শিলিগুড়ি: প্রতিটি চলন্ত গাড়ির কাচ বন্ধ, এই গরমেও। সাইকেল আরোহীর এক হাত হ্যান্ডেলে, অন্য হাত নাকে। চারিদিক দুঃর্গন্ধময়। চোখ জ্বলে যায় আগুনের ধোঁয়ায়। মাথার ওপর চক্কর কাটা কাক-চিলের নজর নীচে আস্তাকুঁড়েতে। কিন্তু কোনও কিছুতেই ওঁদের ভ্রূক্ষেপ নেই। ওঁদের চোখ খোঁজে ‘রসদ’, সুস্থ শরীরটাকে বিপন্নতার পথে ঠেলে দিয়ে। ডাম্পিং গ্রাউন্ডই তো ভাত জোগায়, বললেন আরবাজ-সিরাজরা।
দিনের আলো ফুটলেই শিলিগুড়ির (Siliguri) ডাম্পিং গ্রাউন্ডের (Dumping ground) আকাশের দখল নেয় কাক-চিলে। ওঁরাও চলে আসেন শহরের যাবতীয় বর্জ্য-আবর্জনার স্তূপে। ধোঁয়া-দুর্গন্ধের পৃথিবী জেনেও সকাল থেকে সন্ধে কাটিয়ে দেন। যেখানে মিথেন গ্যাসে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, দুর্গন্ধে পেটের ভিতর থাকা ভাত মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়, সেখানে নজরে পড়ল এক রমণী এবং তাঁর সঙ্গে থাকা দু’তিনজন মিলে খাবার খাচ্ছেন। কাছে গিয়ে প্রশ্ন ছোড়া হল, এমন পরিবেশে খাবার খাচ্ছেন, সমস্যা হয় না? কোনও জড়তা না রেখে সীতার উত্তর, ‘অনেক বছর ধরে এখানে কাজ করছি। তেমন সমস্যা হয় না। খালি পেটে থাকলে একটু সমস্যা হয়।’
এখানে পুরনিগমের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কর্মরত সৌম্য দত্ত, আনন্দ বৈরাগীরা জানালেন, তাঁদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সীতা এবং সঙ্গে থাকা বাকিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একটি এজেন্সির হয়ে কাজ করেন তাঁরা। কাজ বলতে ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে প্লাস্টিক জাতীয় বস্তু কুড়িয়ে বস্তাজাত করা। রোজগার কত? মুখ খুললেন না তেমন কেউই। গাড়ি থেকে বেলচা দিয়ে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে আবর্জনা ফেলছিলেন পুরনিগমের অস্থায়ী এক কর্মী। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘ওঁরা দৈনিক তিন-চারশো টাকার বেশি মনে হয় পান না।’ নিজে থেকেই নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরলেন রাম যাদব। তাঁর কথায়, ‘বর্ষার সময় থেকে এখন দুর্গন্ধ অনেকটাই কম। বৃষ্টি হলে চরম সমস্যা হয়।’ পুরনিগমের এক কর্মী পাশ থেকে জানালেন, ‘অফিস থেকে রেইনকোট দেয়। কিন্তু ভারী বৃষ্টি হলে কাজ করতে খুব সমস্যা হয়।’ পাশে থাকা বেণু একগাল হেসে বললেন, ‘কাজ করতে হয়। শহরে তো আর ময়লা ফেলে রাখা যায় না।’
আবর্জনার স্তূপের মধ্যে প্লাস্টিক এবং বাজারে যা বিক্রি করা সম্ভব, তা ফেলে রাখতে চান না অনেকেই। সকাল হলে দল বেঁধে চলে আসেন ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। আসরাফনগরের মহম্মদ সিরাজ বা রাজা হাউলির মহম্মদ আরবাজের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রতিদিন প্রায় দুশোর বেশি ট্রাক এখানে আবর্জনা ফেলে। তার থেকে বাছাই করে দিনপ্রতি ২০-২৫টি ছোট গাড়িতে তাঁরা প্লাসটিকজাত বিভিন্ন ধরনের জিনিস বোঝাই করেন। এই কাজ করতে দেখা গিয়েছে অনেক মহিলার পাশাপাশি নাবালককেও। গীতারানি নামের এক মহিলা জানালেন, কাজে যোগ দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসক এ ধরনের কাজ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাহলে করছেন কেন, প্রশ্নে গীতার জবাব, ‘খাব কী? ছেলে দুটোকে খাওয়াব কী?’
মৃত্যুর মতো ঘটনা না ঘটলেও মিথেন (Methane) গ্যাসের জন্য নানা রোগ হতে পারে বলে জানাচ্ছেন জলপাইগুড়ি মেডিকেল কলেজের সুপার ডাঃ কল্যাণ খান। তাঁর বক্তব্য, ‘মিথেন গ্যাসের জন্য শরীরে অক্সিজেন কমে যায়। ফলে নিউরোলজিক্যাল নানান ধরনের রোগ হতে পারে। দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হতে পারে।’