ছে পদ্ম শিবিরে। অবসরের আগেই যে এঁদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে কারণে সরকারি পদের নিরপেক্ষতা পদদলিত করার এত ঘটনা চারদিকে। দলে দলে মৌলোভীদের ভিড় ক্ষমতাসীনদের ঘরে।

তৃণমূলের সাধারণ অনেক কর্মী বিরক্ত হন এই পরিবেশে। কাউকে কাউকে নিজের জেলার জেলা শাসককে তৃণমূলের জেলা সভাপতি বলে কটাক্ষ করতে শুনেছি। শুনে আমারই লজ্জা হয়। কিন্তু যাঁদের উদ্দেশে বলা, তাঁদের যেন দু’কান কাটা। শাসকদলের মর্জিমাফিক আমলাকুলের চলাটা নতুন নয়। কংগ্রেস আমলে বাম আন্দোলনে পুলিশ লাঠি-গুলি চালাত বলে স্লোগান উঠত, ‘পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো।’

সত্যিই তখন শুধু পুলিশের নয়, সরকারি কর্মী, শিক্ষকদের বেতন শুনলে লজ্জা পেতে হত। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেই বেতন ধাপে ধাপে অনেক বাড়িয়েছিল সন্দেহ নেই। বিনিময়ে তাঁবে রাখতে চেয়েছিল আমলাকুল, পুলিশ ও শিক্ষকদের। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, ‘সবার ওপরে কোঅর্ডিনেশন কমিটি সত্য, তাহার ওপরে নাই।’ তবে মেরুদণ্ড একেবারে নুইয়ে পড়েনি তখন।

কংগ্রেস কিংবা বাম জমানার প্রথম দিকে অন্তত কিছু মেরুদণ্ড ছিল, যাঁরা মন্ত্রী-নেতাদের মুখের ওপর বলতে পারতেন, এই কাজটা করা ঠিক হবে না স্যর। শাসক শিবির এইসব মেরুদণ্ডদের ঘাঁটাত না। গত সপ্তাহে এই কলামে কোচবিহারের ঘোকসাডাঙ্গায় এক গণধর্ষণের ঘটনায় সিপিএম নেতা ক্যালসা মিয়ঁার জড়িয়ে থাকার কথা লিখেছিলাম। কোচবিহারের তৎকালীন পুলিশ সুপারকে এক দাপুটে মন্ত্রীকে টেলিফোনে বলতে শুনেছিলাম, স্যর, ওঁকে সারেন্ডার করতে বলুন। নাহলে আমাকে অ্যারেস্ট করতেই হবে।

১৯৯৩-এর উত্তরবঙ্গে প্রবল বন্যার পর এক জেলা শাসকের দপ্তরে সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতাদের নানাভাবে তাঁদের পছন্দ মতো উদ্ধার ও ত্রাণ কাজ করতে চাপ সৃষ্টি করতে দেখেছি। জেলা শাসক তাঁদের কথায় টুঁ শব্দ করলেন না। কিন্তু প্রশাসনের কাজ যেমন হওয়া উচিত, তাই করলেন। এই সাহস, এই মেরুদণ্ড না থাকলে হে আইএএস, আইপিএস মহোদয়গণ, আপনাদের লোকে দলদাস তো বলবেই। অথচ আপনাদের যা শিক্ষা, যোগ্যতা, তাতে এটা না করলেও আপনাদের চলত।

যদিও বাম জমানাতে বেশি করে শুরু হয় দলদাসের রাজত্ব। শিক্ষাক্ষেত্রে ‘অনিলায়ন’ দলদাস সৃষ্টির পদক্ষেপ। চণ্ডীগড়ে সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচনে কারচুপি করে আপ প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে ‘গণতন্ত্রের হত্যা’ বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত রিটার্নিং অফিসার সিসিটিভি’র দিকে তাকিয়েই কারচুপি করেছেন। এই উত্তরবঙ্গে এক বিডিও সিসিটিভি’র মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে কারচুপিতে সাহায্য করেছিলেন গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে। আরেক বিডিও ব্যালট পেপার ছিঁড়ে শাসকপক্ষকে সাহায্য করেছিলেন। সেই তথ্য আতশকাচের নীচেই আছে। বালি, পাথর, কয়লা, গোরু পাচার, জমির কারবারে মাফিয়াদের সঙ্গে কিছু নেতার পাশাপাশি জড়িয়ে যাচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসনের কিছু পদস্থ কর্তার নাম। ক’দিন আগে এই সংবাদপত্রেই আমার সহকর্মী রণজিৎ ঘোষ লিখেছিলেন, কয়লা পাচারের সিন্ডিকেটের কাজ মসৃণ করার দায়িত্বে আছেন উত্তরবঙ্গে এক জেলার শীর্ষ পুলিশকর্তা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তাঁদের কাছে আমরা নিরপেক্ষতা আশা করি। এত দলদাস থাকলে শাহজাহানদের দৌরাত্ম্য রোখার সাধ্য কারও নেই।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

0
সিতাই: সংসারের অভাব অনটনকে কাটিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করল কৃষকের ছেলে দীপঙ্কর শর্মা।

Sandeshkhali case | জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে মামলা করতে চায় তৃণমূল, কিন্তু কেন?...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ সন্দেশখালিতে একের পর এক ভিডিও ভাইরাল হতেই কিছুটা হলেও বেসামাল গেরুয়া শিবির। আর এই ভিডিওকে সামনে রেখেই সন্দেশখালির নির্বাচনি ময়দানে...

Terrorist arrested | জম্মু-কাশ্মীরের বন্দিপোরায় যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার জঙ্গি

0
বন্দিপোরা: জম্মু ও কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ১ জঙ্গি। একটি সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেয়ে রবিবার উত্তর কাশ্মীরের বন্দিপোরা জেলায়...
Allu Arjun in legal complications before the election

Allu Arjun | নির্বাচনের আগে আইনি জটিলতায় আল্লু অর্জুন, কী করলেন অভিনেতা?

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চতুর্থ দফা নির্বাচনের আগে আইনি জটিলতায় পড়লেন দক্ষিণি তারকা আল্লু অর্জুন(Allu Arjun)। অভিনেতার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু...

Arvind Kejriwal | ইন্ডিয়া জোট জিতলেই বিনামূল্যে বিদ্যুৎ-শিক্ষা-চিকিৎসা! জেলমুক্ত হতেই ১০ গ্যারান্টি কেজরিওয়ালের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে (Arvind Kejriwal) ২১ দিনের অন্তর্বর্তী জামিনের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court)। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই...

Most Popular